আজকে এমন এক সভ্যতার কথা বলব যেখানে মানুষ চাকার ব্যবহার জানত না। জানত না লোহা অথবা স্টিলের ব্যবহার। কিভাবে পশুর উপর চড়তে হয় তাও বুঝত না। পশুদিয়ে চাষ-আবাদ করার কথা তাদের চিন্তায় আসে নি। ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত মূলত পেরু থেকে শুরু করে বর্তমান ইকুয়েডরের বড় একটি অংশ, বলিভিয়ার দক্ষিন ও পশ্চিম অঞ্চল, উত্তর আর্জেন্টিনা, উত্তর ও মধ্য চিলি এবং দক্ষিন কলম্বিয়ার ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে এই সভ্যতা গড়ে উঠে। তারা লিখতে জানত না, তবে হস্ত ও কুটির শিল্পের তাদের দক্ষতা ছিল। পাঠকবৃন্দ হয়ত ধারনা করতে পেরেছেন আমি কাদের কথা বলছি। জ্বী, আমি ইনকাদের কথাই বলছি। এত সীমাবদ্ধতার পরেও ইনকারা এক বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করতে সমর্থ হয়েছিল।
এসব এলাকায় প্রাচীন ইনকা যুগের কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। এমনকি পেরুতে ইনকা যুগের একটি সেতু লোকেরা এখনও ব্যবহার করে থাকে।
“সেতু” প্রাচীনকালের নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি। বলা হয়ে থাকে প্রকৃতি নিজেই মানুষকে সেতু নির্মান করতে শিখিয়েছে। প্রাচীনকালে কোন সরু নদী, বন্ধুর জমিনের উপর পড়ে থাকা মরা গাছের উপর দিয়ে হেটে চলে যেত। মানুষ প্রথম সেতু নির্মাণ করে গাছের গুড়ি কেটে, তক্তা ফেলে। এরপর মানুষ শিখল পাথরের ব্যবহার।
এপর্যন্ত যতগুলো সেতু হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় সেতুর দৈর্ঘ্য ২৩.৮ মাইল। এই সেতুটি Pontchartrain Causeway লেকের উপর নির্মাণ করা হয়েছিল। সবচেয়ে পুরনো যে সেতুটি এখনও ব্যবহৃত তা তুরস্কের ইযমিরে অবস্থিত। মেলেস নদীর এই সেতুটি খ্রিস্টপূর্ব ৮৫০ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল। এরচেয়েও পুরনো সেতুর ধ্বংসাবশেষ হয়েছে গ্রীসে। খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ সালের এই সেতু এখন আর ব্যবহার উপযোগী নেই। তবে সেতু নির্মাণকারী হিসেবে রোমানদের খ্যাতি রয়েছে। রোমানরা বিভিন্ন ধরনের সেতু নির্মাণে পারদর্শী ছিল।
ইনকারা নদীর, নালার উপর দিয়ে সেতু নির্মান করত। দুই পাহাড়ের মধ্যকার গিরিখাতের উপরও সেতু নির্মান করেছিল। সেতু নির্মানে তারা মূলত দড়ি ব্যবহার করত। ইনকারা চাকার ব্যবহার জানত না। তারা পায়ে হেটে চলাচল করত। এই সেতুগুলো ছিল তাদের যোগযোগ ব্যবস্থার অন্যতম দিক। ইনকারা কতটা উদ্যমী ও পরিশ্রমী ছিল সেতুগুলো তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
ঘাস থেকে সেতুর জন্য দড়ি তৈরি করা হচ্ছে
সেতু তৈরির সরঞ্জাম ছিল সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। বিভিন্ন লতা-পাতা ব্যবহার করে তারা শক্ত দড়ি তৈরি করতে পারত যা তাদের ভার বহনে সক্ষম ছিল। এই দড়ির উপর ধাপে ধাপে কাঠের তক্তা বসানো হত। আর দড়ির দু’মাথা দু’পাশে পাথরের থামের মধ্যে আটকানো হত।প্রয়োজনে আরো দড়ি ব্যবহার করে সেতুগুলো যথেষ্ঠ মজবুত করা হত। স্পেন যখন ইনকাদের আক্রমণ করেছিল তখন তাদের অশ্বারোহীরা এই সেতুর উপর দিয়েই পার হয়েছিল।.
নির্মিত সেতুগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ইনকাদের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট লোক ছিল। প্রতিবছর সেতুগুলোর দড়ি পরিবর্তন করা হত। একারনেই সেতুগুলো টেকসই থাকত এবং স্থায়িত্ব বাড়ত।
সেতুর মেঝে তোলা তোলা ম্যাট রোল
বর্তমানে কেবল পেরুর অপুরিমাক নদীর উপর নির্মিত Q’iswa Chaka সেতুটি টিকে আছে। কাছাকাছি আরও একটি আধুনিক সেতু থাকলেও এলাকাবাসীরা তাদের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে এখনও এই সেতুটি ব্যবহার করে থাকে। আগের মত এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও তারাই পালন করেন। প্রতিবছর জুন মাসে তারা সেতু মেরামতের কাজে হাত দেন।কোন কোন পরিবার ঘাস দিয়ে দড়ি ও তার তৈরি করেন, কেউ বা তৈরি করেন বিছানোর জন্য কাঠের তক্তা। এর জন্য তারা কোন পারিশ্রমিক পান না। পুরো ব্যপারটাই স্বেচ্ছাশ্রমের উপর নির্ভরশীল। এলাকারবাসী বলেন, Pachamama (পৃথিবী-ইনকারা পৃথিবীর পূজা করত) এবং পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা জানাতেই তারা আজও Q’iswa Chaka সেতু মেরামতের কাজ করে যাচ্ছেন।
এই সেতুটি বর্তমানে পর্যটকদের কাছে একটি আকর্ষনীয় স্থান। অল্প খরচায় পর্যটকরা সেতুর উপর দিয়ে আসা-যাওয়ার সুযোগ পান। বিগত ২০০৯ সালে পেরুর সরকার এই সেতুকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগত স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের দায়িত্ব গ্রহণ করে। সেতু মেরামতের প্রক্রিয়াটি বিশ্ববাসীর আগ্রহ মেটাতে ২০০৯ সালে বিবিসি এবং নোভা প্রডাকশন মিলে The Last Bridge Master নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করে।