গাছ প্রকৃতপক্ষে মানুষের পরম বন্ধু। গাছ বিনে গোটা মানবকূল ও প্রাণীকূল বিলীন হওয়ার উপক্রম হতে পারে। তাছাড়া বৃক্ষ বিহীন রচিত হতে পারতো না কোনো সাহিত্য। বৃক্ষ তথা গাছ নিয়ে আমরা আয়োজন করেছি প্রজেক্ট গ্রিন প্রকল্প। এই পরম বন্ধু সম্পর্কে না জানলেই নয়! তাই প্রজেক্ট গ্রিন সম্পর্কিত বেশ কয়েকটা আর্টিকেল ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। আজকের প্রজেক্ট গ্রিনে আমরা জানবো গাছের ওষধি গুণাগুণ সম্পর্কে, আরও জানবো যে এইসব গাছই কিন্তু আমরা ঘরের করিডোরে কিংবা ব্যালকনি অথবা বাড়ির ছাদে বা বাগানেও লাগাতে পারি।
অ্যালোভেরা
একে আমরা মূলত অ্যালোভেরা নামে চিনলেও এর আরেক নাম ঘৃতকুমারী। অ্যালোভেরা ত্বক ও চুলের জন্যে দারূণ উপকারী। ত্বকের উজ্জলতা বাড়ায় এই অ্যালোভেরা পাতা থেকে প্রাপ্ত জেল। মেছতার সমস্যা প্রতিরোধে অ্যালোভেরা পাতার রস পানির সঙ্গে মিশিয়ে প্রতিদিন খান অন্তত ২বার ,প্রত্যেকবার ১০ মিলিলিটার করে। এই টিপস এর সাথে আরও যোগ করুন সহজ টিপস, ঘৃতকুমারীর একটি পাতা, মধু ও একটি ছোট শসা মাস্ক করে মেছতার ওপর লাগিয়ে রাখুন। আশ্চর্য হওয়ার মতই উপকার পাবেন, এটি চামড়ার ফুস্কুড়িও প্রতিরোধ করতে পারে। এছাড়া চুলের উজ্জলতা বাড়াতে প্রাকৃতিক কন্ডিশনার হিসেবে এর জুড়ি মেলা ভার। সাথে আরও যোগ করলে বলতে হয় চুল পড়া এবং খুশকি প্রতিরোধ করে অ্যালোভেরা। খুশকি প্রতিরোধে মেহেদি পাতার সঙ্গে অ্যালোভেরা মিশিয়ে মাথায় লাগিয়ে রাখুন ও শুকানো পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। তারপর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে হাল্কা শ্যাম্পু করে নিন আর দেখুন অ্যালোভেরার তেলেসমতি। এতে চুল ঝরঝরে এবং উজ্জ্বল হয়।
কীভাবে অ্যালোভেরা জেল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করবেন?
একটি ধারালো ছুরি দিয়ে গাছের পাতার উপরের দিকের অংশের পুরু সবুজ চামড়া সরিয়ে পাতার ভেতরের পরিষ্কার জেলি যতটা সম্ভব বের করে নিতে হবে। ব্লেন্ডারে এই জেলি নিয়ে পানি ছাড়া ভাল করে ব্লেন্ড করুন। বের করার আগে দেখুন যেন সবটুকু জেলি খুব ভাল ভাবে ব্লেন্ড হয়েছে কিনা। এবার এই মিশ্রণটি ভাল করে ছেঁকে নিন। যেকোনো পরিষ্কার মুখ বন্ধ পাত্রে/ কৌটায় রেখে দিন। ফ্রিজে নরমালে রাখলে এই জেল প্রায় এক সপ্তাহ পর্যন্ত ভালো থাকবে। গোসলের আগে মুখের ত্বকে ক্রিমের মত লাগিয়ে রাখতে পারেন। চাইলে অন্য কোন কন্ডিশনারের সঙ্গে মিশিয়েও এটি ব্যবহার করতে পারেন সাথে সাথেই।
আপনি চাইলে নিয়মিত অ্যালোভেরা জুস পান করে কোষ্ঠকাঠিন্যকে চিরতরে বিদায় জানাতে পারেন। শরীরের শক্তি যোগান সহ ওজনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে খুব কার্যকর এই জুস।
পাথরকুচি
এই পাথরকুচি পাতার যে অসাধারণ ওষধি গুণসম্পন্ন তা হয়ত অনেকেই জানেন না। এর একটি পাতা-ই ভেজা মাটির ওপর রেখে দিলে পাতার খাঁজ কাটা অংশ থেকে বীজের মতো পাথরকুচির বীজ বের হয়ে একসময় তা থেকেই নতুন গাছের জন্ম হয়।
পুরনো সর্দি সারাতে এটি বিশেষ উপযোগী। এছাড়া কফ বিকারে পাথরকুচি পাতার রস একটু গরম করে খেয়ে বেশ উপকার পাবেন। এভাবে খেতে আপত্তি থাকলে একটু মধু বা চিনি ও মিশিয়ে খেতে পারেন। কোথাও কাটা বা থেতলে গেলে টাটকা পাতা হালকা তাপে গরম করে ঐ স্থানে সেক দিলে তাড়াতাড়ি সেরে যায়। শিশুদের পেটব্যথায় ৩০-৬০ ফোঁটা পাথর কুচির পাতার রস পেটে মালিশ করলে ব্যথা উপশম হয়। লিভারের যেকোনো সমস্যা বিশেষত জন্ডিস থেকে রক্ষা পেতে তাজা পাথরকুচি পাতার জুস অনেক উপকারী। যারা ত্বক সম্বন্ধে সচেতন, তারা পাথরকুচি পাতা বেটে ত্বকে লাগাতে পারেন। ব্রণ ও ফুস্কুড়ি জাতীয় সমস্যা অতিসত্ত্বর পালিয়ে যেতে বাধ্য। এছাড়া বিষাক্ত পোকার কামড়ের স্থানে এই পাতার রস আগুনে সেঁকে লাগালে উপকার পাওয়া যায়।
দূর্বা ঘাস
দূর্বা ঘাসের একটি কমন ব্যবহার আমরা কম বেশি সকলেই ছোটবেলায় খেলতে গিয়ে প্রয়োগ করে এসেছি। কি? মনে পড়ছে না? তাহলে এবার মনে করিয়ে দেই।কেটে যাওয়া বা আঘাত জনিত রক্তক্ষরণে দুর্বা ঘাস সামান্য পানি সহ পিষে কাটাস্থানে বেঁধে দিলে রক্তপাত বন্ধ হয়ে যায় এবং দ্রুত কয়েকদিনের মাঝেই শুকিয়ে যায়।
এছাড়া চুল পড়া প্রতিরোধে, বমি বমি ভাব দূরীকরণে, রক্ত পিত্ত নিরাময়ে দূর্বাঘাস আয়ুর্বেদীয় মহৌষধ। দুর্বা ঘাসের নির্যাস রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ অর্ধেক পর্যন্ত কমিয়ে আনে। রেচনতন্ত্রের স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে দুর্বা ঘাস সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
সাধারণত দুর্বা ঘাস দীর্ঘকাল প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার ক্ষমতা রাখে। মাঠে ময়দানে ঘরবাড়ীর আনাচে কানাচে এ ঘাস আপনা আপনি জন্মায়। মাটির নিচে থাকে এর গুচ্ছ মূল। সুবিধা হল দুর্বা ঘাস আলাদা ভাবে চাষের কোন প্রয়োজন হয় না। অনেকে বাগানের সৌন্দর্য বাড়াতে শুধুমাত্র দূর্বা ঘাস রাখেন গালিচার মতই।
তুলসী
বাঙালি ও ভারতীয়দের মাঝে অতি পরিচিত গাছ হল তুলসী। বিভিন্ন পূজোয় এই পাতা ব্যবহৃত হলেও আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে এর তুলনা নেই।
তুলসী পাতা সবচেয়ে বেশি যে রোগের হাত থেকে বাঁচায় তা হল জ্বর। সাথে আছে সর্দি ও কাশি। চায়ের পাতার সাথে তুলসী পাতা সেদ্ধ করে পানীয়টি পান করে দেখুনই না একবার? কি দারুন ম্যাজিকের মত কাজ দেয়। তাছাড়া সর্দিতে তুলসীর একটি পাতা ভালোভাবে চিবিয়ে রসটুকু গিলে খান। গলার ব্যথাতে তুলসীপাতা সেদ্ধ করা পানি দিয়ে গারগল করুন। ত্বকের সমস্যা সমাধানেও রয়েছে তুলসী পাতার টিপস। তুলসী পাতার পেস্ট বানিয়ে রোজ মুখে লাগান মাস্ক হিসেবে। আর অপেক্ষা করুন সুন্দর মসৃণ ত্বকের। তাছাড়া কিডনির পাথর উপশমে অত্যাশ্চর্য ম্যাজিক হল টানা ৬ মাস তুলসী পাতার রস রোজ খেলে ইউরিনের সাথে স্টোন বেরিয়ে গিয়ে রোগ মুক্তি ঘটাতে বাধ্য।
গাঁদা ফুল ও পাতা
হলুদ রঙের গাঁদা ফুলের সাথে আমরা সবাই পরিচিত। সাধারনত মালা বানাতে, বিয়ের স্টেজ সজ্জায় এই ফুল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে কেবলই কি সাজসজ্জায় এর ব্যবহার হয়? মোটেই না! জেনে নিন এই ফুলের ও পাতার আরো বিশেষ কিছু উপকারিতা সম্পর্কে?
কাটা-ছেঁড়ায় গাঁদা ফুলের পাতা বেশ উপকারী অনেকটা দূর্বা ঘাসের মতই। টিউমার ও ক্যান্সারের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে গাঁদা ফুলের নির্যাস। বিভিন্ন ধরনের এসেনশিয়াল অয়েল ও সুগন্ধি তৈরিতে গাঁদা ফুল ব্যবহৃত হয়। এছাড়া গাঁদা পাতার রস ছত্রাকনাশক হিসেবে বেশ কার্যকরী।
নয়নতারা
বাগানবিলাসীরা মূলত নয়নতারা গাছ বাগানের শোভা বর্ধনের জন্যেই লাগিয়ে থাকেন। কিন্তু আজ আমরা জেনে নিব ইউনানী শাস্ত্রমতে এর গুনাগুন সম্পর্কে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় নয়নতারা গাছ ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত। কারণ নয়নতারা রক্তে শর্করার পরিমাণ কমায়। তাছাড়া বোলতা হুল ফোটালে নয়নতারা পাতার রস পিষে লাগালে জ্বালা-পোড়া থেমে যায়। নয়নতারার পাতায় ভিনডোলিন নামক ক্ষার থাকায় এটি ডিপথেরিয়া জীবাণুর (Corynebacterium diptherae) বিরুদ্ধে সক্রিয়। স্ক্যার্ভি, উদরাময়, গলাব্যথা, টনসিলের প্রদাহ, রক্তশূণ্যতা ইত্যাদিতে এটি দারূন উপকারি। এছাড়াও এর মূল সর্প, বিচ্ছু ইত্যাদির বিষনাশক তৈরিতেও উত্তম রূপেই ব্যবহৃত হয়।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষার পাশাপাশি গৃহ সৌন্দর্য তো বাড়বেই, সাথে রূপ চর্চা এবং ওষুধি গুণ সম্পন্ন এইসব গাছ আপনাকে দিবে দীর্ঘ আয়ুর নিশ্চয়তা। ছোট খাটো রোগমুক্তিতে সরাসরি অ্যান্টিবায়টিক সেবন করা থেকে মুক্ত থাকুন। ব্যবহার করুন এসব ওষুধি গাছ আর ফল ভোগ করুন ম্যাজিকের মতন।