লঞ্চ করে ঢাকা আসছি।
লঞ্চ এসে এক আশ্চর্য জিনিষ প্রত্যক্ষ করলাম। পুরা লঞ্চ ফাঁকা হলেও কেবিনগুলো আগেই বরাদ্ধ হয়ে গেছে। এক প্রকার বাধ্য হয়ে ডেঁকে চাঁদর পেতে বিছানা করলাম। সাথে বড় ভাই আছেন। বড় ভাই আগে একজন শেয়ানা টাইপের মানুষ ছিল। বর্তমানে একটি বেসরকারী কোম্পানীতে চাকুরি করার সুবাদে তাবলীগ জামায়াত করে। কোম্পানীর মালিকও এক সময় নামকরা ঢাকু ছিল। সেখান থেকে নিজ যোগ্যতায় গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে একটি রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় ঠিকাদারী কাজ শুরু করে। টাকা পঁয়সা অধিক হলে এই সমস্ত কাজ বাদ দিয়ে ধর্মের কাজে আত্মনিয়োগ করে। সে থেকে কোম্পানী মালিকের তাবলীগ জামায়াতী জীবন শুরু। বর্তামানে জাপানী ভেহিকলের ব্যবসা। কর্মচারীদের তাবলিগে যোগদান করা মালিকের হুকুমে ফরয। জামায়াতকালীন সময়ে থাকা ও বেতন যথারীতি বহাল থাকে। বড় ভাই ইতোমধ্যে আট বছরের চাকুরি জীবনে ৪০ দিনকার আট চিল্লা দিয়ে ফেলছে। তিন দিন আর সাত দিনের সফর আছে অসংখ্যবার। বড় ভাইজান কাঁজের ফাঁকে বা অবসরে ফাজায়েলে আমল সহ ছোট বড় কয়েকটি কিতাব পড়েন। আওলিয়াদের জীবনী প্রায় মুখস্ত। ঘুঘু মুন্সির কাহিনী তাকে খুব আন্দোলিত করে। সেদিন দেখলাম ভাতিজাকে ঘুঘু মুন্সির কাহিনী শুনাতে। আজ হয়ত লঞ্চে শোয়ার আগে কোন কিতাব পড়বে। ব্যাগে মোকসুদুল মোমিন নামে একটি বই আছে। তার কারণে উছুলী, গিত্তা, চিল্লা, এন্তজাম ইত্যাদি শব্দের সাথে পরিচিত হই।
ঘাট থেকে রাত দশটা বাজে লঞ্চ ছাড়ে কিন্তু সাড়ে নয়টা বাজতেই লঞ্চ ভরে একাকার। পরে যারা আসবে তাদের কি হবে একটু চিন্তা করতে লাগলাম। কাঁচামাল আর আড়ৎ থেকে মাছ উঠাতে অতিরিক্ত সময় লাগার কারণে সাড়ে দশটা বাজে ছাড়ল। ভাইজান দু’টি একশ টাকার নোট হাতে ধরিয়ে দিয়েছে যাতে কেন্টিন থেকে রাতের খাবারটা খেয়ে আসি। কেন্টিনে কিছু মানুষ আসন না পেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাবার খাচ্ছে। কেন্টিনের অনতি দূরে মেশিন রুম, তারপর স্টাফ কেবিন এবং একে বারে পিছনে টয়লেট দেখলাম। সেখানে নারী পুরুষের ছোটখাটো একটা লাইন। খাবারের আইটেম বলতে, মুগডাল, ফার্মের মোরগ, আর রুই জাতীয় মাছ। মাছ আর মুরগির মাংস খেলে পাতলা ডাউল ফ্রি। আমি অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থেকে একটি আসন দখল করে খাবার পর্বটি সেরে ফেলেছি। ভাইজান এতক্ষণ ব্যাগের পাহাড়ায় ছিলেন এখন আমি সেই দায়িত্ব পালন করব, এই ফাঁকে সে খাবার খেয়ে নিবে। আমি মাথার নিচে ব্যাগটা রেখে জড়োসরো হয়ে শুয়ে মোবাইলের স্কিনে একের পর এক টাঁচ করে যাচ্ছি। এমন সময় এক মহিলা আমার বিছানার কাছে এসে দাঁড়াল। বয়স বাইশ কি তেইশ হবে, এক হাতে ব্যাগ আরেক হাতে একজন বাচ্ছাকে কোলে করে দাঁড়িয়েছে। দেখে গ্রামের একে বারে নিচু স্তরের মানুষ মনে হল। কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু আমি বিরক্ত হই কিনা তাই বলছেনা। আমি জিজ্ঞেস করলাম-
কিছু বলবেন আপা?
আল্লাহর ওয়াস্তে যদি আপনাদের পাশে আমার ব্যাগটা রাখতে দিতেন।
কেন নয়, আপনি রাখুন। কিন্তু আপনি বাচ্চা নিয়ে এই শীতের ভিতরে সারা রাত কিভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাবেন।
মহিলাটি কোন উত্তর দিতে পারে না। সে ব্যাগ রাখতে পারছে এতেই খুশি। ব্যাগটি আমাদের পাশে রেখে লঞ্চের পার্শ্বে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। কিছুক্ষণ পর দেখলাম বাচ্ছাটির মুখ কাপড়ের আচলের ঢেকে দুধ পান করাচ্ছে। সামনের বিছানায় এক বৃদ্ধ চাচা এশারের নামাজ পড়ছে। পাশে চাচি বসা। আমি মোবাইলে পুরাদমে আঙ্গুল চালিয়ে গেলাম। মহিলাটির কোলের বাচ্ছার জন্য আমার কিঞ্চিত মায়া লাগল। ভাবতে থাকলাম মহিলার জন্য বসার ব্যবস্থা করা যায় কিনা। আমার ও বৃদ্ধ চাচার বিছানার মাঝখানে একটু ফাঁকা ছিল। আমারটার যদি একহাত চাপাই আর চাচারটির এক হাত চাপাতে পারলে মহিলার বসার মত জায়গা হবে। চাচাকে অনুরোধ করার পর রাজি হল। আমি মহিলাকে ডেকে এনে বসালাম। মহিলার কাছে এটা অপ্রত্যাশিত ছিল। অনেক খুশি এবং কৃতজ্ঞবোধ তার মধ্যে জেগে উঠল।শুধু মুখে বলল, আপনি আমার ভাইয়ের মত কাজ করেছেন।
বড় ভাইজান খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিছানায় এসে অবাক। আমাকে জিজ্ঞেস করলো-
সে এখানে?
আমি বসিয়েছি।
হাতেম তাঈগিরী আর গেল না।
মহিলাটি এবার একটু লজ্জা পেল। আমি মনে মনে হেসে উঠলাম। এই সামান্য কাজের জন্য একজনের মাগনা মাগনা ভাই হয়ে গেলাম। আরেক জন থেকে হাতেমতাঈ উপাধি পেলাম। চাচা নামাজ শেষ করলেন। দুই তিনটি বিছানার পর একটি বিছানাতে দেখলাম দু’জন ছেলেকে লঞ্চের সাইটে বসে পিঠ লাগিয়ে মোবাইলের পর্দায় অধিক মনোযোগী হয়ে কি যেন দেখছে। তবে বুঝা যাচ্ছে তারা বিশেষ কিছু দেখছে আর অনতি দূরের বিছানায় একজন তরুণীর দিকে কিছুক্ষণ পরপর কুঁত কুঁতি চোখে তাকাচ্ছে। একে বারে সামনের বিছানায় কিছু যুবক কে দেখলাম তাস খেলতে।
আমি মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম;
বইন ঢাকা কেন যাচ্ছেন; সাথে কোন পুরুষ মানুষ নাই কেন?
সে এবার কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে মুখ খুলল-
বাবুর বাপ ঢাকায় গেছে আমার শাশুড়িকে হাসপাতালের ডাক্তার দেখাতে। ডাক্তার সাব পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কইল.. তারাতাড়ি অপারেশন করা লাগব। আমারে মোবাইল কইরা কইছে মাদবর থেকে গয়নাগাটি বন্ধক রেখে তিরিশ হাজার টাকা সূধের উপরে এনে ঢাকা চলে আসতে। বড়টা ক্লাস থ্রিতে পড়ে, তাকে তার নানির সাথে বাড়ি পাহাড়া দেয়ার জন্য রেখে আসছি। মহিলাটি একটানা বলে ধম ছাড়ল। আমি বললাম টাকার কথা না বল্লেও পারতেন। কিন্তু আপনি হাসপাতাল চিনে যাবেন কিভাবে?
বাবুর বাপ ভোরে সদরঘাট থেকে এসে নিয়ে যাবে।
ঠিক আছে তাহলে আপনি বিশ্রাম নেন।
লঞ্চ চলছে। পাশে বড় ভাই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আমার ঘুম আসছে না। মহিলার বাচ্ছাটি কিছুক্ষণ পর পর হাঁটু দিয়ে হেটে আমাদের বিছানায় চলে আসছে। এতে মহিলাকে বাচ্চাটির প্রতি রাগ দেখাতে দেখলাম। আমাদের সমস্যা যাতে না হয় সেই জন্য বাচ্ছার ঘুমের জন্য ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি বাচ্ছাটির দিকে তাকালাম।সে খুবই উৎফুল্লা। সে হয়ত তার বয়সে রাত বিরাতে এমন বৈদ্যুতিক আলো খুব কম দেখছে বা দেখেনি। এই আলোতে তার দেহ মন, মস্তিষ্কে এই ধরণের ঢেউ সৃষ্টি হচ্ছে সেটি নিবারণ করার জন্য মায়ের হাতের নাগলের বাইরে এসে এদিক সেদিক ছুটে চলে যেতে চায় । চাচা বাচ্ছাটিকে কোলে নিয়ে আদর করে হাতে দু’টি সল্টেজ বিস্কুট দিলেন। আমি বাচ্ছাটিকে তৃপ্তসহকারে বিস্কুট খেতে দেখলাম। কিছুক্ষণ পর চাচার জন্য কেন্টিন থেকে এক বালক খাবার নিয়ে আসল। বালকটি এসে বলল; স্যারে আপনাদের জন্য খাবার পাঠিয়েছে। এতে আমি অবাক ও মনে কৌতূহল জাগল। চাচাকে দেখলাম খাবারগুলো রেখে দিতে। মহিলাকে সাধল খাবার খাওয়ার জন্য কিন্তু মহিলা খাবার খায়নি। চাচা এক প্রকার বাধ্য হয়ে তার পাশে শয়নরত দুই বালক কে ডেকে তুলল খাবার খাওয়ার জন্য। কথা বার্তার ধরণ অনুযায় বুঝলাম তার পরিচিত এবং তার এলাকার হবে। ছেলে দুটি এক প্রকার ভেচাচেকা খেয়ে ঘুমঘুম চোখে খাবার খাওয়ার অফার পেল। তারা কিছুটা বিরক্ত হলেও মুখ ধুয়ে গোগ্রাসে খাবার ভক্ষম করতে লাগল। আমি জিঙ্গেস করলাম; কই যাইবা। তারা জানাল, কালিগঞ্জে জিন্সের প্যান্টের কাজ শিখতে ।
আমি বেশী ক্ষণ জেগে থাকতে পারলাম না।এক সময় চোখে তন্দ্রা এসে গেল। তন্দ্রা ভাঙ্গল ঝাঁকুনি খেয়ে। লঞ্চ চরে উঠে গেছে। ভাইজান বলল;
দেখ কি হইছে?
লঞ্চ চরে ঠেকছে।
সর্বনাশ, সকালে অফিস করুম ক্যামতে!
আমি মনে মনে হাসি আর বলি এবার দোয়া ইউনুস পড়েন। চাচা কে দেখলাম ব্যাগ থেকে দেশী গমের লাল আঠা দিয়ে বানানো রুটি গুড় দিয়ে খেতে। জিঙ্গেস করলাম; ভাত না খেয়ে রুটি খাচ্ছেন কেন? সে বলল; নফল রোজা রাখার নিয়তে খাচ্ছি।
চাইলে ভাত খেয়ে রাখতে পারতেন।
তা অবশ্য পারতাম। কিন্তু মনের খুঁত খুঁতানির জন্য খায়নি।
এবার আমার কৌতূহল আরো বেড়ে যায়। খাওয়া শেষ হলে চাচা কে অনুরোধের সূরে জিঙ্গেস করলাম কাহিনী কি?
চাচা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললেন;
আমার দুই ছেলে এক মেয়ে। দু’জনই অধিক মেধাবী ছিল। মেয়েটাকে বাল্য বয়সেই বিবাহ দেই। বিবাহের পর তাকে যৌতুক দিতে গিয়ে ধার দেনায় ডুবে যাই। ফলে একসাথে দুজনকে লেখা পড়া করার খরচ দেয়া সম্ভব হয়নি। সাথে বাপ মা’কে প্রতিপালন করতে হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে বড়টাকে আমার সাথে কামলা খাটাই। ছোট জনের লেখা পড়া চালিয়ে নেই। মেট্রিক, আইএ পাসের পর যায়গা জমি বেঁচে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াই। ছেলে মাথার ব্রেন ভালো ছিল তাই রেজাল্টও ভালো করতো।এক সময় ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ভালো চাকুরী নেয়। প্রথম প্রথম আমাদের ভালো খোঁজ খবর নিত। পরে ঢাকাতে এক সাবের মেয়েকে বিয়ে করে। তারপর আমাদের দিকে তার নজর কমতে থাকে। আমাদের খরচপাতিও দেয়া বন্ধ করে দেয়। বাধ্য হয়ে বড় ছেলের সংসারে উঠি। বড় ছেলেটার আয় ইনকাম কম। কৃষি কাজ করে আর কত ইনকাম করতে পারে।কিন্তু ছেলে আমাদের হাসিমুখে সব কিছু করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বড় ছেলেটার কষ্ট হয়। তাকে ইঞ্জিনিয়ার বানাতে পাড়লাম না।
আপনি ভাত খাইলেন না কেন?
স্বাভাবিক থাকলে খেতাম। কিন্তু আগামীকাল আমার পিতার পনেরতম মৃত্যু বার্ষিকী। তার আত্মা যেন বেহেস্তে ভালো থাকে সে জন্য রোযা রাখা।এই বিশেষ দিনে যে সব সময় খাওয়ায় তারটা খেয়ে রাখতে চাই। আমি মড়ার পর ছোটটা রোযা রাখবে কিনা জানি না কিন্তু বড়টা রাখবে। সে আমার বাও (ধরণ) পাইছে।
আপনি ঢাকা যাচ্ছেন কেন?
আগামী পরশু দিন নাতনির বিয়ে। আমাকে ফোন করে যেতে বলেছে কিন্তু আমি বলেছি বউ মাকে নিয়ে না আসলে আমি যামু না। তাই সে বউ মা সহ আমাকে নিতে এসেছে। কুয়াশার কারণে ফেরি পাড়াপাড়ে যামেলা হয় বিধায় লঞ্চে আসা যাওয়া করছে। বড় ছেলেটার আসার ইচ্ছা ছিল কিন্তু বিয়েতে আসার জন্য ভালো গরজ দেখায়নি বিধায় আসেনি। বড় ছেলের ঘরে দুই নাতি। তার মধ্যে একজন অনার্স পড়ছে। বাকী একজনের জন্ম থেকে পা কিছুটা বাঁকা এবং খুঁড়িয়ে হাটে, মুখে কথা সামান্য বাঁজে।সে আসার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে, বার বার আমাকে বলেছে কিন্তু বউমা বলল, অনুষ্ঠানে সে থাকলে নাকি তাদের মান ইজ্জত ছোট হবে। তাই আনার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নিয়ে আসিনি।
কিন্তু আপনার ছোট ছেলের খাবার এখানে আসলো কিভাবে?
কিভাবে আবার! সে’ত লঞ্চেই আছে। কেবিনে বউ মা’কে নিয়ে শুয়ে আছে।
আমি একবার চাচার দিকে তাকালাম আরেকবার কেবিনে। তারপর মহিলার বাচ্চার দিকে তাকিয়ে দেখি সে গভীর ঘুমে আছন্ন।ভাই জানের উপর দৃষ্টি পড়তেই সে বলল, ঘুমিয়ে থাক।আমি ঝিম মেরে সদর ঘাটে আসার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম।