আলো নামের মেয়েটি ও একটি স্বপ্ন ভাঙ্গার গল্প

moon

ছবি কৃতজ্ঞতা- আদিবা মেহজাবিন, ক্লিক- তানজিয়া কায়সার

বাবা – মা আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু । কিন্তু মাঝেমাঝে তারা তাদের জেদ রক্ষায় এতোটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা এটাও ভূলে যান । ছেলে মেয়েদের নিজের ইচ্ছে নামক একটি বিষয় থাকতে পারে। এই ব্যাপারটি মাথায় রেখে আজকের এই গল্প।

দেখতে দেখতে ২২ টি বছর কেটে গেল । আজ মেয়ের ২৩তম জন্মদিন । কাজল সাহেব চুপচাপ মেয়ের হাসিমাখা মুখটির দিকে চেয়ে আছেন । বিয়ের ৩ বছর পর তাদের কোল জুড়ে এসেছিল ফুটফুটে একটি মেয়ে । সদ্যজাত কন্যার মুখখানি দেখতেই মেয়ের নাম ঠিক করে ফেললেন “ আলো” । সারাদিন অপেক্ষা করে থাকতেন কবে কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে মেয়ের মুখখানা দেখবে । মেয়েও হয়েছে সে । বাবা ছাড়া কিছু বোঝেনা। এক মেয়ে , এক ছেলে নিয়ে বেশ সুখী পরিবার কাজল সাহেবের ।

আজকের দিনে কাজল সাহেবের মনে পড়ছে মেয়ের সে প্রথম স্কুল যাওয়ার কথা । চুপচাপ বাবার আঙ্গুল ধরে হাঁটছে । একটি কথাও  বলছেনা । এমনিতে তো কত কথাই বলে । ক্লাস এ যাওয়ার সময় বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছিল । চোখে জল ছলছল করছে , মুখে অজানা ভয় । ছুটির ঘণ্টা বাজতেই বাবাকে দেখে দৌড়ে ছুটে আসে আলো । চোখে মুখে খুশির ছাপ । সারাদিন ক্লাস এ কি হল , কয়জন নতুন বন্ধু পেল সবগল্প খুব আগ্রহ নিয়ে বলছে ।

ধীরে ধীরে দুটো ছেলেমেয়ে কবে এত বড় হয়ে গেল সে উত্তর খুঁজতেই ক্লান্ত হয়ে একরাশ হাসি ফুটে উঠে কাজল সাহেবের মুখে । “আলো-আকাশ” দুই ভাই-বোন একে অপরকে ছাড়া কিছুই বোঝেনা । এই তাদের ঝগড়া আবার এই তাদের মিল । আকাশ চঞ্চল প্রকৃতির । একজায়গায় চুপচাপ বসে থাকতে পারেনা সে । আলো গম্ভীর প্রকৃতির , সবার থেকে আলাদা । কখনো এমন ভাবে কথা বলে শুনলে মনে হয় মেয়েটি অনেক বড় হয়ে গেছে । আবার মাঝেমাঝে এমন সব কাজকর্ম করে বসে তখন মনে হয় খুব ছোট একটি শিশু । আলো পড়তে খুব ভালবাসে । পড়াশোনার প্রতি তার খুব আগ্রহ । তার মাথায় সর্বদা একটি জিনিস কাজ করত , সে জীবনে কিছু একটা করবেই যাতে মা-বাবা তাকে নিয়ে গর্ববোধ করতে পারে । কাজল সাহেব মেয়েকে সর্বদা অনুপ্রাণিত করতেন । নিজে টাকার অভাবে কম পড়তে পারলেও মেয়ের ইচ্ছে তিনি পূরণ করবেন । আলো জানতো বাবা তাকে কখনোই আটকাবেনা ।

মাধ্যমিকে আলো দারুন রেজাল্ট করেছে । সবাই খুব খুশি । বিশেষ করে কাজল সাহেব । উচ্চ মাধ্যমিকেও আলো সে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে , মা-বাবাকে হতাশ করেনি । বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর আলোর বড় হওয়ার সপ্ন টা আরো বড় হতে লাগল । বাবা তাকে খুব ভাল একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়েছে । সেও খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করছে । তার ইচ্ছে অনার্সটা শেষ করে সে এম বি টা করে নিবে । আর যদি স্কলারশিপ টা হয়ে যায় তাহলে তো আর কথায় নেই । বাবার মেয়ের ইচ্ছেতে কোন আপত্তি নেই ।

আলোর স্নাতক শেষ হতে মাত্র চার মাস বাকি । সে ইতোমধ্যে স্কলারশিপ এর জন্য চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে । পরের দিন খুব  দরকারি ৩ টা ক্লাস আছে । তারি প্রস্তুতি নিচ্ছে সে । বাবা তার নাম ধরে ডাকতেই সে ছুটে যায় বাবার রুমের দিকে । কাল পাত্রপক্ষ তাকে দেখতে আসবে । কথাটি শুনে কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায় আলো । সে বাবাকে এটাই বোঝানর চেষ্টা করে তারতো এখন বিয়ের কোন ইচ্ছেয় নেই তাহলে এই সব কেন । কিন্তু বাবা তাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে তিনি তার সিদ্ধান্তও পাল্টাটে পারবেনা । আলো আজ নির্বাক । সে এটাই ভাবছে এই কী তার এত বছরের চেনা বাবা । আজ তার চোখের জলটা ও কী বাবার চোখে পড়ছেনা । যথারীতি পরেরদিন পাত্রপক্ষ এলো । আলোকে দেখেই তাদের পছন্দ হয়ে গেলো অতঃপর শুভ সংকেত হিসেবে আংটি দিয়ে গেলেন তারা । সবাই খুব খুশি । এত ভালো ছেলে । কীভাবে হাত ছাড়া করবে তারা । কিন্তু আলো চুপ ।কোন কথা নেই তার মুখে । সে বুঝতে পারছে তার স্বপ্ন ভাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে । সে আরও অবাক হচ্ছে এটা দেখে কেউ একবার তার মতামত নেওয়ার প্রয়োজন টাও অনুভব করছেনা । যে যার মতো তাদের খুশি সামলাতেই ব্যস্ত । কিন্তু সবার কাছে এটা পরিষ্কার আলো ব্যাপারটাতে মোটেও খুশি নয় । আলোর এক চাচা পরে এমন ভাবে তার মত জানতে চায়লো যেন সে না বলতে না পারে ।

আলো সেদিন চুপ থাকলেও সে পরের দিন বাবাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে সে এখন বিয়ের জন্য প্রস্তুত না । বেশ তর্ক চলল বাবা মেয়ের মধ্যে । সে বাবা তার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ব্যবহার করলেন । যাকে ইংরেজিতে বলে “ইমোসনাল ব্ল্যাক মেইল” । আকাশ তার বোনের জন্য খুব কষ্ট পাচ্ছিলো । সে বাবাকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে । কিন্তু কে শুনবে তার কথা । অবশেষে আলোকে না জানিয়ে তার বিয়ের তারিখ ঠিক করা হল । ফাইনাল পরীক্ষার পরপর । এরমধ্যে ছোটোখাট একটি পারিবারিক অনুষ্ঠান হয়ে গেলো ।

আলো তার হবু বরের সাথে কথা বলে এইটুকু বুঝতে পেরেছে তাদের চিন্তা – ভাবনায় বিশাল ফারাক । মেয়েদের ক্যারিয়ার গঠন ব্যাপারটি তার মোটেও পছন্দ নয় । আলোর কিছু কথা পছন্দ না হলেই সে সোজা তার বাবা মাকে নালিশ করত যেটা আলো মোটেও সহ্য করতে পারতোনা । সে বাবাকে অনেকবার বুঝিয়েছে এই ছেলের সাথে সে ভালো থাকতে পারবেনা । কিন্তু কাজল সাহেবের কাছে তার মান – সম্মান টাই বড় । ব্যাপারটা যেহেতু সবাই যেনে গেছে তাই তার এখন কিছুতেই পেছনে ফিরে আসা ঠিক হবেনা । পরে সব ঠিক হয়ে যাবে ।

দেখতে দেখতে বিয়ের তারিখ চলে এলো । বেশ ধূমধাম করে মেয়ের  বিয়ে দিতে পেরে খুব গর্ববোধ হচ্ছে তার । কিন্তু আলোর মুখে সেদিন ও কোন হাসি ছিলোনা । আলোর পুরো মন এখন সংসারে । সে প্রাণ পণে চেষ্টা করছে সবার মনের মতো হয়ে উঠবার । এদিকে মনের সাথে তার প্রতিনিয়ত যুদ্ধ তো চলছেই । সেই যুদ্ধে আলো প্রতিদিন হেরে যায় । যতোই হোক পরের মেয়ে । অল্পও ভূলটাও অনেক বড় আকার ধারণ করে । কিন্তু বাবা আগেই তাকে প্রতিবাদ করতে বারণ করে দিয়েছে । এখানেও যে তার সম্মান জড়িয়ে আছে । শরীরটা বড্ড খারাপ যাচ্ছে আলোর। কিছুই মুখে তুলতে পারছেনা সে । সে ভালোই বুঝতে পেরেছে তার হাতে আর বেশিদিন সময় নেই । …

চোখেরজল মুছতে মুছতে কাজল সাহেবের মনে পড়ছে মেয়ের বলা শেষ কথা গূলো । আলো বাবার কানের কাছে বলছিল “ বাবা , তোমার মেয়েটা আজ সত্যি এই যুদ্ধে হেরে গেলো । কিন্তু তোমার সম্মানের জায়গাতে সামান্য আঘাত লাগতে দেয়নি ।” যদি মেয়েকে তিনি একটু বোঝার চেষ্টা করতেন তাহলে আজ মেয়ের জন্মদিনে মেয়ের ছবি নয় মেয়েটি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকতো ।

লেখিকা- পূজা ধর