আজ আপনাদের শুনাবো এক হীরেকে ঘিরে ঘটে যাওয়া নানা অভিশপ্ত কাহিনী। বিস্ময়কর হলেও ইতিহাসের পাতায় ঘটে যাওয়া সত্যিকার এসব কাহিনীর পুরোটাই একটি হীরেকে কেন্দ্র করে। ইতিহাস হতে যতটুকু জানা যায় , দ্বাদশ শতাব্দীতে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টার জেলার কল্লুর খনিতে পাওয়া যায় এই হীরে। ডিম্বাকৃতির প্রায় ১০৬ ক্যারেটের এই শ্বেত হীরাটি উজ্জ্বলতায় এতটায় কারুকার্যময় যে রাজাবাদশারা এই হীরের জন্যই সবসময় লালায়িত ছিলেন। শুধুমাত্র এই হীরের জন্যই এই পৃথিবীতে ঘটে গেছে রাজায় রাজায় কত যুদ্ধ। হয়েছে কত প্রাণহানি। তাও এই হীরে কারোর অধিকারে আসেনি।
এখন শোনা যাক এই হীরে নিয়ে ঘটে যাওয়া নানা অভিশপ্ত কাহিনী। এই হীরে সম্পর্কিত এক প্রাচীন পুথি হতে জানা যায়, এই হীরে যে ব্যক্তির অধীনে থাকবে, সে পৃথিবী শাসন করবে। কিন্তু পরিণতিতে তার জীবনে নেমে আসবে চূড়ান্ত দুর্ভাগ্য। পুথিতে এও বলা হয় একমাত্র দেবতা বা নারীই এই অভিশাপ থেকে মুক্ত থাকবে।
তবে কি এই হীরে সত্যিই অভিশপ্ত। তাহলে চলুন ইতিহাসের পাতা থেকে দেখে নিই এই হীরেকে কেন্দ্র করে এমন কিছু সত্যিকার ঘটনা যা খুবই মর্মান্তিক এবং নৃশংস।
কাহিনী-১:
এই হীরে প্রথম অধিকারে আসে দক্ষিণের মালওয়া রাজবংশের কাছে। খনি থেকে উত্তোলনের পরই তা মালওয়া রাজবংশের নিকট হস্তান্তরিত হয়। কিন্তু খুব বেশিদিন তা তারা নিজেদের অধিকারে রাখতে পারেনি। পার্শ্ববতী কাকাতিয়া রাজাদের সাথে যুদ্ধে মালওয়া রাজা পরাজিত ও নির্মম ভাবে নিহত হন । আর তখন এই হীরে চলে আসে কাকাতিয়া রাজার অধীনে।
কাহিনী-২:
রত্মটি কাকাতিয়া রাজাদের অধিকারে আসলেও তার স্থায়িত্ব ছিল খুবই অল্পদিনের। রাজধানী বারাঙ্গলের একটি মন্দিরে দেবীর চোখ হিসাবে হীরাটি বসিয়ে কাকাতিয় রাজারা ভেবেছিলেন এই হীরের কেউ সন্ধান পাবে না। কিন্তু ততদিনে এই হীরের সৌন্দর্যতা দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তখন দিল্লীতে খিলজী রাজবংশের শাসনের অবসান ঘটেছে। তুর্কি শাসক গিয়াসউদ্দিন তুঘলক শাহের রাজত্ব শুরু হয়। তিনি এই হীরের বৈচিত্র্যতা জানতে পেরে তা নিজের অধিকার নেয়ার জন্য সচেষ্ট হন। ১৩২৩ সালে তিনি কাকাতিয়া রাজা প্রতাপ রুদ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং প্রতাপ রুদ্রকে পরাজিত করার জন্য তার বিশ্বস্ত এবং চৌকস সেনাপতি উলুগ খানকে পাঠান। উলুগ খানের প্রাথমিক আক্রমন প্রতিহত করা গেলেও কিছুদিন পর কাকাতিয়া রাজ্যের অপ্রস্তুত সৈন্যবাহিনী তার কাছে পরাজিত হয়। রাজা প্রতাপ রুদ্র এই অতর্কিত যুদ্ধে প্রাণ হারান। কাকাতিয়া রাজ্যের রাজধানী বারাঙ্গলে এক মাস পর্যন্ত লুণ্ঠন ও ধ্বংসলীলা চলতে থাকে। কত শত হীরা,মাণিক্য, রৌপ্য, গহনা লুন্ঠন করে তা পাঠানো হয় দিল্লীতে যার মধ্যে ছিল সেই অভিশপ্ত হীরাটি।
কাহিনী-৩:
সময়ের পথ পরিক্রমায় এই হিরের মালিকানা যায় তুর্কি শাসক ইব্রাহিম লোদির হাতে। ১৫২৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ছিলেন দিল্লীর শাসক। এসময় মোঘল সম্রাট বাবর ভারত জয়ের লক্ষ্যে ইব্রাহিম লোদির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। গোয়ালিয়রের রাজা বিক্রমাদিত্য এ যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদির পক্ষ নেন। পানি পথের এই যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদী পরাজিত হন এবং পরে ইব্রাহিম লোদী তাঁর বিশ্বস্ত এক সৈনিকের হাতে খুন হন। এ যদ্ধের পর বাবরের পুত্র হুমায়ুন ইব্রাহিম লোদির প্রাসাদে প্রবেশ করেন। এই প্রাসাদে তখন অবস্থান করছিলেন ইব্রাহিম লোদি ও রাজা বিক্রমাদিত্যের পরিবার। হুমায়ুন প্রসাদে প্রবেশ করে ক্রন্দনরত মহিলাদের আশ্বাস দেন যে, প্রাপ্য মর্যাদা অনুযায়ী তাদের সঙ্গে আচরণ করা হবে। হুমায়ুনের একথা শুনে ইব্রাহিম লোদির মা সোনালী একটি বাঙ হুমায়ুনের হাতে তুলে দেন। হুমায়ুন বাঙটি খুলে একটি হীরা দেখতে পান। এসময় থেকে হীরের অধিকার চলে আসে মোঘল সম্রাটদের হাতে। নিয়তির পরিহাসে দিল্লির সিংহাসনে সুলতানি অধিকার কায়েম থাকেনি। সে কি হিরার অভিশাপে? বিতর্ক থাকতেই পরে। এরপর এই হীরের মুঘলদের হাতে এল। কিন্তু তারা কি সে হীরে নিজেদের নিয়ন্ত্রন রাখতে পেরেছিল, নাকি তাদের জীবনেও নেমে এসেছিল ঘোর অমানিশা। তা আমরা জানতে পারব পরের কাহিনী থেকে।
কাহিনী-৪:
মুঘলদের সময়েও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকল। এই হীরে যখন বাবরের কাছে এলো, বাবর তখন দিল্লীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত। কিন্তু তা খুব বেশীদিনের জন্য নয়। রোগে ভোগে মৃত্যু হয়েছিল বাবরের। এরপর বংশ পরম্পরায় হীরে এবং দিল্লীর মসনদ অধিকারে এলো হুমায়ুনের। কিন্তু দিল্লীর রাজত্ব খুব বেশিদিন ধরে রাখতে পারেন নি। নানা ঘাত প্রতিঘাত এবং প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে গেলেন তাঁর হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য। সারা জীবন যাযাবরের মতো ঘুরতে হল, জীবন কাটাতে হল যুদ্ধক্ষেত্রে। পরবর্তীতে পারস্যের সম্রাট শাহ তামাস্পের সহযোগিতায় দিল্লীর মনসদ ফিরে পান হুমায়ুন। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সম্রাট হুমায়ুন হীরেটি উপহার দেন শাহকে। দিল্লীর মনসদ ফিরে পেলেন কিন্তু হাতছাড়া হয়ে যায় হীরেটি। এপর্যন্ত হীরের অভিশাপটি স্থিমিতই ছিল এবং বলতে গেলে প্রায় মসৃণভাবেই মোঘলরা ভারত রাজত্ব করতে থাকে। হুমায়ুনের মৃত্যুর পর দিল্লীর অধিকার আসে আকবরের কাছে। সম্রাট আকবর এবং তাঁর পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাম্রাজ্যের সময় এই হীরা তাদের কাছে ছিল না। ১৬৫৬ সালে জাহাঙ্গীরের পুত্র সম্রাট শাহজাহান হীরা ব্যবসায়ী মীর জুমলার কাছ থেকে হীরটি উপহার হিসেবে পান। শাহজাহানই কোহিনুর নিয়ে সবচেয়ে বেশি মাতামাতি করেছিলেন। শাহজাহান হীরাটি তার ময়ুর সিংহাসনে ব্যবহার করেন। একশ বছরপর আবার ফিরে আসে হীরের অভিশাপ। শুরু হল মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্বংসের ইতিবৃত্ত। ।শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়লে উত্তরাধিকার প্রশ্নে তাঁর চার পুত্র এক গৃহযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এদের মধ্যে তাঁর এক পুত্র পুত্র আওরঙ্গজেব সকল ভাইকে হারিয়ে দিল্লীর মসনদ দখল করেন। শাহজাহানকে আগ্রার দুর্গে বন্দি করেন এবং দুর্গে বন্দি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। একসময় আওরঙ্গজেব তার রাজধানী লাহোরে কোহিনূর নিয়ে যান এবং তার ব্যক্তিগত বাদশাহী মসজিদে তা স্থাপন করেন। ঔরঙ্গজেবের সময়ে মোঘল সাম্রাজ্য ধ্বংস হতে থাকে।
কাহিনী-৫:
মোগল সাম্রাজ্য যখন বিক্ষিপ্ত ও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে তখন নাদির শাহকে আমন্ত্রণ জানানো হয় মুসলিম শাসনের গৌরবোজ্জ্বল দিন ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করতে। কিন্তু তাকে প্রতিশ্রুত অর্থ না দিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হয়। পারস্যের নাদির শাহ ভারত আক্রমন করে লুঠ করে নেন ময়ূর সিংহাসন সহ এই কোহিনুর হীরা। কিন্তু বেশিদিন ভাগ্যে সইল না তাঁর। ১৭৪৭ সালের ১৯ জুন পারস্য সম্রাট নাদির শাহ ঘুমন্ত অবস্থায় গুপ্তঘাতকের হাতে প্রাণ হারান।
কাহিনী-৬:
নাদির শাহ্র আফগান জেনারেল আহমেদ শাহ দুররানী কৌশলে হীরাটি নিজের অধিকারে নেন। পরবর্তীতে আফগানিস্তানের শাসক সুজা শাহ দুররানির কাছে হীরার অধিকারে আসে। ১৮৩০ সালে আফগানিস্তানের পরাজিত বাদশাহ আহমেদ শাহের নিকট পরাজিত হয়ে শাহ সুজা কোহিনূর নিয়ে লাহারে পালিয়ে আসেন। হীরের অভিশাপ হতে দুররানির পরিবারও রক্ষা পায়নি।
কাহিনী-৭:
শাহ সুজা হীরাটি পাঞ্জাবের শিখ মহারাজা রনজিৎ সিংয়ের কাছে অর্পণ করেন। বিনিময়ে রনজিৎ সিং শাহ সুজাকে আফগানিস্তানের সিংহাসন পুনরুদ্ধার করে দেন। রনজিৎ সিং জানতেন এই হিরের অভিশাপের কথা। তাই তিনি এই হিরে উৎসর্গ করেন জগন্নাথ মন্দিরকে। কিন্তু নিয়তি বড় নির্মম। দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধে মৃত্যু বরণ করেন রনজিৎ সিং। জগন্নাথের শিরোভূষণ হওয়ার আগেই কোহিনূর ওঠে ব্রিটিশদের হাতে।
কাহিনী-৮:
ব্রিটিশদের হাতে পরাজিত হয়ে রনজিৎ সিংয়ের নাবালক পুত্র দিলীপ সিংয়ের হাত থেকে কেড়ে নেয় হীরাটি। এইভাবে এই উপমহাদেশের কাছ হতে হাতছাড়া হয়ে যায় তাদের অন্যতম মহামূল্যবান সম্পদটি। লর্ড ডালহৌসি ১৮৫০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে মহারানী ভিক্টোরিয়ার হাতে তুলে দেন হীরাটি। ‘এইচএমএস মেদেয়া’ নামের যে জাহাজটিতে করে হীরাটি ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়েছিল সেটিও বেশ কিছু দুর্যোগের মুখোমুখি পড়েছিল। যাত্রাপথে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে জাহাজের সেকেন্ড ইন কমান্ড এফ এম লরেন্সসহ পাঁচজন মৃত্যুবরণ করেছিল।
অনেকেই হয়তো এই কাহিনী শুনতে শুনতে হীরের নামটি জেনে গেছেন। ‘কোহিনুর’ নামের ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত এই হীরকখন্ডটি যখনই কোনো পুরুষ ধারণ করেছে, সেই ধ্বংস হয়ে গেছে। কেবল নারীদের বেলায় এটি ব্যতিক্রম। নারীরা বরাবরই এর অভিশাপ থেকে বেঁচে গেছেন। ব্রিটিশ রাজপরিবারের কোনো সদস্যই এই হীরাটি তাদের কাছে রাখেননি। বরাবরই এটি রানীদের দখলে ছিল। কিন্তু আসলে কি তাই? ডায়ানার মৃত্যু, ইংল্যান্ডের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসা কিসের ইঙ্গিত দেয়….।