মৃত্যু মানব জীবনের অবধারিত শেষ সত্য। ‘জন্মিলে মরিতে হইবে’ চিরন্তন এই বাক্যটি সকলের জন্যই প্রযোজ্য। অথচ কোন মানুষই এই সত্যটি মানতে চায় না । আবার এই মৃত্যু ভয়ই মানুষের বড় ভয়। মৃত্যুকালীন সময়ে মানুষ নানা অদ্ভুত আচারন করে থাকে যার ব্যাখ্যা করা এক জন জীবিত মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, প্রত্যেক মানুষেই তার চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণের ভিন্নতার কারণে এমন অদ্ভুত আচরণ করে থাকে। কখনো কি আমরা ভাবতে পেরেছি ঠিক সম্মুখে যখন মৃত্যু দাঁড়িয়ে থাকবে কী বলবো আমরা? অথবা কী করবো? মৃত্যুর সময় মানুষের আচরণ সত্যিই বিস্ময়কর, কখনো বা কল্পনাতীত। প্রকৃতিগত ভিন্নতার কারনেই মানুষের মৃত্যুকালীন শেষ ইচ্ছাও হয় ভিন্নরকম। দুনিয়ার এমনই কয়েক বিখ্যাত মানুষদের শেষ কথাগুলো অনেক সময়ই যেমন দারুণ প্রেরণাদায়ক, কিছু যেমন মজার এবং আবার কিছু রয়েছে শেষ সময়ের পাগলামো। বিশ্বের এমনি কয়েক স্বনামধন্য ব্যক্তির মৃত্যুকালীন কিছু অদ্ভুত, মজার এবং পাগলামীপূর্ণ আচরণ ও শেষ ইচ্ছের কথা জানাব আপনাদের।
১. উইলিয়াম শেকসপীয়র
উইলিয়াম শেকসপিয়র ছিলেন ইংরেজী ভাষার একজন সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক এবং বিশ্বের একজন অগ্রণী নাট্যকার। তাঁকে ইংল্যান্ডের “জাতীয় কবি” এবং “বার্ড অফ অ্যাভন” নামেও অভিহিত করা হয়। মৃত্যুর আগে তারঁ মনে এক অদ্ভুত খেয়াল জন্মালো যে তিনি তার বিছানাটি স্ত্রীকে দেবেন। নিজের ইচ্ছাপত্রে শেকসপীয়র জানান যে তিনি চান তার স্ত্রী অ্যানা হ্যাথাওয়ে তার দ্বিতীয় সেরা বিছানাটি পাক। এটা অদ্ভুত মনে হলেও যতটুকু জানা যায়, শেকসপীয়রের খাটটির কারুকাজ ও দামের দিক দিয়ে সেসময়ে বেশ মূল্যবানই ছিল। অবশ্য শেকসপীয়রের কবরের ফলকে লেখা তাঁর শেষ কথাগুলো পড়লে মনে হবে যেন, নিজেকে আর নিজের সেরা বিছানাকে অন্যের হাত থেকে রক্ষা করতে চেয়েছেন।
২. বব মার্লে
তৃতীয় বিশ্বের এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের নাম ‘বব মার্লে’ । গানের জগতে তাঁর নাম শোনেনি এমন ব্যক্তি পাওয়া দুষ্কর। তাঁর গানে তিনি অধিকার বঞ্চিত মানুষদের কথা বলেছেন সবসময়। Contemporary reggae মিউজিকের এর জনক বলা হয় তাঁকে। মৃত্যুর শেষ দিনগুলোতে তিনি চেয়েছিলেন তার প্রিয় জন্মভূমি জ্যামাইকাতে কাটাতে। শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য তাঁক জ্যামাইকার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু শরীরের নাজুক অবস্থার কারনে পথেই তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে বব মার্লের বয়স ছিল মাত্র ছত্রিশ বছর। পুত্র জিগি মার্লেকে উদ্দেশ্য করে তার শেষ কথাগুলো ছিলো, ‘অর্থ জীবন কিনতে পারে না’।
৩. ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩২তম প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডেলানো রুজভেল্ট। দীর্ঘ ১২ বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতিসংঘ সৃষ্টিতে রয়েছে তাঁর অনন্যসাধারণ অবদান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে উইনস্টন চার্চিল এবং যোসেফ স্ট্যালিনের মতো বিশ্ব নেতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে মিত্রবাহিনীর পক্ষে কাজ করেন। প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন কোন এক সময় ফ্রান্সের এক রাষ্ট্রদূত তাঁকে কিং লুইস ১৬এর একটি ৪০৮ টি হীরে লাগানো পোট্রেট উপহার হিসেবে প্রদান করেন। ফ্রাঙ্কলিন জানতেন যে তার মৃত্যুর পর সেই পোট্রেট ও এর হীরেগুলো তার মেয়ে সারা পাবে। তাই তাঁর মেয়ে সারা যাতে সেগুলোকে খুলে নিয়ে গহনা না বানায় সেজন্যেই রুজভেল্ট তাঁর মেয়ের উদ্দেশ্যে একটি ইচ্ছেপত্র লিখে যান, তাতে লেখা ছিলো যে সারা যেন অহেতুক অতিরিক্ত গহনা পরিধান না করে।
৪. চার্লস ডিকেন্স
ক্রিসমাস ক্যারল, অলিভার টুইস্টের, গ্রেট এক্সপেকটেশন,হার্ড টাইমস এবং ডেভিড কপারফিল্ড-এর মত অসংখ্য জনপ্রিয় উপন্যাসের স্রস্টা, সাহিত্য প্রতিভা চার্লস ডিকেন্স মৃত্যকালনি তার শেষ ইচ্ছের কথা জানিয়ে যান একটি উইলের মাধ্যমে। উইলে তিনি জানান, ‘আমার মৃত্যুর পর যেসব ব্যক্তি আমার স্মরণ সভায় উপস্থিত হবেন তাদেরকে শোক প্রকাশের জন্য কালো বস্ত্র, স্কার্ফ পরিধান করে আসার কোন প্রয়োজন নেই। এসব অর্থহীন ও বিরুক্তিকর পোশাক পড়ে মৃত ডিকেন্সকে শেষ সম্মান জানানোর কোন অর্থ নেই।’
৬. জন লেনন
জন উইন্সটন ওনো লেনন ছিলেন একজন ইংরেজ গীতিকার, গায়ক, সুরকার, চিত্রশিল্পী ও লেখক। তিনি বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বেশ কিছু কাজও করেছেন। জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘দ্য বিটলস’ এর প্রতিষ্ঠাতা তিনি। মানব ধর্মে বিশ্বাসী লেনন ছিলেন একজন আলোকিত মানুষ-যিনি বিশ্বাস করতেন: স্বর্গ-নরকে বিশ্বাস অমূলক, মানুষকে বাঁচতে হবে বর্তমানে আর যুদ্ধ করা অনুচিত, কেননা, মানুষের প্রয়োজন কেবলি ভালোবাসা। পরবর্তীতে এই বিশ্বাসই লেননের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মাত্র ৪০ বছর বয়সে, ১৯৮০ সালের ৮ ডিসেম্বর বিটলস সংগীতগোষ্ঠীর এক অন্ধ ভক্তের গুলিতে নিহত হন লেনন। মৃত্যুকালীন তাঁর শেষ কথা ছিলো অভিযোগ এবং দাবির মতো, ‘আমাকে গুলি করা হয়েছে’। তিনি কতোটা আতঙ্কিত ছিলেন, তার শেষ বাক্য থেকেই স্পষ্ট।
৬. জর্জ বার্নাড শ
জর্জ বার্নার্ড শ’ ছিলেন একজন আইরিশ নাট্যকার এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের সহপ্রতিষ্ঠাতা। তার লেখালেখির শুরু সংগীত সাংবাদিকতা ও সাহিত্য সমালোচনা দিয়ে। কিন্তু তার প্রতিভার সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটে নাটকে, তিনি ’৬০-এর অধিক নাটক রচনা করেছেন। এছাড়াও বার্নাড শ’ ছিলেন একাধারে প্রাবন্ধিক, উপন্যাসিক এবং ছোট গল্পকার। তিনি ১৯২৫ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। তার মৃত্যুকালীন শেষ ইচ্ছে ছিল তার মৃত্যুর পর কোন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা নেই। এমনকি তার সমাধিপ্রস্তরে কোন ক্রস চিহ্ন বা এ জাতীয় নির্যাতনের কোন প্রতীক যাতে শোভা না পায়।
৭. ভার্জিল
ভার্জিল, পুরো নাম পুয়েবলিয়াস ভের্গিলেউস মারো, বর্তমান ইতালির মান্তুয়া সীমান্তে জন্ম নেন। তার রচিত মহাকাব্য ‘ঈনিড’ হয়ে ওঠে রোম সাম্রাজ্যের জাতীয় মহাকাব্য। ভার্জিলের কাব্যের ঐতিহাসিক তাৎপর্য রোমানদের জাতিগঠনে দৃঢ় ভূমিকা রেখেছিল। এছাড়া তাঁর কাব্যে এক মহামানবের আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল; যার সঙ্গে পরবর্তীকালে যিশুর আগমনকে মিলিয়ে দেখা হয়েছে। ফলে অনাগত কালের জন্য ‘ঈনিড’ হয়ে ওঠে মহামুক্তির প্রামাণ্য গ্রন্থ। কিন্তু অদ্ভুত হলেও সত্য, এই বিখ্যাত মানুষটির শেষ ইচ্ছে ছিল তার অন্যতম অমর সৃষ্টি ‘ঈনিড’কে পুড়িয়ে ফেলা। তার মনে হতো যে এই মহাকাব্যটি এখনো অসম্পূর্ণ। ঈনিড সম্পূর্ণ করে যাওয়া তাঁর পক্ষে যেহেতু সম্ভব নয়, তাইে এটি পুড়িয়ে ফেলাই শ্রেয় বলে মনে করেন ভার্জিল। আর তাই অসমাপ্ত কাজকে ধ্বংস করে দিতেই উইলে এমন ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন তিনি।
৮. টি এম জিঙ্ক
আইওয়া রাজ্যের অ্যাটর্নি টি.এম. জিঙ্ক ১৯৩০ সালে মারা যান। মৃতূকালীন সময়ে তিনি একটি উইল করেন। উইলে লেখা ছিল তিনি তার সঞ্চিত অর্থ একটি লাইব্রেরি তৈরিতে ব্যয় হবে। তবে শর্ত হলো এই লাইব্রেরিতে কোন মহিলার প্রবেশাধিকার থাকবে না। এমনকি কোন মহিলা লেখকের সাহিত্যও ঐ লাইব্রেরিতে স্থান পাবে না। আশ্চর্যের বিষয় হলো তিনি তার উইলে তার মেয়ের জন্য ৫ ডলার রেখে যান। তবে সুসংবাদ হলো নারীমুক্ত লাইব্রেরী তৈরী করা যায়নি।
৯. ভলতেয়ার
ফ্রঁসোয়া-মারি আরুয়ে যিনি ছদ্মনাম ভলতেয়ার (Voltaire) নামেই বেশি পরিচিত, ফরাসি আলোকময় যুগের একজন লেখক, প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক। তাঁর বাকচাতুর্য ও দার্শনিক ছলাকলা সুবিদিত। তিনি নাগরিক স্বাধীনতার স্বপক্ষে, বিশেষত ধর্মের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের অধিকারের পক্ষে অবস্থান নেয়ার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তিনি ফ্রান্সের কঠোর সেন্সর আইন উপেক্ষা করে সামাজিক সংস্কারের অন্যতম প্রবক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। খ্রিস্টান গির্জা ও তৎকালীন ফরাসি সামাজিক আচার ছিল তার ব্যঙ্গবিদ্রুপের লক্ষ্য। মৃত্যুকালীন সময়ে ভলতেয়ার মোটেও ঈশ্বরের নাম নেননি। মৃত্যু শয্যায় শায়িত নাস্তিক ভলতেয়ারকে পার্দ্রী যখন ঈশ্বরে বিশ্বাস আনতে এবং ঈশ্বরের কাছে সমর্পনের জন্য বলেন ভলতেয়ার তখন সুবোধ বালকের মতো উত্তর দিয়েছিলেন এই বলে , ‘ওগো ভাল মানুষ, এখন শত্রু বানানোর সময় নয়।’
১০. নস্ট্রাডামাস
মাইকেল ডি নস্ট্রাডামাস, ১৬ শতকের একজন ফরাসী দার্শনিক। তিনি ছিলেন এক জন বিখ্যাত জ্যোতিষী। তিনি তাঁর জীবনে অনেক ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। যার অনেক ঘটনাই পরবর্তীতে মিলে গিয়েছিল। যেমন কেনেডির মৃত্যু, হিটলারের উত্থান, নেপোলিওনের পরাজয়, ৯/১১-তে আমেরিকার টুইন টাওয়ার ভেঙে যাওয়ার ঘটনাগুলো তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে মিলে গিয়েছিলো। ভবিষ্যতদ্রষ্টা নস্ট্রাডামাস নিজের মৃত্যুর আগ মুহূর্তে বলেছিলেন, ‘আগামীকাল, আমি আর এখানে থাকবো না।’
প্রকাশ কুমার নাথ । পেশায় কম্পিউটার প্রোগ্রামার । ভালো লাগে বই পড়তে আর নানান দেশের খবর সংগ্রহ করতে। এছাড়া গান শুনার নেশা তো রয়েছেই । ইচ্ছে আছে বই লেখার । কালি, কলম আর মগজাস্ত্র এক সুরে বাঁধার অপেক্ষায় আছি ।