একটি কঠিন এবং অপরিচিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে, অনেকে সেটাই করেছেন যা তাদের করা দরকার ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠার জন্য।নারীরা, বিশেষত, দেশে বিদেশে যুদ্ধের প্রচেষ্টাকে সমর্থন যোগাতে সক্ষম ছিলেন, এমনকি কখনও গোয়েন্দা হিসেবেও কাজ করেছেন।
কিন্তু কেউই নিজেকে সঁপে দেয়নি তার মেয়েলী কৌশলকে ব্যবহার করে শত্রুপক্ষের ছাউনি পার করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জোগাড় করার জন্যে। যেমনটি করেছিলেন, “ফ্লামবয়ান্টি” বা “মার্গারিটা জেলে”, যিনি “মাতা হারি” নামেই সুপরিচিত ছিলেন।
নেদারল্যান্ডের একটি সম্ভ্রান্ত দম্পতি এডাম জেলে এবং আন্তজে ভেন ডের মুলান এর ঘরে তার জন্ম। তার বাবা ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী; তেলে লাভজনক বিনোয়োগ তাকে তার সন্তানদের সর্বাধুনিক স্কুলে পাঠাতে সক্ষম করে তোলে, এমনই একটা স্কুলে মার্গারিটা ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত কাটিয়েছিলেন। ১৮৮৯ সালে, যখন তার বাবার দেউলিয়া অবস্থা হয়, তখন তার বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায় এবং দুঃখজনকভাবে, এর দুইবছর পর তার মা মারা যান। ১৮৯৩ সালে তার বাবা পুনরায় বিয়ে করলেও পরিবারটি আর কখনও একসাথে থাকেনি।
মার্গারিটা তার ধর্মপিতার সাথে চলে যান।তিনি দক্ষিন হল্যান্ডের একটি ডাচ প্রদেশ লেইডেনের একটি স্কুলে ভর্তি হন এবং পড়ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষিকা হওয়ার জন্যে। যাহোক, প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়ার কারণে তার ধর্মপিতা তাকে স্কুল থেকে বের করে দেন। এরপর তিনি ধর্মপিতার ওখান থেকে পালিয়ে হেগ শহরে চাচার কাছে থাকতে চলে আসেন।
মার্গারিটার বয়স যখন ১৮, তিনি ডাচ সামরিক বাহিনীর ক্যাপ্টেন ধনকুব রুডলফ ম্যাকলড এর পত্রিকায় দেয়া একটি বিজ্ঞাপনের সাড়া দেন। যিনি বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছিলেন। ১৮৯৫ সালে, তিনি এবং ক্যাপ্টেন বিয়ে করেন নেদারল্যান্ডে, যা তাকে ডাচ উচ্চ শ্রেণীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।ক্যাপ্টেন জাবা নামক একটা দ্বীপে বাস করছিলেন, এবং দম্পতিটিও সেখানে ফিরে যায়, যেখানে মার্গারিটা দুটো বাচ্চার জন্ম দেন, ১৮৯৭ সালে নরম্যান জন ম্যাকলড এবং ১৮৯৮ সালে লুইস জেন ম্যাকলড।
তিনি তার বিয়েতে সুখী ছিলেন না, কারণ ক্যাপ্টেন ছিল একজন মদ্যপ ইতর, যে স্থানীয় রীতি অনুসারে রক্ষিতা রাখত। মার্গারিটা অস্থায়ীভাবে একজন ডাচ সৈনিকের সাথে চলে যান। এই সময়ে তিনি নাচ এবং ইন্দোনেশীয় প্রথা বিষয়ে পড়াশোনা করেন এবং মঞ্চনাম “মাতা হারি” হিসেবে উঠে আসেন।
ক্যাপ্টেন ওয়াদা করেছিল সে বদলাবে যদি মার্গারিটা তার কাছে ফিরে আসে, কিন্তু শীঘ্রই সে পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়।
১৮৯৯ সালে, বাচ্চারা মারাত্মক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।অনেকের বিশ্বাস বাচ্চাদের তাদের বাবার শত্রুরা বিষপান করিয়েছে, যেখানে অন্যরা মনে করত বাচ্চারা সিফিলিসে ভুগছিল, যা তাদের বাবার সাথে সম্পর্কিত, যে মার্গারিটাকে সংক্রামিত করেছিল। ২ বছর বয়সেই নরম্যান জন পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় কিন্তু লুইস জেন অসুস্থতা থেকে বেঁচে ফেরে।
তাদের ছেলের মৃত্যুর পরে দম্পতিটি নেদারল্যান্ড এ ফিরে যায়। ১৯০২সালের আগস্ট মাসে মার্গারিটা এবং ক্যাপ্টেন আনুষ্ঠানিকভাবে আলাদা হয়ে যায় এবং ১৯০৬ সালে তাদের তালাক চূড়ান্ত হয়, যেখানে লুইস জেনের দায়িত্ব পান মার্গারিটা।ক্যাপ্টেন কখনও বাচ্চার ভরণপোষণের খরচ দেয়নি যা মার্গারিটার জীবন আরও কঠিন করে তোলে।
মেয়ের সাথে পরিকল্পনা করে বেড়াতে যাওয়ার কোন একটার পরে ম্যাকলড বাচ্চাটিকে তার মায়ের কাছে ফেরত পাঠাতে অস্বীকার করে। নারীদের ঐসময়ে তাদের বাচ্চা পালন বিষয়ে খুব কম আইনই প্রচলিত ছিল এবং মার্গারিটা তার বাচ্চাটিকে ফেরত আনতে সফল হননি। লুইস জেন আর মায়ের কাছে ফিরে আসনি, দুঃখের ব্যাপার, তার বয়স যখন একুশ, সম্ভবত সিফিলিসে ভুগে মারা যায়।মার্গারিটা ১৯০৩ সালে প্যারিস চলে যান এবং একটি সার্কাসে নারী ঘোড়সওয়ার এবং একজন শিল্পীর মডেল হিসেবে কাজ করেছিলেন। তিনি প্রথমত তার বৈবাহিক নাম ব্যবহার করতেন, অনেকটাই তার শশুরবাড়ির লোকদের কষ্ট দিতে। দুইবছরের মধ্যেই নিজের পেশাগত নাম করেন “এগজটিক ডান্সার” হিসেবে।
নিজের মেধাকে কাজে লাগিয়ে দর্শকদের মোহিত করতে তিনি ছিলেন পারদর্শী এবং তিনি “মাতা হারি” ব্যক্তিত্বকে খুঁজে পান যিনি ছিলেন একজন হিন্দু রাজকন্যা এবং শৈশব থেকেই পবিত্র হিন্দু নৃত্য পদ্ধতির সাথে যুক্ত ছিলেন। মার্গারিটা শীঘ্রই ধনকুব এমিলি এটিনি গুইমেট এর বন্ধু বনে যান, মুজি গুইমেট এর মালিক, যেখানে তিনি ১৯০৫ সালে প্রথম নাচ করেন। তিনি স্থিরচিত্রের জন্য অঙ্গভঙ্গি করতেন, কখনও প্রায় নগ্ন অবস্থায় অথবা দেহ মোজায় আবিষ্ট থাকত যাতে তাকে নগ্ন দেখাত। পূর্ব এশিয়ান গয়না পরিধানে তার বিশেষ ঝোঁক ছিল, বিশেষ করে তার নিজের পরিচিতি মাথার গয়না এবং মুক্তাখচিত ব্রা।
তার নাচের ধরণ তৎকালীন প্যারিসে বেশ নাম করেছিল। ধনী সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতা এবং মুক্ত চিন্তা দিয়ে এগজটিক ডান্সিংকে আরো সম্মানজনক বানাতে তিনি সাহায্য করেছেন। তিনি নিজের সাথে মিলিটারি অফিসার এবং উচ্চপদস্থ রাজনৈতিক সদস্যবৃন্দের সম্পর্কের কথা প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক সীমানা স্বাধীনভাবে পার করতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে তার জীবনধারা, মঞ্চে তার ভাবমূর্তিকে শক্তি জোগাত। তিনি পুরো ইউরোপে তখনও সম্পর্ক বজায় রাখছিলেন, কিন্তু জনগণের অসমর্থন এবং নিজের বুড়িয়ে যাওয়া দেহের দরুণ তাকে অন্তিমবার মঞ্চে দেখা যায় ১৯১৫ সালে।
মার্গারিটা শীঘ্রই ক্যাপ্টেম ভাদিম মাস্লোভ এর সাথে জড়িয়ে পড়েন, যিনি ছিলেন রাশিয়ান সামরিক বাহিনীতে সেবারত একজন রাশিয়ান পাইলট। মাস্লোভ যখন গুলি খেয়ে আহত হন, ফ্রান্সের এক্সটারনাল মিলিটারি ইন্টিলিজেন্স এজেন্সি, দ্য ডিএক্সিম ভিউরো থেকে গুপ্তচর হওয়ার শর্তে মাস্লোভের সাথে দেখা ককরার অনুমতি পান তার ঐ পরিস্থিতিতে। জার্মানির ক্রাউন প্রিন্স উইলহেম এর জন্য নৃত্য প্রদর্শনী ফ্রান্স ক্যাপ্টেন কে ভাবতে বাধ্য করে যে, মার্গারিটা ভুলিয়ে ভালিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক তথ্য হাসিল করতে পারবে।
কিন্তু ফ্রান্সের জানা ছিল না, ক্রাউন প্রিন্স একজন নষ্ট ফূর্তিবাজ ছাড়া আর কিছু ছিল না, যার সামরিক বিষয়ে জ্ঞান সামান্যই ছিল।
ফ্রান্স ইন্টিলিজেন্স এর তথ্য হস্তান্তর করার কথা বলে মার্গারিটা ক্রাউন প্রিন্সের সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে। যখন জেনারেল ওয়ালটার নিকোলাই, জার্মান আর্মির প্রধান ইন্টিলিজেন্স অফিসার, বুঝতে পারলেন যে মার্গারিটার কাছে গালগল্প ছাড়া বলবার কিছুই নেই তখন তিনি তাকে গুপ্তচর বলে অভিযুক্ত করেন।
১৯১৭ সালে মার্গারিটা প্যারিসে গ্রেফতার হন। তার সাথে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে জার্মান চেক পাওয়ার অভিযোগ আনা হয় এবং তাকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়।
জার্মানদের জন্য গুপ্তচরবৃত্তির জন্য অভিযুক্ত করা হয় এবং ৫০ হাজার সিপাহীর মৃত্যুর জন্য তাকেই দায়ী করা হয়। তিনি তার নির্দোষভাব বজায় রেখেছিলেন, দাবি করেন এটা তার কাজ ছিল যা তাকে অন্য দেশে নিয়ে যেত, যেটা জার্মান সরকারের পক্ষে কোন কার্যক্রম ছিল না। মার্গারিটার মাতা হারি ব্যক্তিত্ব মিথ্যা হিসেবে প্রকাশ হওয়া তাকে আরো অসৎ হিসেবে পরিবেশন করে। মাস্লোভ তাকে বর্জন করে এবং তার পক্ষে সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করে।
সম্প্রতি ইতিহাসবেত্তা জুলি হুইলরাইট দাবি করেন, “সে আসলে কোন কিছুই পাচার করেনি যা আপনারা স্পেনের স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে পাবেন না, (মার্গারিটা) ছিলেন একজন স্বাধীন নারী, একজন বিধবা, একটি নিরপেক্ষ দেশের নাগরিক, একজন যৌনকর্মী, এবং একজন নর্তকী যা তাকে নিঁখুত বলির পাঁঠা বানায় ফ্রান্সের জন্য, যারা তখন যুদ্ধটা হেরেই যাচ্ছিল। সে আসলে একটি নজির তৈরী করেছে যে, কি হতে পারে যদি আপনার নৈতিকতা দূর্বল হয়।”
৪১ বছর বয়সে, তার ঘাতকদের তিনি বিদায়ী সম্ভাষণ হিসেবে ফ্লাইং কিস দেন। তিনি চোখ বাঁধতে অস্বীকৃতি জানান। এরপরই তাকে একাধিকবার গুলি করে একটি ফায়ারিং স্কোয়াড। তারিখটা ছিল, ১৫ই অক্টোবর ১৯১৭।
তার মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য একজন অফিসার তার মাথায় গুলি করে। তার দেহ প্যারিসের দেহতত্ত্ব জাদুঘরে দান করা হয়। কারণ তার পরিবারের কেউ তা দাবি করেনি, এরপর থেকে এটা যেন গায়েব হয়ে গেছে।
বছরের পর বছর হলিউড, থিয়েটার এবং আধুনিক লেখকেরা মাতা হারিকে উপস্থাপন করেছেন একজন ধূর্ত নারী ব্যক্তিত্ব হিসেবে। সম্ভবত বাস্তবে তিনি যা ছিলেন তা থেকে বহু দূরে এই প্রতিকৃতির অবস্থান।
অক্টোবর ২০১৭ তে মার্গারিটার বিচারের সিল করা কাগজপত্র প্রকাশ করবে ফ্রান্স এবং অবশেষে মনে হয় অতিপরিচিত এই নারী গুপ্তচরের সত্য সমগ্র পৃথিবীর সামনে উন্মোচিত হতে যাচ্ছে।
লেখাটিঃ Mata Hari- The promiscuous, exotic dancer, courtesan & notorious spy during WWI
এই আর্টিকেল এর বঙ্গানুবাদ।
মাতা হারি সম্পর্কিত একটি ভিডিও: https://www.youtube.com/watch?v=lNqlc8-RRy8