উসমানীয় সালতানাতের যুগ। উসমানীয় সুলতানদের সময়ে বিশ্বের একের পর এক এলাকা পুনরায় মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে আসতে থাকে। উসমানীয় যুগের প্রথম খলীফা/সুলতান ছিলেন উসমান। তার নাম অনুসারে এই বংশের শাসনামলকে উসমানীয় সালতানাত বলা হয়। পশ্চিমে উসমানীয়রা অটোম্যান নামে পরিচিত।
অটোম্যানদের ক্রমাগত শক্তি বৃদ্ধি পশ্চিমা খৃস্ট শক্তির উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তারা বার বার অটোম্যানদের পরাস্ত করতে বল প্রয়োগ করে। বলাই বাহুল্য অটোম্যান বা উসমানীয় শক্তি তাদের সমুচিত জবাব দেয়। এরই প্রাসঙ্গিকতায় ১৩৭১ সালে চেরনোমেনে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এর প্রায় ২৫ বছর পর আরেকটি মহাযুদ্ধ সংগঠিত হয়। উসমানীয় সুলতান বায়োজিদ (The Thunderbolt) সংঘবদ্ধ পশ্চিমা শক্তিকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়েন। ১৪ শতকের শেষের দিকে তুর্কি অটোম্যানরা প্রায় অপরাজেয় হয়ে উঠে। সিনাই পর্বতমালা অপর পাশের ক্যাথলিক খৃষ্টান রাজ্যসমূহ অটোম্যানদের সাম্রাজ্য বিস্তৃতি চিন্তিত হয় উঠে। ইদির্ন, সোফিয়া এবং প্লোভিদের প্রধান এলাকায় সমূহ অটোম্যানদের পদানত হবার পর তারাই সমগ্র প্রাচ্যের অধিকর্তা হয়ে উঠেন। মূলত চেরনোমেন যুদ্ধের পর মেসেডোনিয়ান এলাকা সমূহ অটোম্যান রাজ্যের সামনে উন্মুক্ত হয়ে যায়। বুলেগেরিয়া ক্রীতদাসদের রাজ্যে পরিণত হয়।মিযিয়া দখলে নিতে ভবিতব্য যুদ্ধ পুরো মহাদেশে-বাসীর জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। লুক্সেমবার্গের রাজা সিগিসমুন্ডের নেতৃত্বে হাঙ্গেরি, জার্মানি, ক্রোয়েশিয়ার খৃষ্ট শক্তি অটোম্যান সাম্রাজ্যের অগ্রগতি রুখতে ঐক্যবদ্ধ হয়।
১৩৯৬ সালের প্রথমদিকের কথা। নিকোপলিস শহরের কাছাকাছি তৎকালীন বিশ্বের এই দুই পরাশক্তি এক মহাসমরে উপনীত হয়। বিভিন্ন কারণে এই যুদ্ধ উভয় পক্ষের কাছেই সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যদি অটোম্যানরা জয়ী হয় তাহলে ইউরোপে তাদের অবস্থান দৃঢ় করার এক দুয়ার খুলে যাবে এবং বুলগেরিয়ার জনগণ মূলত তাদের দাসে পরিণত হবে। বুলগেরিয়ান সম্রাট ইভান স্ট্রাজিমির প্রাণ নাশের আশংকাতো আছেই।
উদ্বিগ্ন পশ্চিমা শক্তি অটোম্যানদের রুখতে নানাবিধ পরিকল্পনা গ্রহণ করে। দুই ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে শত বর্ষ ধরে চলতে থাকা যুদ্ধ অবসানে তথা মুসলিমদের নিশ্চিহ্ন করতে ফ্রান্স, বুরগুন্ডি প্রভৃতি দেশ হাঙ্গেরিয়ান সম্রাট সিগিসমুন্ডকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেয়। ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের মধ্যকার চুক্তির কারণে রাজা ষষ্ঠ চার্লস খ্রিস্টবাদের প্রতি তার ভালবাসা জনগণকে বোঝাতে অটোম্যানদের পরাজিত করতে রাজা সিগিসমুন্ডকে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেন।
বুরগুন্ডিয়ার রাজা তার ছেলেকে সসৈন্যে পাঠান অটোম্যানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেডে। ভেনেটিয়া এবং জেনোয়াও অটোম্যানদের সাম্রাজ্য বিস্তার ভাল চোখে দেখে নি। অটোম্যানদের অগ্রযাত্রা রুখতে না পারলে বলকানদের সাথে তাদের ব্যবসা-বানিজ্য ধ্বসে যাওয়ার আশংকায় তারাও ভবিষ্যৎ রোমান সম্রাট সিগিসমুন্ডের সাথে ক্রুসেডে যোগ দেয়। এই যুদ্ধের উপর পুরো মহাদেশ এবং বলকান রাজ্যের স্থিতিশীলতা নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ১৩৯৪ খ্রিষ্টাব্দে নবম পোপ বনিফেস সরকারীভাবে ক্রুসেডারদের জন্য ভাষণ দেন। ভাষণ শেষে ক্রুসেডারদের সফলতার জন্য বিশেষভাবে আশীর্বাদ করেন।
এই ক্রুসেডে কোন পক্ষে কতজন ছিল তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বছরের পর বছর উভয় পক্ষই নানা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। কাজেই তাদের সেনাবাহিনী বিশাল কোন সেনাবাহিনী ছিল না। এছাড়াও ভাড়া করা সৈন্য সংখ্যাও কম ছিল কারণ তাদেরকে পুষতে প্রচুর খরচ হত। আধুনিক ইতিহাসবেত্তাদের মতে, এই ক্রুসেডে খ্রিষ্টানদের পক্ষে ১৫ থেকে ১৭ হাজার সৈন্যের এবং অটোম্যানদের পক্ষে ২০ থেকে ২৫ হাজার সৈন্যের বাহিনী যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
অভিজাত খৃস্টানদের সম্মিলিত বাহিনী তাদের স্ব-মহিমায় অটোম্যানদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হতে থাকে। তাদের অগ্রযাত্রাকে প্রথমদিকে মনেহত কোন বিশাল বাহিনী উৎসব পালনে বের হয়েছে। পথিমধ্যে সমস্ত অঙ্গরাজ্যের শাসকেরা ক্রুসেডারদের স্বাগত জানাতে বিভিন্ন আয়োজন করে ছিলেন। কাজেই দেখা যেত একেক এলাকা পার হয়ে সামনে এগিয়ে যেতে মাস খানেক সময় লেগে যেত। বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা সেনাবাহিনী যখন বুদায় সিগিসমুন্ডের বাহিনীর সাথে মিলিত হল ততদিনে প্রায় তিন মাস পার হয়ে গিয়েছে।
তখন জুলাই মাস, গরম কাল। রাজা সিগিসমুন্ডের পরিকল্পনা ছিল আগেভাগে আক্রমণ না করে অপেক্ষা করা যতদিন না অটোম্যান সেনাবাহিনী বুদয় পৌছায়। কিন্তু তার অন্যান্য পশ্চিমা সাথীরা একে কা-পুরুষোচিত বিবেচনা করলেন। তাদের বয়স ছিল কম। রক্ত ছিল জুলাই মাসের সূর্যের মতই টগবগে। এগিয়ে যেয়ে শত্রুসেনার মোকাবেলা করার জন্য তারা ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছিলেন। অবশেষে সিগিসমুন্ড তাদের জেদের কাছে হার মানেন। ক্রুসেডাররা পুনরায় অগ্রসর হতে থাকে।
দানুব নদী অতিক্রম করে ক্রুসেডাররা একসময় বুলগেরিয়ার ভিডিন শহরে পৌছায়। বুলগেরিয়ার রাজা অটোম্যান সাম্রাজ্যের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে দ্রুতই ক্রুসেডারদের সাথে সমঝোতা করেন। তিনি আশা করেছিলেন এর ফলে বুলগেরিয়ার অটোম্যানদের প্রতি দীর্ঘদিনের দাসত্বের অবসান হবে। সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখে ক্রুসেডাররা নিকোপলিসের দুর্গে পৌছায়। কিন্তু দুর্গ দখল করার মত সরঞ্জাম না থাকায় তারা দুর্গের চারপাশে অবস্থান নেয়। যেন প্রয়োজনীয় খাদ্য, পানি শেষ হয়ে যাবার পর দুর্গে অবস্থানরতরা আত্মসমর্পনে বাধ্য হয়। কিন্তু কিছুদিন পরেই তারা সুলতান বায়োজিদের ক্রম অগ্রসরমাণ সেনাবাহিনীর খবর পান। বোঝাই যাচ্ছিল এই যুদ্ধে পুরো এলাকা রক্তে ভেসে যাবে।
ফরাসী সেনাবাহিনী নেতৃত্বে থাকা নাইটরা বরাবরের মতই অপেক্ষা করার বিরোধিতা করলেন। যুদ্ধজয়ের গৌরবে গৌরবান্বিত হবার নেশায় অন্ধ এসব অল্পবয়স্ক, অনভিজ্ঞ নাইটরা অটোম্যানদের মূলত অসভ্য মনে করতেন। অসভ্যদের সাথে যুদ্ধে আবার অপেক্ষাকিসের? তাদের মতে অটোম্যানরা তাদের সাথে লড়াই করার যোগ্যতাই রাখে না। এসব অসভ্য অটোম্যানরা সুসজ্জিত নাইটদের দেখেই ময়দান ছেড়ে পালাবে!
কাজেই আমরা বলতে পারি অপরিপক্ব নাইটদের এহেন বাচ্চা সুলভ কর্মকাণ্ডই ক্রুসেডে তাদের চরম পরাজয়ের জন্য অনেকাংশে দায়ী। নিজেদের জয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত ক্রুসেডাররা মূলত এই যুদ্ধকে “যুদ্ধ” হিসেবেই নেয়নি। ভেবেছিল শিকারে যাচ্ছি, শিকার শেষে শত্রুর খণ্ডিত মস্তক শরবিদ্ধ করে বীরের বেশে বাড়িতে ফিরে আসব।
১৩৯৬ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর। দুই পরাশক্তি মুখোমুখি অবস্থানে। ক্রুসেডারদের বাহিনী মধ্যভাগে ছিল নাইটরা। তাদের দু’পাশে অশ্বারোহী সৈন্যের সমাবেশ। ক্রুসেডাররা তাদের আজীবনের শত্রুদের মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত। অটোম্যানদের সৈন্যদের ছিল ভিন্ন বেশ। সেনাদের প্রথমভাগে ছিল পদাতিক সৈন্য, তাদের পিছনেই ছিল রুমেলিয়ান অশ্বারোহী বাহিনী। আর দু’পাশে আনাতোলিয়ান অশ্বারোহী যোদ্ধারা অবস্থান নিয়েছিল।
বিচক্ষণ সুলতান বায়োজিদ ধারণা করেছিলেন যে, ক্রুসেডার বাহিনীর নাইটরা আক্রমণ করার জন্য মুখিয়ে আছে। একারণে তিনি তার বাহিনীকে রক্ষণাত্মক অবস্থানে থাকতে নির্দেশ দেন। তার নির্দেশে ময়দানে লম্বা লম্বা খুঁটি পুতে দেয়া হয় যেন ক্রুসেডাররা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে এগুতে না পারে। তার ধারনাকে সত্য প্রমাণ করে, নাইটরা প্রথমে আক্রমণে উদ্যত হয়। তাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, কাছাকাছি আসার আগ পর্যন্ত তারা খুঁটিগুলো দেখতে পায়নি এবং বাধ্য হয়ে ঘোড়া থেকে নেমে পায়দল চলতে থাকে। অটোম্যানদের পদাতিক বাহিনী তাদের সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করে। এরই মধ্যে ক্রুসেডারদের হতভম্ব করে দিয়ে পদাতিক বাহিনীর পিছন থেকে অশ্বারোহী যোদ্ধারা বেরিয়ে আসে।
এরপরের ঘটনা খুবই সরল। ক্রুসেডাররা অটোম্যান বাহিনীর হাতে কচুকাটা হয়। নেতৃস্থানীয়দের মুক্তিপণের জন্য জিম্মি করা হয়। যারা মুক্তিপণ যোগাড় করতে পারে নি তাদের হত্যা করা হয়।
অশ্বারোহী সৈন্যরা হাঙ্গেরিয়ানদের পিছু ধাওয়া করে। হাঙ্গেরিয়ানদের মিত্র ভ্লাচরা ততোক্ষণে তাদের ফেলেই পালিয়েছে। হাঙ্গেরীর রাজা সিগিসমুন্ড কাছের শহরে পালিয়ে যান। সেখান থেকে ভেনেটিয়ান জাহাজে করে কোন রকমে পালিয়ে বাঁচেন। অভিভাবকহীন অবস্থায় হাঙ্গেরীর সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে। এদের মধ্যে অভিজাতদের মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া হয়। বাকিদের ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়। পালাতে যেয়ে কেউ কেউ দা নদীতে ডুবে মরে। কেউবা বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় মারা যায়। অল্প কিছু লোক প্রাণ নিয়ে নিজ দেশে ফিরতে সমর্থ হয়।
রাজা সিগিসমুন্ড জাহাজে চেপে প্রাণ নিয়েই বাড়ি ফিরতে পেরেছিলেন। রাজা চার্লস ক্রিসমাসের সময় পরাজয়ের সংবাদ পেলেন। ফরাসী নাইটদের দিবাস্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। বুলগেরিয়ানরা তাদের স্বাধীনতার আশা খুইয়ে ফেলে। ১৩৯৬ সালে যখন তাদের সর্বশেষ রাজা পরাজিত হয় তখন তারা ৫০০ বছরের জন্য দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। অটোম্যানদের অগ্রযাত্রা রোধ করার মত পনের শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত কেউ ছিল না। ১৪০২ সালে তৈমুর লঙ বায়োজিদকে পরাজিত করলে সাময়িকভাবে অটোম্যান সাম্রাজ্যের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়ে। এই সুযোগে বুলগেরিয়ানরা আবারো সংগঠিত হবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ভার্নার যুদ্ধে তাদের আবারও পরাজিত করা হয়।
নিকোপলিসের যুদ্ধে ক্রুসেডারদের পরাজয় অটোম্যানদের সামনে সিনাই পর্বতমালার মধ্যদিয়ে ইউরোপের কেন্দ্রে পৌঁছাবার একটি সুযোগ এনে দেয়। ১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিপোল জয়ের পর অটোম্যান সাম্রাজ্য ইউরোপের জন্য সবচাইতে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি পরবর্তী ৫০ বছরের মধ্যে পশ্চিমারা অটোম্যানদের আর ঘাটাতে সাহস করে নি।