সত্য সময়ের কন্যা – প্রাচীন প্রবাদ।
এই লাইন পড়ে যদি বইয়ের মধ্যে “কন্যা”টিকে খুঁজতে শুরু করেন, তাহলে ব্যর্থ হবেন। কারণ পুরো বইয়ে এই মেয়েটিকে খুঁজে পাবেন না। কেন, একটু পরেই তা বুঝতে পারবেন।
ডটার অব টাইম বইয়ের ইংরেজি ভার্সনটা যখন যখন প্রথম পড়তে শুরু করেছিলাম, তখন খুবই একঘেঁয়ে লাগছিলো। প্রথম চ্যাপ্টারটা খুব বেশি কাঠখোট্টা, পড়তে গিয়ে যেন আক্ষরিক অর্থেই দাঁত ভেঙে যায়। পরের চ্যাপ্টারগুলো অতটা দাঁতভাঙা না হলেও, খুব একটা প্রাঞ্জলও নয়। বুঝতে হবে, ৭০ বছর আগের ইংলিশ! কিছুটা কঠিন তো হবেই। তারও উপরের কথা হলো, মূল বইটা স্কটিশ ভাষায় লেখা। স্কটিশ থেকে ইংরেজি যিনি অনুবাদ করেছেন, তিনি এক কথায় বলতে গেলে খুবই বাজে অনুবাদ করেছেন। এছাড়াও লেখিকা, মানে জোসেফিন টে (লেখিকার আসল নাম এলিজাবেথ ম্যাকিনটশ। তার মায়ের নাম ছিল জোসেফিন টে। লেখিকা বইটি তার মায়ের নামে লিখেছিলেন) ম্যাডাম বিশাল বিশাল বাক্যে মনের ভাব প্রকাশ করেছেন। বাক্যের এ মাথা পড়ে অন্য মাথায় যেতে যেতে প্রথম মাথায় কী বুঝাতে চেয়েছিলেন, সেটাই ভুলে যাওয়ার জোগাড়!
প্রথমবার পড়ার সময়ে এই বইয়ে প্রথম আগ্রহ পাই, সপ্তম চ্যাপ্টারে গিয়ে। ভাবা যায়? সতেরো চ্যাপ্টারের একটা বইয়ে যদি সপ্তম চ্যাপ্টারে গিয়ে পড়ার আগ্রহ আসে, তাহলে সেটা কেমন হয়? কিন্তু, আমার অনাগ্রহ ওটুকুতেই শেষ। এরপর বইটা পড়ে শেষ করা, মোট সাতবার রি-রিড করার প্রত্যেকটা ধাপে আমি বুঝেছি, ক্ল্যাসিক বই কাকে বলে! যতোবার পড়েছি, ততোবারই নতুন নতুন টুইস্ট আবিস্কার করে চমকে গিয়েছি। আর ভেবেছি, টে ম্যাম কী মুন্সিয়ানাই না দেখিয়েছেন! একেকটা স্টেপ কী অদ্ভুত নিখুঁতভাবেই না ফেলেছেন! চারশ বছরের পুরোনো রাজবংশীয় রহস্য, পা ভেঙে বিছানায় পড়ে থাকা এক পুলিশের মাধ্যমে সমাধান করিয়ে ফেলেছেন!
যতো ভাবি, অবাক হয়ে যাই। মুগ্ধতা যেন কাটেই না। এমনি এমনি তো আর সময়কন্যাকে ক্ল্যাসি রহস্যোপন্যাস বলা হয় না! একেকটা টুইস্ট এমনভাবে এসেছে যে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে বইয়ের পাতায় তাকিয়ে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। বইটা পড়তে শুরু করার আগে পাঠককে জেনে নিতে হবে, ডটার অব টাইম একটি ইতিহাস নির্ভর রহস্যোপন্যাস। ইংল্যান্ডের চারশো বছরের পুরোনো ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে লেখা। প্রথমবার পড়ার সময় আমার বিরক্ত লাগার কারণ হলো, আমি জানতামই না এটা ইতিহাস আশ্রিত।
অ্যালান গ্রান্ট নামের এক পুলিশ, অপরাধী ধরতে গিয়ে পা ভেঙে আহত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছে। সারাদিন দৌড় ঝাঁপ করা মানুষটা বিছানায় শুয়ে থেকে থেকে ত্যক্তবিরক্ত। কোন কিছু করতেই তার ভালো লাগে না। অবসরে সবচেয়ে সহায়ক যেটা, সেই বই পড়তেও না। যেহেতু সে অপরাধীর চেহারা দেখেই চিহ্নিত করতে পারে, তাই তার বান্ধবী তাকে এমন কিছু ছবি এনে দিলো যা রহস্যপূর্ণ। সেসব ছবি থেকে একটা ছবিতে অ্যালানের আগ্রহ জন্মালো। আর সেই ছবির ব্যক্তিত্ব নিয়ে, তার জীবন ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করে, চারশ বছরের পুরোনো রহস্য সমাধান করে অ্যালান।
রহস্য সমাধানের প্রথম ধাপ ছিলো, ছবিটি দেখে ছবির লোকটি সম্পর্কে কার কেমন ধারণা জন্মায়, সেটা জানা। অ্যালানকে হাসপাতালে যত জন দেখতে এসেছে, তাদের সবার মতামত নিয়ে বিশ্লেষণ শুরু করে সে।
এই ছবির মাধ্যমেই সমস্ত রহস্যের সূত্রপাত। এবার আপনারা বলেন তো, ছবির মানুষটিকে দেখে আপনারদের কাছে কী মনে হচ্ছে?
কেমন লোক হতে পারে ইনি?
একজন পুলিশের দৃষ্টিকোণ থেকে জিজ্ঞেস করি। একে আপনি কোথায় বসাবেন?
বিচারকের আসনে?
নাকি কাঠগড়ায়?
একটা উত্তর নিশ্চয়ই মনে মনে ভেবে নিয়েছেন? চলুন এবার বইয়ের কাহিনী সংক্ষেপটুকু পড়ে আসি।
আহত অবস্থায় হাসপাতালে বিছানাবন্দী হয়ে পড়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত স্কটল্যান্ডের ইয়ার্ডের ইন্সপেক্টর অ্যালান গ্র্যান্ট। সে সময় একটা প্রতিকৃতির চেহারার ছবির দিকে বিশেষ নজর পড়ে। মানুষের চেহারার প্রতি গ্র্যান্টের আলাদা একটা মোহ আছে। চেহারা থেকে সে লোকের আচরণ পড়তে জানে। তবে এই বিশেষ ছবিটা তাকে ভুল প্রমাণ করলো। ছবিতে মুখটা দেখে লোকটাকে তার যেমন চরিত্রের মনে হয়েছিল, ছবির পিছনে থাকা নামের সাথে সেসব কিছু যায় না। ইতিহাস লোকটার ব্যাপারে বলছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। ইতিহাস বলছে লোকটা খুবই নৃশংস, দানব প্রকৃতির একজন – কিন্তু ছবি বলছে সম্পূর্ণ উল্টো কথা। শুধু সে ই না, হাসপাতালে তাকে যারা দেখতে এসেছে, তাদের সবাইই ছবির লোকটার ব্যাপারে যে মন্তব্য দিয়েছে – তারসাথে ইতিহাসের কোনো মিলই নেই।
সত্য কি সবসময়ই সত্য থাকে? না সময়ের সাথে সাথে বদলে যায়?
ইতিহাস ঘাটলে অনেক বীর দেখা যায়, অনেক কুখ্যাত ভিলেন চরিত্রও পাওয়া যায়। ইতিহাসে যেভাবে বর্ণনা করা আছে, আমরা তাদের সেভাবেই ধরে নিয়েছি। কিন্তু কখনো কি ভেবেছি, যাদেরকে বীর ভাবছি তারা সত্যিই বীরের মতো কিছু করেছিলো? নাকি ক্ষমতার জোরে তাদের বীর উপাধি দেওয়া হয়েছে?
কিংবা, যারা ভিলেন, খারাপ কাজ করেছে বলে দাবি ইতিহাসের – তারাও কি সত্যিই ওরকম কিছু করেছিলো? নাকি তাদের শত্রুরা ক্ষমতা ব্যবহার করে জোর করে কুখ্যাত বানিয়ে দিয়েছে?
সত্য কি সত্যিই লুকিয়ে রাখা যায়?
ভাবতে গেলে মনে হবে, হ্যাঁ যায়। কিন্তু না। সত্য কখনোই লুকিয়ে রাখা যায় না। যতোই চেষ্টা করা হোক না কেন, সত্য চিরজীবন সত্যই থাকবে।
কারন – সত্য সময়ের কন্যা, ক্ষমতার নয়।
এইটুকু পর্যন্ত পড়ে নিশ্চয়ই ধরেই নিয়েছেন, কাহিনী আপনি ধরে ফেলেছেন। এটা ভেবে থাকলে ভুল করছেন। এই ছোট বইটা যে আপনার জন্য কোন টুইস্ট লুকিয়ে রেখেছে আপনি ভাবতেও পারবেন না!
বই থেকেই কয়েকটা লাইন পড়ে দেখুন-
- অদ্ভুত ব্যাপার! যখন তুমি কাউকে প্রাচীন গল্পের সত্যিকারের তথ্যগুলো উপস্থাপন করবে তখন তারা রুষ্ট হবে।
লেখকের প্রতি নয়। তোমার প্রতি।
লোকে নিজেদের ধারণাকে বিপর্যস্ত করতে চায় না। এই সত্য তাদেরকে একটা অনিশ্চিত অস্বস্তিতে ফেলে। তাই তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করে সত্যকে তারা প্রত্যাখান করে। এই নিয়ে ভাবতেও অনীহা দেখায়। - হালকা ভয় পেলেও লোকের শিরদাঁড়া শিহরিত হয়। কিন্তু বড় ধরণের ক্ষতিতে কারো হৃদয় একটুখানি নড়ে না। চীনে বন্যায় আক্রান্ত হয়ে হাজার খানেক মানুষ ডুবে মরেছে, এটা নিছকই একটা খবর। আর একটা বাচ্চা পুকুরে ডুবে মরেছে, এটা ট্রাজেডি।
- এই পৃথিবীতে প্রচুর পরিমাণে মানুষ জন্মাচ্ছে এবং অনেক অনেক শব্দ লেখা হচ্ছে। ছাপাখানা থেকে প্রতি মিনিটে ঢালাওভাবে মিলিয়ন মিলিয়ন লেখা ছাপা হচ্ছে। এটা খুবই ভয়ঙ্কর চিন্তা।
কথাগুলো কি মিথ্যা? যাচাই করার দায়িত্ব আপনার কাছে …
এক নজরে বই পরিচিতি
বই: দ্য ডটার অব টাইম
লেখক: জোসেফিন টে
রূপান্তর: মাদিহা মৌ
প্রকাশক: রোদেলা প্রকাশনী
প্রকাশকাল: জানুয়ারি, ২০১৮
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ২০০
মূদ্রিত মূল্য: ২৫০ টাকা