শুভ জন্মদিন- দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প

মাধ্যমিকের এক বাংলা বইয়ে একটা গল্প পড়েছিলাম, মাঝসাগরে এক অষ্টাদশী তরুণী ভয়াবহ কালাজ্বরে আক্রান্ত এক জাহাজে নেমে যায়, রোগীদের সেবা করার জন্য। আমার খুব মনে পড়ে, আমি তখন এটা ভেবে অভিভূত হয়েছিলাম যে, মেয়েটা মৃত্যুপথযাত্রী মাত্র তিনজন মানুষকে সেবা করার জন্য নিজের পুরো জীবন উৎসর্গ করছে! কিন্তু তখনো জানতাম না, এরচেয়েও মহান সেবিকা বাস্তবেই পৃথিবীর ইতিহাসে আছেন।

আঠারো শতকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স আর তুরস্ক যুদ্ধ করছিলো। সেসময়ে নিজের গড়ে তোলা সেবাকেন্দ্রের ৩৮ জন সেবিকা নিয়ে মানবদরদী এক মহিলা তুরস্কের যুদ্ধক্ষেত্রে রওনা হলেন যুদ্ধে আহত সৈনিকদের সেবা দেওয়ার জন্য। সেখানকার হাসপাতালগুলো ছিলো নোংরা, অপরিচ্ছন্ন ও অস্বাস্থ্যকর। উপযুক্ত চিকিৎসা না পেয়ে অনেক আহত সৈনিক মারা যাচ্ছিল। সে সময় সামরিক ব্যক্তিদের বাইরে অন্য কেউ যুদ্ধে কাজ করত না, তাই সেই মহিলাকে সবাই অসহযোগিতা করতে লাগল। তবে তিনি সেবা দিয়ে সবার মন জয় করে নিলেন। হাসপাতালের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য রাতদিন পরিশ্রম করতেন তিনি। দিনে কঠোর পরিশ্রম করার পরেও রাতেরবেলা মোমবাতি নিয়ে হাসপাতাল জুড়ে ঘুরে বেড়াতেন। ঘুরে ঘুরে সৈনিকদের যন্ত্রণার কথা জিজ্ঞেস করতেন। দৈনিক গড়ে প্রায় ২০ ঘন্টা কাজ করা এই আইরন লেডিকে তখনকার লোকজন নাম দিয়েছিল ‘দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’

blankক্রিমিয়ার যুদ্ধে যাবার আগে প্রশিক্ষিত নার্সদের সাথে নাইটিঙ্গেল

তাঁর নাম ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। আধুনিক নার্সিং পেশার অগ্রদূত। সেই সাথে একজন লেখক এবং পরিসংখ্যানবিদ।

ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জন্ম ১৮২০ সালের ১২ মে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে। বাবা উইলিয়াম এডওয়ার্ড ও মা ফনি উইলিয়াম। ফ্লোরেন্সরা ছিলেন দুই বোন। ফ্লোরেন্স ছোটবেলা থেকেই প্রতিবেশীদের বাড়ি ঘুরে ঘুরে সুখ-দুঃখের কথা শুনতেন। উচ্চবংশের মেয়ে হলেও তাঁর কোনো অহংকার ছিল না। সতেরো বছর বয়সে নিবেদিতপ্রাণ খ্রিস্টান নাইটিঙ্গেল হৃদয় থেকে অনুভব করেন, ঈশ্বর তাকে মানবতার সেবায় ডাকছেন। তাই তিনি অসুস্থদের সেবা করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পরিবার তাঁর এই ইচ্ছায় বাঁধ সাধে। কিন্তু ফ্লোরেন্সের দৃঢ় মনোভাবের কাছে একসময় পরিবার হার মানে। ১৮৫১ সালে নার্সিং শেখার জন্য তিনি জার্মানির কাইজারওয়ার্থে যান।

১৮৫৩ সালে তাকে লন্ডনের ছোট একটি হাসপাতাল ‘কেয়ার অব সিক জেন্টলওমেন ইনিস্টিটিউট’ পুনর্গঠন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই হাসপাতালটি অসহায় পরিবেশে ভদ্র অসুস্থ মহিলাদের দেখাশোনা করতো। ফ্লোরেন্স চমৎকারভাবে এই দায়িত্ব পালন করেন।

blankনাইটিঙ্গেলের সম্মানে চালু হওয়া ব্রিটিশ ডাকটিকিট

১৮৫৪ সালে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে অবদান রাখার জন্য তাঁকে সম্মাননা দেওয়া হয়। সেই অর্থ তিনি নাইটিঙ্গেল নামের ফান্ডে জমা রাখেন এবং লন্ডনে সেন্ট টমাস হাসপাতালে একটি সেবা প্রতিষ্ঠান চালু করেন।

১৮৫৯ সালে তিনি ‘রয়্যাল স্ট্যাটিসটিক্যাল সোসাইটি’র প্রথম সারির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৮৬০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাইটিঙ্গেল ট্রেনিং স্কুল’ যার বর্তমান নাম ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল স্কুল অব নার্সিং’।

blankনিজের গড়া নার্সিং স্কুলের সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নাইটিঙ্গেল

১৮৬৭ সালে নিউইয়র্কে চালু করেন ‘উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ’। ১৮৮৩ সালে রাণী ভিক্টোরিয়া তাকে ‘রয়েল রেডক্রস’ পদক প্রদান করেন। ১৯০৭ সালে প্রথম নারী হিসাবে ‘অর্ডার অব মেরিট’ খেতাব লাভ করেন। ১৯০৮ সালে লাভ করেন লন্ডন নগরীর ‘অনারারি ফ্রিডম’ উপাধি।

১৯১০ সালের ১৩ আগস্ট ৯০ বছর বয়সে লন্ডনে নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭৪ সাল থেকে তাঁর জন্মদিন ১২ মে পালিত হয়ে আসছে ‘ইন্টারন্যাশনাল নার্সেস ডে’। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল তাঁর কাজের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন-নার্সিং একটি পেশা নয়, সেবা।

আজ ‘বিশ্ব সেবা দিবসে‘ নার্সিং পেশার জননী ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলকে বাংলাহাবের পক্ষ থেকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

নাইটিঙ্গেলকে নিয়ে আরো কিছু তথ্য-

  • তুরষ্কের ইস্তাম্বুলে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের নামে চারটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়।
  • লন্ডনের ওয়াটারলু ও ডার্বিতে তার প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়েছে।
  • লন্ডনের সেন্ট থোমাস হসপিটালে রয়েছে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল মিউজিয়াম।
  • ব্রিটিশ লাইব্রেরি সাউন্ড আর্কাইভে সংরক্ষিত রয়েছে তার কণ্ঠস্বর, যেখানে তিনি বলেছেন- যখন আমি থাকব না, সেই সময় আমার এই কণ্ঠস্বর আমার মহান কীর্তিগুলোকে মানুষের কাছে মনে করিয়ে দেবে এবং এসব কাজের জন্য উৎসাহ জোগাবে।
  • দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ নামে একটি নাটক মঞ্চায়িত হয় ১৯২৯ সালে- যার নামভূমিকায় অভিনয় করেন বিখ্যাত ব্রিটিশ অভিনেত্রী এডিথ ইভানস।
  • তার জীবনী নিয়ে চারটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ১৯১২, ১৯১৫, ১৯৩৬ ও ১৯৫১ সালে।

ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের বিখ্যাত কিছু উক্তি-

  • আমি আমার সাফল্যকে এভাবে মূল্যায়ন করতে চাই- আমি কোনো অজুহাত দিইনি বা নিইনি।
  • সুখ হচ্ছে নৈতিক উৎকর্ষের পর্যায়ক্রমিক উপলব্ধি।
  • আমার জীবনের এমন কোনো অংশ নেই, যেখানে ব্যথা ছাড়া ফিরে তাকাতে পারি।
  • কেউ নন, এমন কি একজন ডাক্তারও একজন নার্সের সঠিক সংজ্ঞা দিতে পারবেন না। বড়জোর বলতে পারবেন- উৎসর্গীকৃত ও বাধ্যগত। সত্যিটা হচ্ছে এটা আরও অনেক বেশি কিছু।
  • মানুষ কেন তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠে? দিন খুব ছোট, তাই? না, আসলে দিনে তাদের নিজেদের জন্য কোনো সময় বরাদ্দ থাকে না।