এক সময়ের নামজাদা অনেক বিখ্যাত লেখকদের নাম এই সময়ের পাঠকদের অনেকের কাছেই অজানা। পড়া নেই সেসব সাহিত্যিদের রচিত কোন বিখ্যাত রচনাও। তার একটি কারণ এসব লেখকদের লেখা সেসব বিখ্যাত পান্ডুলিপির আর কোন অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে নেই। অনেক বিখ্যাত লেখকদের মৃত্যুর সাথে সাথে তাদের সেসব দুষ্প্রাপ্য পান্ডুলিপি কালের গহবরে হারিয়ে গেছে। অনেক খোঁজাখুঁজি, তল্লাশি করেও যার কোন হদিশ পাওয়া যায়নি। তৎকালীন সময়ে কপিরাইট প্রথা না থাকায় সেসব পান্ডুলিপির অনেকগুলোই যেমন সংরক্ষণের অভাবে অযত্নে অবহেলায় হারিয়ে গেছে , আবার অনেক পান্ডুলিপি সে সময়ের শাসকদের রোষানলে পড়ে হয়েছে বাজেয়াপ্ত। আজ আপনাদের এমনই কয়েকজন বিখ্যাত লেখকদের সেসময়ের সারা জাগানো পান্ডুলিপির কথা জানাবো যা অদৃশ্য এক রহস্যময় কারনে হারিয়ে গেছে, দুষ্প্রাপ্য সেসব পান্ডুলিপি পাওয়ার অপেক্ষায় আজকের সব পাঠকেরা এখনো অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান।
১. দ্য ইসল অব ডগস- বেন জনসন ও থমাস নাশে
বেন জনসন ও থমাস নাশে ছিলেন উনবিংশ শতকের নামকরা নাট্যকার। ১৯৫৭ সালে এই দুজনের সমন্বিত প্রয়াসে রচিত হয় এক অনবদ্য নাটক ‘দ্য ইসল অব ডগস’। সেময় নাটকটি বেশ সাড়া জাগায়। জনপ্রিয়ও হয়। কিন্তু কোন এক অদৃশ্য কারনে নাটকটিতে সেন্সরের খাঁড়া নেমে আসে। তৎকালীন বৃটিশ শাসকেরা এই দুই নাট্যকারের বিরুদ্ধে্ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে এবং নাটকটি নিষিদ্ধ করা হয়। নাটকটি যাতে বই হিসেবে প্রকাশিত হতে না পারে তার জন্য এই নাটকের যত কপি ছিল তা ধ্বংস করার নির্দেশ দেয়া হয়। এদিকে গ্রেফতারের ভয়ে জনসন ও থমাস লন্ডন ত্যাগ করে। তবে নাটকটির বিষয়বস্তু কি ছিল এবং কি কারনে তৎকালীন শাসকদের চক্ষুশুল হয়েছিল তার কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তখনকার পত্রপত্রিকা হতে যতটুকু জানা যায় নাটকটিতে তৎকালীন সমাজব্যবস্থার নান কদর্য রূপ তুলে ধরা হয়েছিল। শাসকদের কাছে কিছুতেই তা গ্রহণযোগ্য হয়নি।
২. অটো বায়োগ্রাফিক্যাল রাইটিংস – স্যামুয়েল জনসন
অষ্টাদশ শতাব্দীতে স্যামুয়েল জনসন ছিলেন একজন জনপ্রিয় ইংরেজ কবি ও প্রাবন্ধিক। অষ্টাদশ শতাব্দীর লন্ডনের একজন শ্রেষ্ঠ আড্ডাবাজ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। নানা ধরণের লেখার পাশাপাশি তিনি ইংরেজি ভাষার অভিধান রচনা করেন এবং অভিধানের এই চল্লিশ হাজার শব্দ প্রমাণ করেছিলো জনসনের জ্ঞানের গভীরতা।তাঁর রচিত ‘ডঃ স্যামুয়েল জনসনের জীবনী’ ইংরেজি ভাষায় শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত হয়। এটি সত্য যে জনসন তার নিজের জীবন সম্পর্কে ব্যাপকভাবে লিখেছেন।তিনি তাঁর সর্বশেষ আত্মজীবনী ‘অটো বায়োগ্রাফিক্যাল রাইটিংস’-এ তাঁর শেষ জীবনের না বলা কথা লিপিবদ্ধ করে যান। কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় এই যে মৃত্যুর ঠিক কয়েকদিন আগে তিনি তাঁর এই লেখাটি ধ্বংস করে ফেলেন। কি কারনে এবং কেনই বা তিনি একাজ করেছিলেন তা আজোও সকলের কাছে এক বিস্ময়। ধারণা করা হয়, তিনি হয়তো এই বইটিতে তাঁর জীবনের এমন কিছু সত্য তুলে ধরেছিলেন যা তিনি পরবর্তীতে চাননি সকলে তা জানুক।
৩. হিস্ ফাইনাল ম্যানুসক্রিপ্ট- ওয়াল্টার বেঞ্জামিন
ওয়াল্টার বেঞ্জামিন ছিলেন একজন জনপ্রিয় ফরাসি লেখক। ১৯৪২ সালে নাৎসি বাহিনী যখন প্যারিস আক্রমন করে, বেঞ্জামিন প্যারিস ত্যাগ করে ফ্রান্স এবং স্পেনের মধ্যকার সীমান্ত অঞ্চলের দিকে পালিয়ে যান। এইসময় তাঁর সঙ্গে ছিল এক ব্রিফকেস যা তিনি সারাক্ষণ সঙ্গে রাখতেন। বেঞ্জামিনের সঙ্গে ছিল তার অনেকদিনের পুরনো এক বন্ধু। তিনি জানতে চেয়েছিলেন ব্রিফকেসে কি আছে? বেঞ্জামিন জানান, এতে তার এক গুরুত্বপূর্ণ অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি রয়েছে। তবে এটি খুবই আশ্চর্যের বিষেয় যে,বেঞ্জামিন স্পেন সীমান্তের কাছাকাছি এক জায়গায় এসে আত্মহত্যা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তারঁ সেই পান্ডুলিটি আর পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয় যে, এই পান্ডুলিপিটি ১৯ শতকের তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার উপর বেঞ্জামিনের একটি গবেষণাধর্মী কাজ ছিল। কিন্তু পান্ডুলিপি টি কোথায় ? তিনি কেনই বা আত্মহত্যা করেন ? তাঁর সেই ব্রিফকেসটি কোথায়? তা এখনও লেখকদের তর্কের বিষয়। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো বেঞ্জামিনের মৃত্যুর পর তাঁর সেই বন্ধুটিরও আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
৪. দ্য মেসিয়াহ্ – ব্রুনো স্কল্স
স্বনামধন্য লেখক ‘ব্রুনো স্কল্স’ ছিলেন একজন ইহুদি। ১৯৪২ সালে নাৎসী বাহিনীর হাতে তিনি খুন হন। তিনি তাঁর জীবনের শেষ বছরগুলি নিয়ে ‘দ্য মেসিয়াহ্’ নামে একটি উপন্যাস লেখার কাজে হাত দেন। মৃত্যুর পূর্বে এই পান্ডুলিপির কপি তিনি তাঁর বিশ্বস্ত কয়েকজন বন্ধুর কাছে রাখেন। কিন্তু তাঁর সেই বন্ধুরা কারা ছিল তা আজো পর্যন্ত অজানা। পরবর্তীতে লেখক জার্জি ফিকোনস্কি ‘ব্রুনো স্কল্স’এর জীবনী নিয়ে বায়োগ্রাফি রচনাকালে ব্রুনোর সেই হারিয়ে যাওয়া উপন্যাসটির পান্ডুলিপি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন। অনেক বছরের নিরন্তন চেষ্ঠার পর ফিকোনস্কি দুই জন এমন ব্যক্তির সন্ধান পান, যারা তাঁকে জানান যে, পান্ডুলিপিটি তাদের কাছে আছে। কিন্তু ফিকোনস্কি, পান্ডুলিপিটি তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করার পূর্বেই রহস্যময়ভাবে সেই দুই ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে। আর তার মধ্য দিয়ে হারিয়ে যায় ‘ব্রুনো স্কলস’এর ‘দ্য মসিয়াহ্’ পান্ডুলিপিটি। ফিকোনস্কির পক্ষেও তা আর উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। এখনও পর্যন্ত পান্ডুলিপিটির কেউ সন্ধান দিতে পারে নি।
৫. হার লাস্ট জার্নাল- সিলভিয়া প্লাথ্
সিলভিয়া প্লাথ্ ছিলেন বিংশ শতাব্দীর একজন প্রখ্যাত কবি, উপন্যাসিক এবং একজন ছোট গল্পকার। ১৯৬৩ সালে তিনি আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে থেকে তিনি একটি জার্নাল সঙ্গে রাখতেন। অনেকের ধারণা তার মধ্যে তিনি তাঁর পান্ডুলিপির খসড়া রাখতেন। কিন্তু তাঁর এই পান্ডুলিপির বিষয়বস্তু কি ছিল তা সকলের কাছে এক চরম বিস্ময়। কিন্তু তাঁর পান্ডলিপির খসড়া কখনো পাওয়া যায়নি। অনেকের ধারনা পান্ডুলিপিটি সিলভিয়া প্লাথে্র স্বামী টেড হিউজেস লুকিয়ে রেখেছেন। পান্ডুলিপিতে এমন কিছু ছিল যা টেড সকলের সম্মুখে আনতে চাননি। টেড প্রথম দিকে সিলভিয়ার এই পান্ডুলিপিটির কথা অস্বীকার করলেও তিনি তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে জানান যে, পান্ডুলিপিটি তিনি পুড়িয়ে ফেলেছেন। পান্ডুলিপিতে সিলভিয়া তাঁর শেষ সময়ের এমন কিছু কথা লিখেছেন যা টেড চাননি তাঁর সন্তানরা পড়ুক। এমনিভাবে সময়ের অতল গহবরে হারিয়ে গেছে নামকরা অনেক বিখ্যাত লেখকদের পান্ডুলিপি। যা এখনো খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা চলছে। আজকের পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলো একসময়ের বিখ্যাত পাঁচজন লেখকের রহস্যময় কারনে হারিয়ে যাওয়া পান্ডুলিপি যার সন্ধান এখনো কেউ পায়নি।