আজ থেকে ঠিক ১৫ বছর আগের কথা। সাল ২০০১। ভিয়েতনাম।
টং ফুক ফুক এর স্ত্রীর ভয়ানক প্রসব বেদনা উঠেছে। ভীষণ ব্যাথায় চিৎকার করছেন এই হবু মা। দিশেহারা হয়ে পরলেন ফুক। দ্রুত নিয়ে গেলেন নিকটসস্থ হাসপাতালে। স্ত্রীকে কেবিনে ঢুকিয়ে বাইরে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
টিক টিক করে ঘড়ির কাঁটা চলতে থাকে। টেনশন বাড়তে থাকে ফুক ফুকের। স্ত্রী এখন ভালো আছে তো? কেমনই বা আছে অনাগত সন্তান? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে একসময় তিনি খেয়াল করলেন, স্ত্রীর পাশের কেবিনেই একজন সন্তান-সম্ভবা মহিলা ঢুকলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই সন্তান ছাড়াই বেড়িয়ে গেলেন তিনি। এরপর আরেকজন। তারপর আরেকজন। খটকা লাগলো ফুক ফুকের। তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না, সদ্যোজাত শিশুগুলো যাচ্ছে কোথায়?
বুঝে উঠতে কিছুটা সময় লাগলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি বুঝে ফেললেন। নিজ চোখে দেখলেন মানুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা দানবের বাস্তব রূপ। বুঝতে পারলেন, সেই শিশুগুলো আর জন্ম নিবে না এই পৃথিবীতে। জন্মের মুহূর্তে চিৎকার করে কাঁদবে না। হাসবে না। খেলবে না। তাদের ছোট্ট, নাজুক, অপরিণত, রক্তাক্ত শরীরগুলো ব্যাগে ভরে ফেলে দেওয়া হবে। কোথায়, কেউ জানে না। তারা হয়েছে গর্ভপাতের নির্মম শিকার। দুজন অপরিণামদর্শী নারী পুরুষের ক্ষণিক উত্তেজনার বলি।
চোখে অঝোর বর্ষা নামলো ফুক ফুকের। মুহূর্তের জন্য হলেও জীবনের প্রতি সব আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন তিনি। তারপরই ভাবলেন, কিছুই কি করার নেই তাঁর?
স্ত্রীর সাথে আলোচনা করলেন। স্ত্রীকে বললেন তাঁর পরিকল্পনার কথা। তিনি ভাবলেন, তাঁর স্বামী বুঝি পাগল হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ফুক ফুক এর চোখে হয়তো তিনি কিছু একটা দেখতে পেয়েছিলেন। সেজন্যই হয়তোবা, তিনি বাঁধা দিলেন না। তো কি ছিল সেই পরিকল্পনা?
টং ফুক ফুক ঠিক করলেন, তিনি গর্ভপাতের শিকার শিশুদের মৃতদেহগুলোকে নিজ হাতে কবর দেবেন। তাদের সৎকার করবেন। তাদের একটা স্থায়ী ঠিকানার ব্যবস্থা করে দেবেন। শিয়াল-কুকুরের খাদ্য হতে দেবেন না। পেশায় নির্মাণ শ্রমিক টং ফুক ফুক তাঁর সঞ্চিত সকল অর্থ দিয়ে ভিয়েতনামের “না ট্রাং” শহরে অবস্থিত “হন থম” পর্বতের উপরে একটি জায়গা কিনলেন। সেখানেই তিনি গড়ে তুললেন হতভাগ্য সেই শিশুদের কবরস্থান।
হাসপাতালের আশেপাশেই থাকতে লাগলেন সবসময়। গর্ভপাতের খবর কানে গেলেই দৌড়ে গিয়ে হাসপাতাল থেকে সেই শিশুদের মৃতদেহগুলোকে পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে আসতেন তাঁর সেই কবরস্থানে। কান্নাজড়ানো চোখে, হাতে একটা শাবল নিয়ে খুঁড়তেন ছোট ছোট কবর। তারপর তাদের ছোট্ট শরীরগুলোকে পরম যত্নে কবরে শুইয়ে দিতেন তিনি। মাটি দিয়ে ভরাট করে লাগিয়ে দিতেন ছোট্ট ফুলগাছ। সেই গাছগুলোতে একসময় ফুল আসতে লাগলো। ফুলের কী সুন্দর ঘ্রাণ! ফুক ফুক বসে থাকতেন সেখানে। পাহারা দিতেন তাঁর ছোট্ট সোনামনিদের।
১৫ বছর ধরে তিনি প্রায় ১০,০০০ এরও বেশি শিশুর সৎকার করেছেন। কিন্তু তিনি সবসময় চাইতেন, শিশুগুলো যাতে এভাবে মারা না যায়। তিনি সবাইকে বোঝানো শুরু করলেন। অপরিণত যুবক-যুবতী, হতদরিদ্র পরিবার সবাইকেই তিনি অভয় দিতে শুরু করলেন। বলতে লাগলেন, ভয় নেই! তোমাদের সন্তানদের আমিই দেখবো। তারপর যখন তোমরা তাদের ভরণ-পোষণ করার মত অবস্থায় যাবে, আমার কাছ থেকে নিয়ে যেও। তাঁর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেক দম্পতিই আর গর্ভপাতের রাস্তায় যাচ্ছেন না। অনাকাঙ্ক্ষিত শিশুর জন্ম হলেই সেই শিশুকে তারা ফুক ফুক এর কাছে দিয়ে যান। ফুক ফুক পরম মমতায় তাদেরকে বুকে জড়িয়ে নেন। নিজের সন্তানের মতো তাদেরকে বড় করে তোলেন।
১০০ এরও বেশি শিশু এখন তাঁর কাছে থাকে। তাদের প্রত্যেকের নাম মনে রাখার জন্য তিনি মজার একটা পদ্ধতি বেঁছে নিয়েছেন। প্রত্যেক ছেলে শিশুকেই তিনি “ভিন” বলে ডাকেন, যার বাংলা অর্থঃ সম্মান। আর মেয়েদের ডাকেন “টাম”, বাংলায় এর অর্থঃ হৃদয়। তাদের প্রত্যেকের নামের দ্বিতীয় অংশ তাদের মায়ের নামে আর তৃতীয় অংশ টং এর পরিবারের নামে।
শুরু করেছিলেন মৃত শিশুদের সৎকারের মধ্য দিয়ে। আজ তিনি হয়ে উঠেছেন অসংখ্য শিশুর “বাবা।“ এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আজও আছে বলেই হয়তোবা পৃথিবীটা বাসযোগ্য আছে। তিনি বলেন, “আমি আজীবন বেঁচে থাকবো না। কিন্তু আমি চাই, আমি যখন থাকবো না তখন আমার সন্তানেরা এই দায়িত্ব নেবে। শিশুদের জীবন বাঁচাবে। জীবন সাজাবে।“ যতক্ষণ পারেন, এই শিশুদের সাথেই তিনি সময় কাটান। তাদের সাথে খেলেন। তাদের নিয়ে বই পড়েন। মাঝে মাঝে ঘুরতে বের হন। সেই শিশুগুলোও বুঝতে পারে তাঁর হৃদয়ের উষ্ণতা। গভীর ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতাবোধ যেন মিশে থাকে তাদের চোখে মুখে।
যখন মন ভালো থাকে না, তখন চলে যান তাঁর সেই কবরস্থানে, যাকে তিনি “বাগান” বলে সম্বোধন করেন। বসে থাকেন প্রিয় “ফিটাস” দের পাশে। হয়তো মনে মনে তাদের সাথে কথা বলেন। অনেক কথা। যেগুলো তিনি আর তারা ছাড়া আর কেউ বোঝে না। হন থম পর্বতের ওপার থেকে হু হু করে বয়ে যায় হিমেল হাওয়া। গাছের পাতাগুলো কেঁপে ওঠে। টং ফুক ফুক কথা বলেই যান তাদের সাথে। অচেনা, অজানা সুরে গেয়ে যান অন্যলোকের গান।
এমন মানুষগুলো আজ দরকার। খুব বেশি দরকার।
লেখকঃ ইশফাক জামান ।