বাসের সংরক্ষিত মহিলা আসন এবং আমাদের পুরুষ সমাজের মাথা ব্যথা – পর্বঃ ২

বাস ট্রাভেল

রুবিনার আজ ছুটির দিন । ছুটির দিন আসলে তার মনে একটা শান্তি লাগে যে, রোজকার মত তাকে আর বাসে ওঠার জন্য যুদ্ধ করতে হবে না । রুবিনা ভাবছে একটু কেনাকাটা করতে মার্কেট যাবে । তাই সে ভিড় এড়িয়ে চলার জন্য অফিস সময় বাদ দিয়ে বের হল । যেন বাসে উঠতে সমস্যা নাহয় । কিন্তু কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কি! নাহলে এই সময়েও বাসে এত ভিড় কেন হবে ?

এত ভিড় দেখে একবার সে ভাবল বাসায় ফিরে যাবে কিন্তু আবার এটাও ভাবল তার কেনাকাটা করাটাও তো জরুরী । আর এরকম ভিড় তো প্রতিদিনই থাকবে । তো সে মনে মনে ঠিক করল বাসায় সে ফিরে যাবে না ; সে মার্কেটেই যাবে । তবে এখন যেহেতু তাড়া নেই তাই অপেক্ষা করে ফাঁকা বাসে উঠবে ।

তার সামনে দিয়ে বেশ কয়েকটা বাস শাঁ শাঁ করে চলে গেল । ওদিকে সময়ের সাথে সাথে সূর্য মামা তার আপন তেজ এর জানান দিয়ে আরও বেশী করে তাপ বর্ষণ করতে থাকল । রুবিনা ব্যাগ থেকে পানি বের করে কয়েক ঢোক পানি পান করল । সানগ্লাসের পুরু গ্লাসের ভেতরে থেকে ধুলাময় চারপাশ দেখা যাচ্ছে ধূসর । রুবিনার মনের ভেতরে কেমন যেন একটা হাহাকার করে উঠল । মনে মনে ভাবতে থাকল,কবে যে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা যাত্রী বান্ধব হবে কে জানে ?আদৌ কি কখনও হবে? এসব ভাবতে ভাবতে তার সামনে দিয়ে আরও কয়েকটি বাস ধুলা উড়াতে উড়াতে চলে গেল ।

রুবিনা শান্ত ভঙ্গিতে হাত ঘড়িতে সময় দেখল । তার মনে হচ্ছে সে অনন্তকাল ধরে বাসের জন্য অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে আছে । প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর একটা অর্ধভর্তি বাস এসে থামল তার সামনে । সে বাসে উঠে একটু ভেতরে চলে গিয়ে দাঁড়াল । বাসে ওঠার এক মিনিট পরেই সামনে থেকে চিৎকারের চেঁচামেচির শব্দ আসতে লাগল । লোকাল বাসের প্রতিদিনকার চিত্র এটি । তাই এটাতে খুব বেশী মনোনিবেশ করার প্রয়োজনবোধ করল না সে । কিন্তু চেঁচামেচির এক পর্যায়ে কিছু কথা আসল তার কানে । এবার একটু নড়ে দাঁড়াল সে । সামনে ভাল করে তাকাল ।

সামনের কিছু ছেলে একটা মেয়েকে বলছে, “কি ম্যাডাম, অন্য সবখানে কন যে নারী পুরুষ সবার সমান অধিকার । শুধু বাসে উঠলে সেইটা আর সমান থাকে না তাইনা ? নারী পুরুষ সমান অধিকার হইলে বাসে আপনাগোর জন্য আবার আলাদা কইরা ৯টা সিট রাখা লাগবে কেন”? সাথে সাথে বাসের আরও কিছু লোক তাদের সাথে গলা মিলাল । মেয়েটি কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না । কিই বা বলার আছে ? রুবিনাও কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল ।

এটা প্রতিদিনকার পাবলিক বাসের একটি স্বাভাবিক চিত্র । রুবিনার মত বেশীরভাগ মেয়েদেরই পাবলিক বাসে এমন ঘটনাগুলোর সম্মুখীন হতে হয় । এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় ।

বেশীরভাগ সময়ই দেখা যায় বাসে একটা মেয়ে নানাভাবে হয়রানীর শিকার হচ্ছে হয়ত কখনও কখনও কেউ কেউ তাদের সেই হয়রানীর প্রতিবাদ করছে কিন্তু বেশীরভাগ সময়ই যা হয় তা হল মেয়েটিকে তার হয়রানীর বিরুদ্ধে একাই চিৎকার করতে হয়, তার বিপরীতে পুরো বাসের লোক এক হয়ে তাকে চুপ করতে বলে কারন এগুলো তো লজ্জার বিষয় ! বাসে কোন ছেলে বা লোক মেয়েদের গাঁয়ে হাত দেবে, নানাভাবে হয়রানী করবে এ যেন খুব স্বাভাবিক একটা বিষয় । এবং এসব পরিস্থিতির শিকার হয়েও মেয়েদের চুপ থাকতে বলা হয় কারন এতে তো মেয়ের সম্মানহানী হচ্ছে ! সবাই তো জেনে যাচ্ছে মেয়েটির গাঁয়ে একটা ছেলে বা লোক হাত দিয়ে দিয়েছে । ছি! ছি! কি লজ্জা! কিন্তু ছেলেটার বা লোকটার তো কোন লজ্জা নেই ! কারন সে ছেলে! ছেলেদের তো ইজ্জত হারানোর কিছু নেই! কিন্তু মেয়ের গায়ে কেউ হাত দিয়ে দিয়েছে এ তো ভীষণ লজ্জার ! এটা এত চিৎকার করে বলতে হয় না !

কিন্তু এটা কি কেউ কখনও ভাবে যে যেই মাত্র কোন ছেলে বা লোক মেয়েটির গাঁয়ে কোন অসদুদ্দেশ্য নিয়ে হাত দিল বা হয়রানী করল সেইমাত্রই সেই লজ্জার দায় সেই নোংরা মানসিকতার ছেলেটির বা লোকটির ,সেই মেয়েটির নয় ।

আবার কখনও কখনও এমনও হয় যখন  মেয়েটি একা চিৎকার করেই যাচ্ছে আর এটা দেখেও পুরো বাস ভর্তি লোকজন তা নিরবে দেখে যায় । তাদের মধ্যে কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করা যায় না । তাদের দেখে মনে হয় তারা খুব গভীর চিন্তা নিয়ে কোন নাটক বা সিনেমার শ্যুটিং দেখছে । যেখানে তাদের কিছু করার নাই । গভীর মনোযোগ এর সাথে পর্যবেক্ষণ করাই তাদের একমাত্র কাজ ।

এরকম পরিস্থিতিতে মেয়েটিকে একা পেয়ে অপরাধীও মনে মনে হাসতে থাকে হয়ত এই ভেবে যে, “ তুমি মেয়ে চিল্লাও আর যাই কর, একলা তো আর কিছুই করতে পারবা না । দেখছ পুরা বাস ভর্তি মানুষ,কিন্তু কেউ তোমার সাথে নাই । চিল্লাও যত খুশি চিল্লাও । আমার যা মজা নেয়ার তা তো নিছিই” ।

এরকম বাসে হয়রানীর শিকার হয়ে কত মেয়ে যে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে, নিজেকে দোষী ভাবে , নিজেকে অপবিত্র ভাবে তার কোন সঠিক হিসাব জানা নেই । মাঝে মাঝে মেয়েদের মধ্যে এইসব হয়রানীর প্রভাব এতটাই তীব্র হয় যে তার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে । যেমনঃ নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলা, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, অন্যের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা, নিজেকে সবার কাছে থেকে গুঁটিয়ে নেয়া ইত্যাদি মানসিক সমস্যায় সে আক্রান্ত হতে পারে । কারও কারও আবার পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চলাচলে ভীতি জন্মাতে পারে ।

চলবে………