সীমানার কাঁটাতারে বন্দী সামাজিক থ্রিলার উপন্যাস অভিমন্যু

সীমান্তে যাদের বাস, তাদের অনেকেই এপার-ওপারের কাঁটাতারের বেড়া উপেক্ষা করে কিছু দুই নাম্বারি কাজ করে। তেমনই এক পরিবারের সতেরো বছর বয়সী অনভিজ্ঞ এক তরুণ রবি। ঘটনাচক্রে ফেঁসে যায় অদ্ভুত এক পরিস্থিতিতে। তার বাপ ভাই অনেক আগে থেকেই গরু চোরাচালানের কাজে থাকলে সে এর আগে কখনো সেসব কাজে যায়নি, অবৈধভাবে সীমানা পার হয়নি। প্রথমবারেই এমন এক অবস্থায় পড়লো, যা থেকে উত্তরণের কোনো উপায় তার জানা নেই।

সীমান্তে যারা এসব কাজে জড়িত থাকে, তাদের অনেকেই মাঝেমাঝে আর ফিরে আসে না। কেন ফিরে আসে না, তার নিরেট খবর কেউ না পেলেও অনুমান করে নিতে পারে। কিন্তু রবি সেরকম একটা ঘটনার মধ্যে পড়লো, যাতে তার জীবনই বদলে গেল। রবির বাবা আর ভাইকে মেরে ফেলেছে সীমান্তরক্ষীরা। সৌভাগ্যক্রমে সে বেঁচে গেছে। কিন্তু তাতে কী? সে আছে কাঁটাতারের এপারে। কীভাবে নিজের দেশে ফিরে যাবে, জানে না। অচেনা বিদেশ বিভূঁই, অভিজ্ঞতা নেই, পথ চেনা নেই, হাতে পয়সা নেই, পেটে খাবার নেই। কী করে বেঁচে থাকবে সে?

ধীরে ধীরে খাবারের ব্যবস্থা হলো, থাকার জায়গা হলো। কিন্তু প্রাণ টানছে মাতৃভূমি। এখানকার কাওকে না জানিয়ে, কারোর সাহায্য না নিয়ে কী করে সে ফিরে যাবে মায়ের কাছে? পরিচয় ফাঁস হয়ে গেলে প্রাণটুকুও থাকবে না ধড়ে।

তারপর বুদ্ধির জোরে পকেটে পয়সা এলো, এমনকী দেশে, নিজের ঘরে ফিরে যাওয়ার সুযোগও এলো৷ কিন্তু কিসের নেশায় সতেরো বছরের এই তরুণ তক্ষুনি ফিরে গেল না মাতৃভূমিতে? দেশের মাটিতে বসেই কীসের প্রতিজ্ঞা নিয়ে ফিরে গেলো জমের ঘরে? এমন কোন ব্যাপার ঘটলো, যার জন্য একজন অনভিজ্ঞ তরুণ হয়ে উঠলো নিষ্ঠুর মানুষে?

পাঠ প্রতিক্রিয়া

প্রথমে একটু ধীরে শুরু হলেও দুই তিন চ্যাপ্টার ধৈর্য্য নিয়ে পড়ে ফেললে, এই বই আপনাকে আর হাত থেকে রাখতে দেবে না। কাহিনি এমনভাবে টেনে নিয়ে যাবে, যাতে করে আপনি বুঝতেই পারবেন না, ৩৮০ পৃষ্ঠার বই কখন শেষ হয়ে গেল! টান টান উত্তেজনাময় গল্প অভিমন্যু নয়, বরং একটা বহমান নদীর মতো এর কাহিনি। সবচেয়ে অভিনব হলো গল্পের প্লট। এতো দারুণ একটা গল্প, যা আমরা আবছা আবছাভাবে জানি। টিভিতে, পত্রিকায় সীমান্তের অনাচার সম্পর্কে শুনি, তারপর কয়েকদিন গালাগাল দিই। এরপরেই ভুলে যাই। কিন্তু ওই খবরগুলোর অন্তরালে কতো শত গল্প লুকিয়ে থাকে, তা আমাদের ভাবনাতে ঘূর্নাক্ষরেও আসে না। দিবাকর দাসের ক্যারেকটার ডেভেলপমেন্টও বেশ ভালো।

এবারে আসি কিছু নেগেটিভ দিক নিয়ে। লেখকের লেখনিতে দর্শন একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। খুব সাসপেন্সে ভরা রোলার কোস্টার স্পিডের বইয়েও একটু আধটু দর্শন ভালো লাগে। কিন্তু সেটা যদি মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তাহলে ধীরে ধীরে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একই কথা প্রযোজ্য পারিপার্শ্বিকতার বর্ণনার ক্ষেত্রে। পরিবেশের, অবস্থার বর্ণনা না থাকলে গল্পটা ঠিক চোখের সামনে ভেসে ওঠে না। তাই পারিপার্শ্বিকতার বর্ণনা খুবই জরুরি। গল্প যাই হোক, কিছু কিছু লেখকের বই পড়তেই ভালো লাগে বর্ণনাভঙ্গীর জন্য। তবে সেক্ষেত্রেও খেয়াল রাখতে হবে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত বর্ণনা হয়ে যাচ্ছে কি না। তারমানে লেখককে এক্ষেত্রে পাঠকের ভূমিকায় বসে বুঝতে হবে, কখন রাশ টেনে ধরা উচিত৷

রবি বাংলাদেশের ছেলে। সে বাংলায় কথা বললেও বাঙালিদের বাংলায় আলাদা একটা টান আছে। যেমনটি আছে ওপারের বাঙালিদের ভাষাতেও। এই টানের মাধ্যমেই বোঝা যায়, কারা ‘বাঙাল’ আর কারা ‘ঘটি’। অভিমন্যুতে এত দীর্ঘ সময় ধরে রবি সেদেশে নির্বিঘ্নে কাটিয়ে দিলো। অথচ সে যে ভারতীয় নয়, তার ভাষাতে ঘটিদের টান নেই, বরং বাঙালিদের টাম আছে। এটা কেউ ধরতেই পারলো না? এই ব্যাপারটাতেই একটু অসংগতি লেগেছে।

এছাড়া পুরো বইয়ে আমি অন্তত কোনো প্লটহোল পাইনি। আর কোনো ব্যাপারই আমার কাছে বেখাপ্পা লাগেনি। ভুলত্রুটি সব মিলিয়ে বইটি একবসায় শেষ করার মতো বই।

বই পরিচিতি

বই- অভিমন্যু (সামাজিক থ্রিলার উপন্যাস)
লেখক- দিবাকর দাস
প্রচ্ছদ- সজল চৌধুরী
প্রকাশনা- ভূমি প্রকাশ
মলাট মূল্য- ৪৬০
প্রকাশকাল – বইমেলা ২০১৯
প্রাপ্তিস্থান : অনলাইন বুকশপ, নীলক্ষেত এবং তাদের শোরুম : ৩৮ বাংলাবাজার, ২য় তলা। (সিঁড়ি দিয়ে ওঠে বামদিকে ফেইথ বুকস এর সাথে লাগোয়া।)

Feature image source : মাদিহা মৌ