সীমাহীন অত্যাচারে আমাদের চারপাশের প্রকৃতি দিন দিন বিরূপ হয়ে উঠছে। পালটে যাচ্ছে প্রকৃতির প্রতিশোধের ধরন। বিগত কয়েক দশক ধরে যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলতে সাধারণত বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসে বোঝানো হত সেখানে সাম্প্রতিককালে নতুন নতুন দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে। গত কয়েকবছর যাবৎ বার বার ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে, আশংকাজনকভাবে বেড়েছে বজ্রপাত। ভূমিকম্পে তেমন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও বজ্রপাতের মরণছোবল কেড়ে নিয়েছে অসংখ্য মানুষের প্রান।
২০১০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত সরকারী হিসেবমতে ১৪৭৬ জন বজ্রপাতে নিহত হন! এপ্রিল, মে, জুন- এই তিনমাস বজ্রপাত বেশি হয়ে থাকে। যার মধ্যে মে মাসে বজ্রপাতে নিহতের সংখ্যা সর্বাধিক। পরিসংখ্যানে দেখা যায় এদেশের বজ্রপাতে মৃতের মধ্যে ৫১ শতাংশ হল কৃষক যারা মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত জমিতে কাজ করছিল। স্কুলে আসা যাওয়ার সময় মারা গিয়েছে ১১ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী। আতংকের কথা হল গ্রামাঞ্চল হলে ঘরও বজ্রপাত থেকে নিরাপদ নয়। বজ্রপাতে মৃতের ২২ শতাংশ মানুষ ঘরে ভিতরেই মারা গিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে মৃতের হার আরো বেড়েছে। ২০১৫ সালের সর্বোমোট ২৬৫ জন বজ্রপাতে নিহত হয়েছিল। ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত ২৬১ জন মানুষ বজ্রপাতে নিহত হয়। পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলদ্ধি করে বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। সরকারী নিয়ম অনুযায়ী বর্তমানে বজ্রপাতে নিহত ব্যাক্তিদের স্বজনদের এককালীন ৭,৫০০ টাকা থেকে ২৫,০০০ টাকা পর্যন্ত সহায়তা প্রদান করে থাকে।
কেন এই বিধ্বংসী বজ্রপাত? বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন যে, বজ্রপাত ক্রমাগত পরিবেশ দূষণের ফলে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফল। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ভূপৃষ্ঠ থেকে বেশি বেশি পানি বাষ্পীভূত হয়ে অতিরিক্ত মেঘমালার সৃষ্টি হচ্ছে। এত বজ্রপাত তুলনামূলকভাবে বাড়ছে। এছাড়াও এ ব্যাপারে ২০১৪ সালে University of Berkeley থেকে একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। প্রতি ডিগী সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বজ্রপাত ১২ শতাংশ বেড়ে যায় বলে উক্ত গবেষণা থেকে জানা যায়। এ শতাব্দী শেষ বজ্রপাত ৫০ ভাগ বেড়ে যেতে পারে বলে গবেষকরা আশংকা করেন।
ভূপৃষ্ঠে প্রবাহিত গরম বায়ুপ্রবাহ যখন ঠান্ডা বায়ুর সংস্পর্শে আসে তখন যে মেঘ সৃষ্টি হয় তা থেকে বজ্রপাত হয় থাকে। গরম বায়ুতে থাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পানিকনা আর ঠান্ডা বায়ুতে থাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বরফকণা। দুই বায়ু যখন একত্রিত হয় তখন এদের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে মেঘে চার্জ তৈরি হয়। ভূপৃষ্ঠের আকর্ষণে ঋনাত্মক চার্জগুলো মেঘের নিচের দিকে চলে আসে। এতে মেঘের উপরের প্রান্তে ধনাত্মক চার্জের পরিমান বেড়ে যায়। সহজকথায় পুরো মেঘখন্ডতাই এক ধনাত্মক-ঋনাত্মক প্রান্ত বিশিষ্ট এক বিশাল ব্যাটারিতে পরিনত হয়। জমা হওয়া ঋনাত্মক চার্জ (ইলেক্ট্রন) যথেষ্ঠ পরিমান হলে তখন ইলেক্ট্রন এক মেঘখন্ড থেকে অপর মেঘখন্ডে আঁকাবাঁকা পথে ভ্রমণ করে যা আমরা বিদ্যুৎ চমক হিসেবে দেখে থাকি। এসময় তাপশক্তি নির্গত হওয়ায় বিদ্যুৎচমক সংলগ্ন বায়ু হঠাৎ প্রসারিত হয় যা প্রচন্ড শব্দের সৃষ্টি করে। দূরত্বের কারণে আমরা শব্দ কম-বেশি শুনতে পাই। তবে ইলেক্ট্রনগুলো এক মেঘ থেকে অন্য মেঘে সোজা পথে ভ্রমণ না করে আঁকাবাঁকা পথে যায় তার জবার বিজ্ঞানীরা এখনো খুজে চলেছেন।
মেঘখন্ডে অবস্থিত ইলেক্ট্রনগুলো যখন ভূপৃষ্ঠে চলে আসে তখন তা আমাদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই বিপদ থেকে আমাদের আত্মরক্ষা জরুরী। পৈত্রিক প্রাণ অকালে হারানো কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
১. বাড়ির আশে-পাশে যেসব গাছপালা মরে গিয়েছে, ডাল মরে/পচে গিয়েছে সেগুলো কেটে ফেলতে হবে।
২. ঝড়ের সম্ভবনা দেখলেই দ্রুত ঘরে ফিরতে হবে। সম্ভব না হলে অন্যকোথাও আশ্রয় নিতে হবে। ভুলেও কোন গাছের নিচে দাড়াবেন না। কোন বৈদ্যুতিক খুটি, মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ারের ধারে কাছেও থাকবেন না। কোন দালানের আশ্রয় নেয়া সম্ভব না হলে গাড়ির মধ্যে থাকা যায়। ফাঁকা জায়গার চেয়ে গাড়ির ভিতরে নিরাপদ। তবে গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে বসবেন না এবং ধাতুর তৈরি কোন কিছু স্পর্শ করে থাকবেন না।
৩. আগেই বলেছি এদেশে ঘরের ভিতরে থেকেও ২২ শতাংশ মানুষ মারা গিয়েছে। কাজেই ঘরে থাকলেও কিছু বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। যেমনঃ
- আপনার ঘর যদি ফাঁকা জায়গায় হয় তবে চারপাশে বৃক্ষ জাতীয় গাছ লাগান।
- বাড়ী বানানোর সময় Earthing System রাখুন।
- দরজা জানালা থেকে দূরে থাকুন।
- ঝড় শুরু হবার আগেই ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতির কানেকশন খুলে রাখতে হবে।
- পানির কলের হাত লাগাবেন না। হাত ধোয়া, গোসল – ইত্যাদি থেকে বিরত থাকুন।
- টেলিফোন ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। মোবাইল ব্যবহার করা যাবে কিনা সেব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের দ্বিমত রয়েছে। তবে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ব্যবহার না করাই নিরাপদ।
- আবহাওয়ার খবরাখবর নিতে ব্যাটারীচালিত রেডিও ব্যবহার করুন।
- ইমার্জেন্সী কিট (Emergency Kit) তৈরি করুন যেখানে টর্চলাইট, ব্যাটারী, ফার্স্ট এইডকে অগ্রাধিকার দিন।
৪. আপনি নৌকায় থাকলে ঝড় দেখা মাত্র নৌকা পাড়ে ভিড়িয়ে নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিন।
৫. যদি সাতার কাটতে থাকেন তাহলে জলদি উঠে পড়ুন। ঝড় হয়ত অনেক দূরে মনে হবে। কিন্তু বজ্র ২০ মাইল দূর থেকেও আপনাকে আঘাত করতে পারে।
৬. যেসব কৃষক মাঠে কাজে ব্যস্ত থাকবেন তাদের উচিৎ হবে হাতের দাঁ-কাঁচি সব ফেলে দিয়ে দু’পায়ে ভর দিয়ে কু’জো হয়ে বসে পড়া।
৭. ঝড়ের সময় যদি দেখেন আপনার মাথার চুল, হাতের পশম দাঁড়িয়ে পড়েছে তাহলে বুঝতে হবে কাছাকাছি বাজ পড়তে পারে। সাথে সাথে কুজো হবে বসে পড়ুন। দু’হাতে কান চাপা দিন।
৮. আপনার কাধে যদি ব্যাকপ্যাক থাকে তাহলে ব্যাকপ্যাক ফেলে দিন। কারন ব্যাকপ্যাকে থাকা ধাতব কোন কিছু বজ্রপাতকে আকৃষ্ট করতে পারে।
৯. শেষ বজ্রপাত শোনার পর অন্তত ৩০ মিনিট অপেক্ষা করুন বাইরে বের হবার আগে।
১০. জরুরী কোন কারনে যদি ঝড়ের সময় ঘর থেকে বের হতেই হবে তবে লোহা বা অন্যকোন ধাতুর তৈরি কোন কিছু সাথে রাখবেন না। এমনকি ছাতাও না।
নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহনের সাথে সাথে জনগনকে আমাদের সচেতন করতে হবে। তাহলে আমেরিকার মত আমাদের দেশেও বজ্রাঘাতে মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসবে। সেই সাথে বজ্রাঘাত প্রাপ্ত ব্যাক্তিকে প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে।
বজ্রাঘাত প্রাপ্ত ব্যক্তিকে উদ্ধার করার পূর্বে নিজের সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আরেকজনকে সহায়তা করতে যেয়ে নিজে আহত হবার মানে নেই। ঝড় যখন শান্ত হতে শুরু করবে তখন আমরা উদ্ধারে অংশগ্রহন করব। সম্ভব হলে জরূরী নাম্বারে ফোন করে এম্বুলেন্স, চিকিৎসকের ব্যবস্থা করতে হবে। বজ্রপাতে যদি কারো কাপড় চোপড় পুড়ে যায় তাহলে একান্ত প্রয়োজন না হলে কাপড় খুলে না ফেলাই ভাল। প্রায়ই বজ্রাঘাত প্রাপ্ত ব্যক্তির হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে তার কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস এবং দু’হাত দিয়ে বুকের উপর চাপ দিয়ে হৃৎপিন্ড সচল করার চেষ্টা করতে হবে। বজ্রাঘাত প্রাপ্ত ব্যাক্তি যেন সহজেই বজ্রাঘাতের ধাক্কা সামলে উঠতে পারেন সেজন্য থাকে মাটিতে এমনভাবে চিৎ করে শুইয়ে দিতে হবে যেন শরীরের তুলনায় মাথা একটু নিচু থাকে।
সচেতন হউন, অন্যকে সচেতন করুন। বজ্রপাতে সুরক্ষিত থাকুন।
তথ্যসূত্রঃ
২. রয়টার্স
৩. নাসা
৪. Wikihow