২৩ অক্টোবর, ২০১২, নীললোহিত অর্থাৎ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চলে গেছেন। দীর্ঘ ষাট বছর ধরে কলমের জাদুতে বাঙালি পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন যিনি, তাঁর মৃত্যুদিবসে লিখতে ইচ্ছে করছে অনেক কিছু।
(সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ঃ ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ – ২৩ অক্টোবর ২০১২)
সুনীলের সাথে আমার পরিচয়টা খুব নাটকীয়।
তখন সবে লেখালেখি শুরু করেছি। আনাড়ি হাতে একটু আধটু গল্প লেখার চেষ্টা করি। এক ছোট ভাইয়ের অনুরোধে একটা প্রতিযোগিতায় গল্প দিয়ে কী করে যেন দ্বিতীয় হয়ে গেলাম। প্রতিযোগিতারর কর্ণধার একটা নির্দিষ্ট মূল্যের মধ্যে পছন্দের বইয়ের নাম জিজ্ঞেস করলো। কোন বইয়ের কত দাম জানি না বলে হরহর করে একগাদা বইয়ের নাম বলে গেলাম। অল্প কদিন বাদেই কুরিয়ার থেকে ফোন এলো। গিয়ে দেখি ইয়া মোটা এক পার্সেল এসেছে। তর না সওয়ায় বাসায় যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা না করে কুরিয়ার অফিসেই খুলে ফেললাম মোড়ক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ঐতিহাসিক উপন্যাস, “প্রথম আলো”।
লেখালেখি করে জীবনে প্রথমবারের মতো পাওয়া পুরস্কারের বই দেখে আমার চক্ষুচড়ক গাছ! এত দামী বই তো আমার পাওয়ার কথা না! এত খুশি এত উচ্ছ্বাস আর কখনো হয়নি। উড়তে উড়তে বাসায় চলে এলাম।
কিন্তু ওটুকুই। আড়াই বছর পর্যন্ত এটা আমার বইয়ের আলমারিতে পড়ে রইল। মাঝে একবার এক বান্ধবী বইটা নিয়ে পড়েছিল, তারপর আবার যেখানেরটা সেখানেই ফিরে গেল। ১১২২ পৃষ্ঠার মোটা বই বলে, ওটা পড়তে শুরু করার সাহস হলো না।
কাহিনি সংক্ষেপে লেখা আছে, প্রথম আলো বর্ণাঢ্য, বেগবান এক ঐতিহাসিক উপন্যাস। যার মূল নায়ক সময়।
১৮৮৩-১৯০৭; এই চব্বিশ বছর নিয়ে এই উপন্যাসের কাহিনী এগিয়েছে। এই চব্বিশ বছরে ভারতবর্ষে তথা বাংলায় এত এত বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব জন্মেছেন আর একই সময়ে পৃথিবীকে মাতিয়ে গিয়েছেন, ভাবতেই অবাক লাগে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র, জগদীশ চন্দ্র বসু, মাহাত্মা গান্ধী, স্বামী বিবেকানন্দ… কার কথা ছেড়ে কার কথা বলব! এঁদের কারোর সম্পর্কেই বেশি কিছু জানতাম না। এই একটা বইই এঁদের চেনাতে যথেষ্ট।
আবার এঁদের নিজের মধ্যে দেখা সাক্ষাত, আলাপচারিতাও ছিল! একদিকে বঙ্কিমবাবু বিশ্বকবির লেখা তেমন পছন্দ করতেন না, অন্যদিকে রবীবাবু বিবেকানন্দকে এড়িয়ে চলতেন। আবার জগদীশ চন্দ্রের সাথে বিশ্বকবির খুব ভাব ছিল! কী অদ্ভুত!
পুরো উপন্যাস জুড়ে বিশ্বকবি ছিলেন স্বদর্পে। কবিবরের সম্পর্কে ভালোমতন কিছুই জানা ছিল না আমার। অনেক অনেক কিছু জেনেছি তাঁর সম্পর্কে। বইয়ের চ্যাপ্টারে চ্যাপ্টারে কবিবরের গান। তিনি নিজে গাইতেনও খুব চমৎকার। বই পড়ে ওঁর নিজের গাওয়া একটা গান শুনতে ইচ্ছে করছিল।
প্রথম খন্ডে কাদম্বরী দেবীর জন্য একটা চাপা কষ্ট ভিতরে ভিতরে গুমরে মরেছে। এই বই পড়ার আগে উনার সম্পর্কে ধোঁয়াশা-টাইপ কিছু কথা জানতাম। ভেতরের কাহিনী জেনে খুব খারাপ লেগেছে ওঁর জন্য।
স্বামী বিবেকানন্দের কিছু কিছু ব্যাপার খুবই অদ্ভুত লেগেছে। প্রথম জীবনে তিনি সবসময় রামকৃষ্ণর সাথে কালীপূজার বিরুদ্ধে, অবতারবাদের বিরুদ্ধে লজিক্যালি তর্ক করতেন। পরে তিনিই কী করে অবতারবাদ মেনে নিলেন? কালীপূজারি হলেন? বিবেকানন্দ এই ব্যাপারে যে ব্যাখ্যা দিলেন, সেটায় কেমন ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।
জগদীশচন্দ্র বসুর চরিত্রটি এমনভাবে উপন্যাসে এসেছে, প্রথমে আমি ঠিক বুঝতেই পারিনি এটাই আমাদের বিজ্ঞানী জগদীশ। জগদীশের সম্পর্কে আমেরিকান আইরিশ মার্গারেটের জবানীতে যখন পড়ি, এরকম ত্যাগ শুধু কোনও ভারতীয়দের পক্ষেই সম্ভব। ভারত স্বাধীন না হলে তার এইসব সুসন্তান পৃথিবীতে যথাযোগ্য মর্যাদা পাবে কী করে? – তখন কেমন যেন কেঁপে কেঁপে উঠেছিলাম। আমরা আমাদের কৃতি সন্তানদের ত্যাগের ব্যাপারে কতটুকু জানি?
বড় লাট কার্জনের কাহিনি পড়ে রাগে গা জ্বলছিল। অখন্ড বাংলাকে ভাঙ্গনের বীজ তো এই সাম্রাজ্যবাদী অহংকারী শোষকটাই বুনেছিল! এর নামে ঢাকা ভার্সিটির হল কেন হয়েছিল? চাটুকারিতা প্রকাশ করার জন্য, না?
যদিও তার কিছু কিছু ভালো দিক ছিলো। কিন্তু, সেটা মাথায় তুলে রাখার মতো নয়।
বঙ্গভঙ্গ নিয়ে আন্দোলনের জায়গা টুকু পড়তে গিয়ে আমি প্রচন্ডভাবে শিহরিত হয়েছি। ঠিক যেন চোখের সামনে দেখছিলাম, কোন রাজনৈতিক দলের মুখাপেক্ষী না হয়ে হিন্দু মুসলিম একাত্ম হয়ে প্রতিরোধ আন্দোলন করছে!
ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রতি আমার অন্যরকম এক দূর্বলতা আছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অদ্ভুত চমৎকার কায়দায় ইতিহাসকে তাঁর উপন্যাসে ধারণ করেছেন। কী করে, কোথা থেকে উপন্যাসের কোন অংশে ইতিহাসের বীজ বুনতে হয়, তিনি খুব ভালো করেই জানতেন। তিনি খুব ভালো করে জানতেন, বাঙালি পাঠক নিজের দেশের ইতিহাসকে পুনরাবিষ্কার করে কতোটা আনন্দিত ও সমৃদ্ধ হবে। আমি যেন ঐতিহাসিক এই উপন্যাসেও থ্রিল খুঁজে পেলাম। এত মোটা একটা বই, স্বাভাবিকভাবেই যখন তখন মনোযোগ সরে যেতে বাধ্য। কিন্তু লেখক আশ্চর্য দক্ষতায় পাঠককে ধরে রেখেছেন উপন্যাসের প্রতি পরতে পরতে। ১১২২ পৃষ্টার এই বিশাল কলেবরের বইটা পড়তে আমার সময় লেগেছে নয় দিন।
এই ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়ে আমি সুনীলের ভক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু আমায় সুনীল-জ্বরে ধরেছিল তাঁর মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসগুলো পড়ে।
অথচ কী অদ্ভুত! আমার গত সেপ্টেম্বর মাস ছিলো সুনীলময়। এর আগে দিনের পর দিন সুনীলের ওই বইগুলো আমার আলমারিতে পড়ে ছিল। ছুঁয়েও দেখিনি। কেন যেন পশ্চিম বাংলার লেখকদের সাহিত্যের প্রতি কোনও টান অনুভব করতাম না। অথচ রিডার্স ব্লকে থাকা আমি পড়ব পড়ি করে ঈদের আগেরদিন নিতান্তই অবহেলায় “নানা রসের আটটি উপন্যাস” এর একটা উপন্যাস পড়তে শুরু করেছিলাম, এরপর আর থামতে পারিনি। ওতে ছিলো- সুখ অসুখ, সরল সত্য, কেন্দ্রবিন্দু, কবি ও নর্তকী, স্বপ্ন লজ্জাহীন, হীরক দীপ্তি, মুক্তপুরুষ এবং ফুলমণি উপখ্যান।
সবগুলোই তীব্র মাত্রায় মনস্তাত্ত্বিক। একেকটা উপন্যাস পড়ে একেক রকম ঘোরে ডুবে ছিলাম। উপন্যাসগুলো আমার চিন্তাভাবনাই বদলে দিচ্ছিল।
এরপর পড়েছি বুকের মধ্যে আগুন – এটা স্বদেশীয়াদের নিয়ে লেখা। সুনীলের ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস তো সেরা-আগেই বলেছি। এটা পড়ে খুব আক্ষেপ হয়েছে। আরেকটু বড় হলো না কেন বইটা?
তাই বাড়ি ফিরে এসে দেশভাগ নিয়ে সুনীলের বিশাল কলেবরের দুইটা বই ধরেছি। একটা হলো, একা ও কয়েকজন – পাঁচশ পৃষ্ঠার এই বইটার কাহিনি যেহেতু ঐতিহাসিক, গল্প টেনে পড়েছি। ফিনিশিংএ সেই পুরোনো আক্ষেপ। এতো তীব্র কষ্ট লেগেছি অতো কমবয়সী বিপ্লবী সূর্যের জন্য। ছেলেটা জীবনে কিছুই পেল না।
সুনীলের জন্ম হয়েছিল অখন্ড ভারতবর্ষের ফরিদপুরে। কিন্তু দেশভাগের পর তাঁকে এই বাংলা ছেড়ে ওই বাংলায় পাড়ি জমাতে হয়েছে। তকমা পেতে হয়েছে রিফিউজি বাঙাল হিসেবে। তাঁর মধ্যে দেশভাগের যন্ত্রণাটা তাই এতো প্রখর ছিলো। সেই সাথে সুনীল ছিলেন চরিত্র-সৃষ্টিতে কুশলী কারিগর। এই উপন্যাসগুলো লেখার সময় তিনি নিজের প্রতি কোনও মমতা দেখাতেন না। প্রচুর বই সংগ্রহ করে রিসার্চ করতেন। এমনকি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লেখালেখি চালিয়ে গেছেন। আর এসব মিলিয়েই সুনীলের ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলোসহ তার সমস্ত সৃষ্টিগুলো ছিলো অসাধারণ।
আগে ভাবতাম আমার রিডার্স ব্লক একমাত্র হুমায়ূন আহমেদই ছুটাতে পারেন। এখন দেখি, না! রিডার্স ব্লক ছুটানোর সাথে সাথে বই পড়ার পুরোনো রিদমটাও ফিরে পেয়েছি সুনীলের মাধ্যমে। খুব অল্পদিনেই আমি সুনীলের পাড় ভক্ত হয়ে গিয়েছি।
নীললোহিতের সেরা নয়টি উপন্যাসে প্রকাশকের লেখা ভূমিকায় জানতে পেরেছি সুনীল সম্পর্কে আশ্চর্য কিছু তথ্য। লেখালেখির ব্যাপারে উনি ছিলেন খুবই সাবধানী। পাঠকচিত্ত জয় করার মন্ত্র জানা ছিলো তার। আর ছিল নিজের কল্পনাশক্তির উপর অগাধ আত্মবিশ্বাস।
সুনীল সবসময় বলতেন, ‘সাহিত্যে নতুন কিছু, মৌলিক কিছু লিখতে না পারলে, লেখার কোনও অর্থ হয় না। আমরা যখন প্রথম লিখতে আসি, তখন নতুন কিছুই করতে চেয়েছিলাম।’
প্রচুর গদ্য লিখলেও নিজেকে আগে তিনি “কবি” ভাবতে পছন্দ করতেন। কবিদের সঙ্গে ছিলো তাঁর বেশি সখ্যতা।
তীব্র বইয়ের নেশা থাকা সত্ত্বেও অদ্ভুত এক সাইকোলজির প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গের লেখা আমি পড়তাম না। সেই সাইকোলজির প্রভাব থেকে সুনীলই আমাকে মুক্ত করেছেন।
অত্যন্ত উদার ও মুক্তমনা এই লেখক চলে গেছেন আজ পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তবুও হাজার বছর ধরে তিনি বেঁচে থাকবেন বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে।