বল্,গোলাপ,মোরে বল্,
তুই ফুটিবি, সখী, কবে ।
ফুল ফুটেছে চারি পাশ, চাঁদ হাসিছে সুধাহাস,
বায়ু ফেলিছে মৃদু শ্বাস,পাখি গাইছে মধুরবে—
তুই ফুটিবি, সখী কবে ॥
গোলাপ ফুলের সাথে প্রকৃতির যে সুমধুর তান তা কবিগুরুর এই লেখাতেই সহজে প্রতীয়মান। আধুনিক মানুষের কাছে সৌন্দর্যের ও ভালোবাসার প্রতীক হচ্ছে গোলাপ। এই ফুল কে না ভালবাসে। গোলাপ পাঁপড়ির গড়ন ও বিন্যাসে এমনই নান্দনিকতা রয়েছে যা মানুষকে আকৃষ্ট করে। প্রায় ১০০ প্রজাতির বিভিন্ন বর্ণের গোলাপ ফুল রয়েছে। শুধু লাল গোলাপই নয় বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন রঙের গোলাপের সঙ্গে বদলে যায় গোলাপের ভাষা এবং আবেদন। মানুষের হৃদয় জয় করে নেয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে এই গোলাপের।শুধু সৌন্দর্য বা সুগন্ধের জন্য নয়, ব্যবহারেও এই ফুলের কাছে হার মানবে সকলেই। উপহার হোক, সজ্জা বা রান্নাঘরে কিংবা মৃত কোন মানুষের শোক জানাতে, কোথায় নেই এই গোলাপের ব্যবহার। এই ফুলের বিচরণ সর্বত্র। আসুন জেনে নিই গোলাপের এমনই ১০ ব্যবহার।
১। প্রিয়জনকে গোলাপ উপহার
প্রিয়তমাকে প্রথম দেখায় বা ভ্যালেন্টাইন’স ডে তে ফুল উপহার দিতে চান? একগুচ্ছ লাল গোলাপের থেকে বিকল্প কিছু কি হতে পারে? ভালবাসার ভাষা বুঝতে ও বোঝাতে পারে গোলাপ।প্রেমিক-প্রেমিকা হোক বা যে কোনও প্রিয়জনকে শুভেচ্ছা জানাতে গোলাপের মত উপহার আর হয় না।
২। নারীর খোঁপায় গোলাপ
একজন নারীর রূপ ও সৌন্দর্য বহুগুনে উদ্ভাসিত হয় যদি তার চুলের খোঁপায় থাকে গোলাপ। দেশীয় সাজ সাজুন বা ওয়েস্টার্ন গাউন। যে কোনও সাজেই চুলে লাল গোলাপ আপনার চেহারাই বদলে দেবে। কবির ভাষায় তাই বলতে হয়-
খোঁপার ওই গোলাপ দিয়ে
মনটাকে কেনো এতো কাছে টানলে,
পারবে কি বাসতে ভালো আমাকে জানলে
আমাকে তেমন করে জানলে ।।
৩। অ্যারোমাথেরাপি
দীর্ঘ সময় অফিসের কাজের পর কিংবা যানজটে নাকাল হয়ে প্রচন্ড গরমে বাড়ি ফিরে গোলাপের জলে গা ডুবিয়ে রাখুন। তাছাড়া পট পৌরিতে বা যে কোনও গামলায় জলের মধ্যে গোলাপের পাঁপড়ি ভাসিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিন। দেখবেন পুরো ঘর সুগন্ধে ভরে যাবে। স্ট্রেস, ক্লান্তি কেটে আপনারে সতেজ করে তুলবে রোজ অ্যারোমাথেরাপি। প্রাচীন গ্রিক এবং রোমান সভ্যতায় রাজা রানিদের গোসলের পানিতে দেওয়া হতো গোলাপের পাপড়ি। গোলাপ ফুলের সুবাসকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রী যেমন:পারফিউম,সাবান ইত্যাদি তৈরি করা হয়। গোলাপে গেনারিয়ল নামে একটি অ্যারোম্যাটিক অ্যালকোহল জাতীয় পদার্থ পাওয়া যায় যা এই সুগন্ধের জন্য দায়ী। মেয়েদের অন্তর্বাস ও ন্যাপকিনেও গোলাপের সুগন্ধ ব্যবহার করা হয়।
৪। রূপচর্চায় গোলাপ
ত্বক: ত্বকে মসৃণ ভাব আনতে গোলাপ জলের জুড়ি নেই। গোলাপে থাকা তেল ত্বকের স্বাভাবিক আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। যাদের ত্বক খুব স্পর্শকাতর, তাদের জন্য গোলাপজল বেশি উপকারী। প্রতিদিন রোজ ওয়াটার ত্বকের জন্য দারুণ ভাল কাজ করে। শুধু মুখ ধোওয়া নয়, রোজ ওয়াটারে স্নানও করতে পারেন।
চোখ : গোলাপের পাপড়ি চোখের নিচের কালচে ভাব দূর করে দেয়। গোলাপের পাপড়ি পানিতে সেদ্ধ করে রেখে দিন। এরপর সেটা ঠান্ডা করে নিন। এরপর একটি তুলা গোলাপের পানিতে ভিজিয়ে চোখে দিয়ে ১৫ মিনিট চোখ বন্ধ করে রাখুন। এভাবে প্রতিদিন ব্যবহার করলে চোখের নিচের ডার্ক সার্কেল দূর হয়ে যাবে।
ঠোঁট : ঠোঁটের রঙ কালো বলে অনেকেরই চিন্তা থাকে। গোলাপের পাপড়ি পিষে এর সাথে মেশান দুধের সর এবং মধু। মিশ্রণটি ঠোঁটে ১৫-২০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। নিয়মিত ব্যবহারে ঠোঁট হয়ে উঠবে গোলাপি এবং তুলতুলে।
মাসাজ: স্ট্রেস ও ব্যথা উপশমে এসেনশিয়াল অয়েল দিয়ে মাসাজ করতে পারেন।
মাথা: মাথার ত্বক চুলকে চুলকে অতিষ্ঠ আপনি। সেই সাথে বাড়ছে খুশকির যন্ত্রণা? গোলাপ জল মালিশ করতে পারেন। চুলকানি কমে আসবে। শুধু তাই নয়, চুলের বৃদ্ধিও হবে দ্রুত।
পেডিকিওর: গোলাপের পাঁপড়ি ভাসা জলে ডুবিয়ে পেডিকিওর করতে পারেন। এতে পা যেমন পরিষ্কার হবে, শরীর, মনও ফ্রেশ লাগবে।
টোনার: গোলাপ জল প্রাকৃতিক টোনার হিসেবে কাজ করে। দিন শেষে বাড়ি ফিরে গোলাপ জলে ভিজিয়ে নিন এক টুকরো তুলো এবং ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মুখ পরিষ্কার করে নিন। এতে মেকআপ তোলা এবং মুখ পরিষ্কারের কাজটাও হয়ে যাবে।
সানস্ক্রিন হিসেবে : গোলাপের পাপড়ি প্রাকৃতিক সানস্ক্রিন হিসেবে উপকারী। বাইরের কড়া রোদে বের হওয়ার আগে গোলাপের রস, গ্লিসারিন ও শসার রস মিশিয়ে ত্বকে লাগিয়ে নিন। রোদে পোড়ার থেকে অনেকটাই রক্ষা পাবেন এই মিশ্রণটি ব্যবহার করে।
অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল: গোলাপের আছে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল । ফলে ব্রণের যন্ত্রণা দূর করতে গোলাপ জল ব্যবহার করতে পারেন। মেথি পেস্ট এবং গোলাপ জল মিশিয়ে তৈরি করতে পারেন ফেস প্যাক যা দারুণ কাজ করবে। ত্বকে জ্বালাপোড়া, লালচে ভাব, একজিমা এবং সোরিয়াসিসের সমস্যা কমাতেও কাজে লাগে এটি।
৫। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গোলাপ
- – চিকিৎসাক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী গোলাপের রয়েছে উল্লেখযোগ্য ব্যবহার। গোলাপ ভিটামিন এ,সি, বি৩ ও ই এর অন্যতম উৎস। গোলাপজল “রিলাক্সিং এজেন্ট” হিসেবে ব্যবহৃত হয় যা স্নায়ুগুলোকে সতেজ করে।
- – গোলাপ পাপড়ির চা আলসার, অ্যাজমা, ডিহাইড্রেশন সহ বিভিন্ন রোগ নিরাময় করতে সহায়তা করে। গোলাপ চা পিত্তথলি ও যকৃতকে ভালো রাখে। এছাড়াও গোলাপের চা সকালে নিয়মিত পান করতে পারলে অতিরিক্ত ওজন ঝরানো সহজ হবে। কারণ এটি মেটাবলিজম বাড়ায়। শরীর থেকে দূর করে ক্ষতিকর টক্সিন। গোলাপের পাপড়ির চা পান করলে তা লিভার এবং গোল ব্লাডার সুস্থ রাখে। কমায় বিভিন্ন ইনফেকশন। হালকা গলা ব্যাথা এবং জ্বরেও এটি আরাম দেয়।
- – পাইলসের উপশম করে। কারণ গোলাপের পাপড়িতে থাকে অনেকটা ফাইবার এবং এটি হজমে সহায়তা করে। ৫০ মিলি. পানির সাথে এক মুঠো গোলাপের পাপড়ি পিষে নিন এবং খালিপেটে পান করুন। ৩ দিন নিয়মিত পান করলে পাইলসের রক্তপাতের সমস্যার উপশম হবে।
৬। খাবারের রেসিপিতে গোলাপ
এই সময়ের নানারকম উপাদেয় খাদ্য তৈরিতে গোলাপের ব্যবহার সত্যিই ঈর্ষনীয়। খাদ্য হিসিবে অনেক দেশেই গোলাপের পাপড়ি ব্যবহৃত হয়। সন্দেশ, কেক বা সিরাপে রোজ ফ্লেভার হিসেবে যেমন গোলাপ ব্যবহার করতে পারেন, তেমনই খাবার পরিবেশনে গোলাপের পাঁপড়ি সাজিয়ে গার্নিশও করতে পারেন । গোলাপের পাপড়ি থেকে জ্যাম,জেলি প্রস্তুত করা হয়। পার্সি,চীন ও ভারতে গোলাপজলের প্রচলন রয়েছে। বিরানি, পোলাওতে সুগন্ধ আনয়নে গোলাপ জল ব্যহৃত হয়।
৭। ডেকরেশনে গোলাপ
বিয়ের আসর হোক, ফুলসজ্জার খাট বা অফিশিয়াল ডিনার কিংবা তোড়ন। সাজানোর উপকরন হিসেবে গোলাপের জনপ্রিয়তা সকলকে হার মানায়।
৮। প্রপোজ
আধুনিক এই সময়ে মানুষের চিন্তা-চেতনায় নানা পরিবর্তন এসেছে।সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে প্রেমের ভাষা, বদলেছে প্রপোজের ধরন। কিন্তু এখনও কারোর আবেগ, প্রেম নিবেদন, ভারোবাসার স্বীকৃতি সব কিছুতেই ভালোবাসার ফুল গোলাপের বিকল্প কিছু নেই। তাই ‘ভালবাসি’ জানাতে লাল গোলাপের আবেদন আজও চিরন্তন।
৯। নতুন জীবনের শুরু বা অর্নামেন্ট হিসেবে
একজন নারীর নতুন জীবন শুরু হয় বিয়ের পর। তাই গায়ে হলুদ, এনগেন্জমেন্ট রিং পরানোর দিন কনেকে সাজানোর উপকরন হিসেবে, তার অর্নামেন্টস হিসেবে গোলাপের ব্যবহার আজ সর্বদাই স্বীকৃত।নতুন জীবন শুরুর প্রতীক হিসেবে বিয়ের সময় কনের হাতে দেওয়া হয় একগুচ্ছ লাল গোলাপ যা তার সংসার জীবনের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য ও সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত। এছাড়াও অর্নামেন্টারি উদ্ভিদ হিসেবে গোলাপের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।
১০। শোক জ্ঞাপনে গোলাপ
আমরা সাধারণত শোক জ্ঞাপনে সাদা ফুল ব্যবহার করে থাকি। আধ্যাত্মিকতারও প্রতীক এই সাদা গোলাপ। মৃতদেহ, সমাধির উপর সাদা গোলাপ রাখার অর্থ তাকে মিস করা। মৃত ব্যক্তিকে স্মরণ করার জন্য তাই আজও সাদা গোলাপের ব্যবহার প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসছে ।
লেখিকা সম্পর্কেঃ পাপিয়া দেবী অশ্রু। শখ -বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে বেড়ানো, গান করা, ছবি আঁকা। লেখা – লিখিতে বেশ আগ্রহ থাকলেও তেমন ঘটা করে হয়ে উঠেনি কখনও। শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত আছি। ইচ্ছে আছে একেবারেই নতুন কিছু করার, যা বিশ্বজুড়ে সবার দেখার মতই। অদ্ভুত ইচ্ছে!!!