সুপ্রাচীনকালে যখন প্রযুক্তির ব্যবহার ছিল না তখন মধ্যপ্রাচ্যের মরুময় অঞ্চলের মানুষেরা তাদের ঘরবাড়িকে ঠাণ্ডা রাখতে এক অভিনব উপায় বের করে। মরুভূমির চরমভাবাপন্ন এলাকার বৈশিষ্ট্য হল দিনের বেলা প্রচণ্ড গরম আর রাতে শীত। কাজেই দিনের বেলা ঘর কেবল ঠাণ্ডা রাখলেই চলবে না রাতে যেন ঘর গরম থাকে সে ব্যবস্থাও করতে হবে। তখনকার যুগে Air Conditioner ছিল না। মানুষ ঘরবাড়ি নির্মাণ করত মোটা চুনাপাথরের দেয়াল দিয়ে যার মধ্যদিয়ে তাপ পরিবহন কম হত। দেয়ালগুলো হত উঁচু যেন মাটিতে লম্বা ছায়া পরে। জানালা দিয়ে যেন রোদ কম আসে সেজন্য জানালাগুলো হত ছোট, দেয়া হত সূর্যের বিপরীত দেয়ালে।ছাদের উপর লম্বা চিমনি তৈরি করা হত যার উপরের দিক ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা থাকত।
ভেন্টিলেশনের এই পদ্ধতিকে ফার্সি ভাষায় বলা হয় بادگیر (bâdgir)। bad হল wind আর gir হল catcher। এই Windcather গুলোই ঘর ঠাণ্ডা রাখতে আরবের লোকেরা ব্যবহার করত।
Windcatcher এর ইতিহাস হাজারো বছরের। প্রাচীন মিশরিয় ফারাওদের সময়েও মানুষ Windcatcher এর ব্যবহার জানত।
তবে সর্বপ্রথম কোথায় এর ব্যবহার শুরু হয়েছে তা নিয়ে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় না। কেউ কেউ ধারনা করেন বহুযুগ আগে ইরানেই সর্বপ্রথম Windcatcher এর প্রচলন শুরু হয়। এছাড়াও পারসিয়ান স্থাপত্যশিল্প সমৃদ্ধ দেশগুলোতে যেমন বাহরাইন, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানে Windcatcher এর ব্যবহার দেখা যায়।
ইরানের Yazd শহরের অধিবাসীরা উন-বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিক থেকেই Windcatcher এর ব্যবহার শুরু করে। ইরানের প্রাচীনতম এই শহরের বাসিন্দারা ঘর ঠাণ্ডা করার এই বিকল্প উপায়টি আজও ব্যবহার করে আসছে। যুগে যুগে আধুনিকায়নের মাধ্যমে Windcatcher গুলো বর্তমানে এক দৃষ্টিনন্দন রূপ পেয়েছে। এই বাতাসের ফাঁদ কয়েকধরণের হয়ে থাকে। একমুখী, দ্বিমুখী, বহুমুখী। একমুখী Windcatcher গুলোর মিনারের মুখ একদিকে খোলা থাকে। স্বভাবতই দ্বিমুখীগুলো দু’দিকে খোলা আর বহুমুখীগুলো চতুর্দিকে/আট দিকে খোলা থাকে। ইরানের Windcatcher গুলো সাধারণত দু’মুখো,চতুর্মুখো এবং অস্টমুখো হয়ে থাকে যেন যে দিক থেকেই বাতাস প্রবাহিত হোক না কেন ভিতরে প্রবেশ করতে পারে।
এবার দেখা যাক এরা কিভাবে কাজ করে।
Windcatcher গুলোর কেমন হবে সেটা সংশ্লিষ্ট এলাকার বাতাসের গতিপ্রকৃতির উপর নির্ভর করে। যদি বাতাস একদিকে থেকে প্রবাহিত হয় তাহলে Windcatcher গুলো একমুখি করে নির্মাণ করা হয়। এই ধরনের Windcatcher গুলোর মিনার লম্বায় ছোট হয়। ইরানের Yazd শহর থেকে ৫০ কিলো দূরে অবস্থিত Meybod শহরে এধরনের Windcatcher দেখা যায়। খোলা মুখ দিয়ে যেন ধুলো-বালি প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য Windcatcher গুলোর মুখ বাতাসের বিপরীতমুখী করা হয়। ভাবছেন বাতাসের বিপরীতমুখী হলে বাতাস প্রবেশ করে কিভাবে? আসছি সে কথায়।
সেসকল স্থানের বাতাসের গতির দিক পরিবর্তন হয় সেখানে চুতুর্থমুখী বা অষ্টমুখী করে Windcatcher গুলো বানানো হয়। Windcatcher গুলো তিনভাবে কাজ করতে পারে। প্রথমত, বাতাস সরাসরি Windcatcher দিয়ে প্রবেশ করবে এবং প্রবাহিত বাতাসের কারণে গরম কম লাগবে। দ্বিতীয়ত, Windcatcher এর চিমনি বাতাসের বিপরীত মুখী থাকে এবং বাইরের বাতাসের টানে অনেকটা Ejector এর মত ভিতরের বাতাস বের হয়ে আসে। বাড়ি নিচে প্রবাহিত পানির ধারা থাকে এবং অন্য একটি পাইপলাইন দিয়ে গরম বাতাস সেই পানির সংস্পর্শে এসে ঠাণ্ডা হয়। চিমনি দিয়ে বাতাস বেড়িয়ে যাবার কারণে বাড়ির ভিতরে বাতাসের চাপ কমে যায়। ফলে বাড়ির নিচের পথ দিয়ে পানির স্পর্শে ঠাণ্ডা হওয়া বাতাস ঘরে প্রবেশ করে ঘরকে ঠাণ্ডা রাখে। তৃতীয়ত, যেখানে জানালা অথবা বাড়ির মাটির নিচে জলাধার নেই সেখানে Windcatcher গুলো সৌর চিমনির মত কাজ করে। ঘরের ভিতরের গরম বাতাস তুলনামূলক হালকা হওয়ায় তা উপরের দিকে উঠে যায় এবং চিমনি দিয়ে বের হয়ে যায়। ফলে ঠাণ্ডা বাতাস ভিতরে আটকা পড়ে।
ইরানের পুরনো শহরগুলোতে Windcatcher এর ব্যবহার বেশি। বাড়িঘর, মসজিদ, পানি সংরক্ষণাগারে Windcatcher আছেই। ইরানের মধ্যপ্রদেশের দিন-রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য অনেক বেশি। দিনের বেলায় প্রচণ্ড গরম আর রাতে ঠাণ্ডা। সারাদিনই বাতাস খুব শুষ্ক থাকে। সেখানকার কৃত্রিম জলাধারসমূহ Windcatcher সহ নির্মাণ করা হয়। এতে প্রচণ্ড গরমের সময়েও পানি থাকে হিমশীতল।
পরিবেশ-বান্ধব বিধায় ধীরে ধীরে পশ্চিমেও Windcatcher জনপ্রিয় হচ্ছে। যুক্তরাস্ট্রের উতাহ প্রদেশের Zion National Park পার্কে দর্শনার্থীদের বিশ্রামের রুমটি Windcatcher সহ তৈরি করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। পরিবেশ রক্ষায় মানুষ এখন অনেকটাই সতর্ক। কাজেই আমরা ধরে নিতে পারি দিন দিন এই প্রাকৃতিক Air Cooler এর ব্যবহার বেড়ে যাবে। আশাকরি অদূর ভবিষ্যতে আমাদের বসতবাড়িও এর আওতায় চলে আসবে।