একদম সময় নেই, সারাদিন নাকমুখ গুজে খাতা কাটছি। ডেডলাইন কাছিয়ে আসছে, দুয়েকদিনের মধ্যেই সব খাতা দেখে মার্ক্স জমা দিতে হবে। ক্লাস টেনের দুজন ছাত্রী টিচার্স রুমের সামনে এসে বললো, ‘ম্যাম, আসবো?’
মাথা নেড়ে সায় দিলাম। রুমে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। ওরা স্কুলের করিডরের দিকে একবার চোরা নজর দিয়ে আমার খুব কাছে এসে বললো, ‘ম্যাম, আপনার কাছে আমাদের একটা রিকুয়েস্ট আছে। প্লিজ ফেলবেন না!’
চোখ তুলে বললাম, ‘শুনি, কী রিকুয়েস্ট?’
আরোও কিছুক্ষণ আদিখ্যেতা করার পর যা বললো, তার সারমর্ম হলো, তাদের অনেকদিনের সখ মাদিহা ম্যামকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাবে। ম্যাম যদি রাজি হয়, তাহলে তারা খুবই খুশি হবে। আবার ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টাও করলো এই বলে যে, তারা তো চলেই যাবে স্কুল ছেড়ে। ওদের এই ইচ্ছে যদি পূরণ না করি, তাহলে ওদের মনে কষ্ট থেকে যাবে। আমি বললাম, ‘স্যারের সাথে কথা বলে জানাচ্ছি।’
ওরা এরপর কয়েকবারে এসে আমার সম্মতি আদায় করেই ছাড়লো। পরদিনই ২৫সে ডিসেম্বরের বন্ধ। সেদিনই যেতে চায়। জিজ্ঞেস করলাম, কই যাবে? সেটাও নাকি আমারই সিলেক্ট করে দিতে হবে। আমি সাজেস্ট করলাম, জিন্দা পার্ক। ওরা নাকি এই নামই শোনেনি। আমি বললাম, যেহেতু নারায়ণগঞ্জেই আছি, এখান থেকে জিন্দা পার্কটা কাছেই হবে। ওরাও একবাক্যে রাজি।
পরদিন বন্ধ হলেও স্কুলে এলো সব টিচাররাই। সবারই খাতা দেখার তাড়া। আমিও গেলাম। কথা ছিল, ওরা সবাই সাইনবোর্ড এসে আমায় কল করবে। ওমা! এগারোটা পেরিয়ে বারোটা বেজে যায়, ওদের খবর নাই। এতো দেরি করে রওনা করলে ঘুরবে কখন?
বারোটা দশে ফোন করলো। গেলাম সাইনবোর্ড। ওখান থেকে মেঘলা বাসে গাউছিয়ার টিকিট কাটা হলো ৩০ টাকা করে। গাউছিয়ায় যেতে ঘন্টাখানেক সময় লাগলো। জ্যাম দেখে বাজারে যাওয়ার আগেই নেমে পড়লাম। যেহেতু জিন্দাপার্কে খাবার নিয়ে ঢোকার জন্য ২৫ টাকা করে চার্জ দেওয়া লাগে, তাই গাউছিয়ার একটা রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম।
খেয়ে দেয়ে লোকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, জিন্দাপার্ক যাওয়ার সিএনজি কোত্থেকে পাবো। আগেইই দেখে নিয়েছিলাম, গাউছিয়া থেকে সিএনজি যায় জিন্দা পার্কের দিকে। কিন্তু ওখানে গিয়ে শুনলাম, জিন্দাপার্কের দিকে লোক্যাল সিএনজি নাকি যায় না। রিজার্ভ যেতে দুয়েকজন যাও রাজি হয়, ভাড়া চায় ৭০০-৮০০ টাকা। বহু দামাদামি করে কার ভাড়া করা হলো ৪০০ টাকায়। আমরা ছয়জন প্রায় চাপাচাপি করেই বসেছিলাম ওতে।
বাইপাসে প্রচন্ড জ্যাম। যেতেই এতো সময় লাগছে যে সবাই রীতিমতো বিরক্ত। যেহেতু জিন্দাপার্কে যাওয়ার রেকমেন্ডেশনটা আমার ছিলো, ওরা হয়তো মনে মনে আমার মুণ্ডুপাত করছে। দেখলাম, কী এক ভাষায় যেন কথা বলছে নিজেরা। মনোযোগ দিয়ে শুনে বুঝলাম, ইলা প্রত্যয় যোগ করে নিচ্ছে প্রত্যেক শব্দে। এরপর ওদের সব কথাই বুঝেছি আর নিজে নিজেই হেসেছি। স্কুলের কয়েকজন স্যারের উপর খুব ক্ষেপা, তাদেরকে মুণ্ডুপাত করছে। এরমধ্যে একটা কথা শুনে মজা পেয়েছি। বলছে, “কোনোদিন কল্পনা করিনাই, ম্যাম যে আমাদের সাথে আসবে।” বেচারারা তো জানে না, ওদের ম্যাম কী জিনিস! ঘোরার সুযোগ এলে, মিস করবো, তা তো হয় না।
কার আমাদের জিন্দাপার্কে ঢোকার গলিতে নামিয়ে দিলো। ঢুকতেই মনে হলো, শান্তিময় একটা জায়গায় এসে ঢুকেছি। কোনো মতে একটা গাড়ি ঢুকতে পারবে, এমন রাস্তা। দুইধারে গাছের সারি। অনেক গাছ, অনেক জাতের গাছ। ১০০ টাকা করে টিকিট করে ঢুকে পড়লাম জিন্দা ঐকতান পার্কে। ২৫০ জাতের ১০ হাজারেরও বেশি গাছ আছে এখানে। রয়েছে বিশাল শালবন বিহার। যেদিকেই তাকাই সবুজের ছায়াঘেরা উদ্যান।
ঢুকতেই একপাশে ঘাসের বিছানায় ছোট্ট চারকোনা জলাধার। তার উপরে নকল কাঠের গোলাকার ব্রিজ। তার সামনেই একটা মসজিদ। আরেকটু সামনেই মঠজাতীয় কিছু একটা। রাস্তার অন্যপাশে খোলা মাঠ। আরো কিছু আছে হয়তো। আমরা একপাশ থেকে দেখতে দেখতে যাচ্ছি।
একটুখানি বন পেরিয়ে একটা কৃত্রিম লেক দেখতে পেলাম। ওখানে অনেক মানুষ, কেউ র্যাকেট খেলছে, কেউ চাদর বিছিয়ে বসে গল্প করছে। লেকের মাঝখানে একচিলতে কৃত্তিম দ্বীপ। কাঠের পাটাতন আর প্লাস্টিকের ড্রাম দিয়ে ভাসমান ব্রিজ বানানো হয়েছে। ব্রিজ দিয়ে যাওয়া যায়। বেশি লোক একসাথে ব্রিজে উঠলে ভীষণভাবে দুলে ওঠে। দ্বীপটা দারুণ। পানিতে পা ডুবিয়ে ঘাসের উপর বসে থাকা যায়। এরকম মোট পাঁচটি লেক আছে জিন্দা পার্কে। ইচ্ছা হলে লেকের পানিতে কিছুক্ষণ ভেসেও বেড়ানো যায়। তার জন্য কয়েকটি নৌকা বাঁধা আছে ঘাটে। লেকে ভেসে বেড়ানোর পাশাপাশি উপভোগ করা যাবে প্রকৃতিকে।
কাছেই কয়েকটা গাছের ওপর টংঘর। একটু উঠে বসেও থাকা যায়। আমরাও তাই করলাম। নামার সময় কাঠের সিঁড়ি বেয়ে না নেমে লাফিয়ে নামলাম।
এই লেকটার ঠিক পাশেই লালমাটির রাস্তা। রাস্তার দুই ধারে গাছের সারি।
পার্কটি কিন্তু বেশ বড়। পুরোটা মিলে ৫০ একর। হাঁটতে হাঁটতে অন্য আরেকটি লেকের পাশে বহু আকাঙ্ক্ষিত পাঠাগারটি খুঁজে পেলাম। চমৎকার স্থাপত্যশৈলীতে বানানো পাঠাগারটি ছবিতে দেখেই মুগ্ধ হয়েছিলাম। সামনাসামনি দেখেও ভালো লেগেছে। এখনো বই সংগ্রহ করেনি, তাই তালাবদ্ধ। ভাবছি, এটা চালু হলে কী দারুণ একটা ব্যাপারই না হবে! চাই কি এর পাশের লেকের সিঁড়িতে বসেও বই পড়া যাবে।
পুরোটা ঘুরে দেখতে গেলে খিদে পাবেই। খাবারের ব্যবস্থাও রয়েছে পার্কে। খিদে লাগলে, মহুয়া স্ন্যাকস অ্যান্ড মহুয়া ফুডস রেস্টুরেন্টে খাওয়া যাবে। রাতে থাকার ব্যবস্থাও নাকি আছে। মহুয়া গেস্ট হাউসে রাত কাটানো যাবে। ছায়াঘেরা পার্কটায় হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, রাতে কী সুনসান নীরব আর অন্ধকারই না হবে জায়গাটা! থাকা গেলে দারুণ থ্রিলিং হতো! তবে এখানে রাত কাটানো, কতোটা সেইফ, সেটাই ভাববার বিষয়। একটা লেকের উপর বাঁশের সাঁকো দেখে খুব ইচ্ছে হলো, পাড়ি দিই। কিন্তু মানুষের ভীড়ে হলো না। ছুটির দিনে বেড়াতে যাওয়ার শাস্তি। ঘুরে একধারে গিয়ে দেখি কতোগুলো মাটির ঘর। মনে হলো, এগুলোই কি সেই গেস্ট হাউজ। উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখে, গেস্ট হাউজ বলে মনে হলো না। আবার দুইজন মহিলাকে মাটির চুলায় রাঁধতেও দেখলাম।
ওখান থেকে একটু হেঁটে সামনে গিয়ে দেখি, দ্বিতল একটা ভবন। কী সুন্দর করে বানানো। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে দোতালায় উঠে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এমন একটা ছাদ পেলে আর কিচ্ছু চাইতাম না। একটু খেয়াল করে রুমগুলোর দরজায় তাকিয়ে দেখি, ক্লাস এইট, ক্লাস নাইন লেখা। তালা দেওয়া দরজার ফোকরে উঁকি দিয়ে দেখি, ভিতরে কি সুন্দর চেয়ার টেবিল! এটা সত্যিই একটা স্কুল! এত সুন্দর স্কুল কি আর কোথাও আছে? পার্কের কেয়ার টেকার গোছের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্কুল কি সত্যিই চলে, নাকি জাস্ট ফর শো?’
উনি বললো স্কুল নাকি সত্যিই রানিং। এলাকার ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা করে।
স্কুল থেকে বেরিয়ে অনেকটা পথ হেঁটে দেখি হরেকরকম জিনিসের দোকান। কুটির শিল্পের জিনিসপত্রই বেশি। ফেরার সময় সেই প্রথম লেকটার পাশ ঘুরে লাল মাটির রাস্তাটা পেরিয়ে বাগানের মধ্য দিয়ে বের হলাম। এখানটাতেও জায়গায় জায়গায় বসার জায়গা আছে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত লাগলে, বসে রেস্ট নিয়ে আবার হেঁটেছি।
এই পথেই ফেরার সময় আরেকটা সুন্দর বাড়ি দেখলাম। বাংলোবাড়ি টাইপ। ওটার সামনে যেতেই একজন বললো, এখানে টুরিস্টদের ঢোকা নিষেধ। এটা মালিকপক্ষের জন্য বরাদ্দ।
পাশেই একটা গরুর খামার দেখলাম। ক্লান্ত হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে আরোও কয়েকটি বাড়ি দেখলাম। বাড়িগুলো কিসের কী, বুঝলাম না। ওদের উচিৎ ছিল, বাড়িগুলোর সামনে ডেসক্রিপশন লিখে দেওয়া।
১৯৭৯ সালে রূপগঞ্জ পূর্বাচল উপশহরে ঢাকা ইস্টার্ন বাইপাস সড়কঘেঁষে জিন্দা পার্ক (ঐকতান) গড়ে তুলেন অগ্রপথিক পল্লী সমিতির সদস্যরা। চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে, পার্কটি কোন সরকারি উদ্যাগের ফসল নয়। আবার কোন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নির্মাণও নয়। পার্কটি তৈরী হয়েছে এলাকাবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং তাদের প্রাণান্ত অংশগ্রহনের মাধ্যমে। এলাকার ৫০০০ সদস্য নিয়ে “অগ্রপথিক পল্লী সমিতি” ১৯৮০ সালে যাত্রা শুরু করে। এ দীর্ঘ ৩৫ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এই পার্কটি। এ রকম মহাউদ্দেশ্য, এত লোকের সক্রিয় অংশগ্রহন এবং ত্যাগ শিকারের উদাহারণ খুব কমই দেখা যায়। পার্কটির নাম খুবই অদ্ভুত হওয়ায় জিজ্ঞেস করলাম, এর রহস্য কী। জানালো, গ্রামটির নাম জিন্দা গ্রাম। সেই অনুযায়ী পার্কের নাম জিন্দা পার্ক। পার্কের নাম কিন্তু ঐকতান পার্ক। কিন্তু এটি জিন্দাপার্ক নামেই পরিচিত। বর্তমানে জিন্দা গ্রামটিকে একটি আদর্শ গ্রাম ও বলা হয়৷
আমরা ভেবেছিলাম, যেহেতু নারায়ণগঞ্জ, তাহলে খুব বেশি দূরে নয় জায়গাটি। আদতে তা নয়। ঢাকাবাসীদের গুলিস্তান হয়ে যেতে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হবে। তারচেয়ে কুড়িল বিশ্বরোড থেকে কাছেই। বিশ্বরোড থেকে বিআরটিসি বাসে সরাসরি কাঞ্চনব্রিজে চলে আসা যায়।
ফেরার সময় আমরা টমটমে করে কাঞ্চনব্রিজে এসেছি ২০ টাকা করে। ওখান থেকে বিআরটিসির টিকিট কেটেছি। ৩০ টাকা করে টিকিট। বাইপাস দিয়ে এসে নেমেছি ভূলতা গাওছিয়ায়। ফেরার পথেও প্রচুর জ্যাম পেয়েছি। রবি আর সোমবার হাটবার হওয়ায় নাকি এই রাস্তায় প্রচুর জ্যাম পড়ে।
জিন্দা পার্কে গিয়েও মানুষজন ইচ্ছেমতো নোংরা করছে। গাছের বাকলে ইট সিমেন্টের চেয়ারগুলোয় নিজেদের নাম লিখে এসেছে। ১০০ টাকা টিকিট কেটে হয়তো ভেবেই নিয়েছে নিজেদের সম্পত্তি। হোক না এটা একটা পার্ক, তবুও কি এটাকে নোংরা করার অধিকার আছে আমাদের? আমাদের টুরিস্ট স্পটগুলো পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব আমাদের নিজেদের। আসুন, ঘোরাঘুরির সাথে সাথে সুরুচির পরিচয় দিই। কারণ, মন সুন্দর যার, সেই তো দেশ পরিষ্কার রাখে।