আজব এই পৃথিবীতে এখনও এমন কিছু যায়গা আছে যা বিশ্বসেরা গবেষকদেরও কপালে ঘামের কারন। তাদের মধ্যে কিছু উদ্ধার করা গেলেও বিশেষ বিশেষ স্মৃতিস্তম্ভ থেকে সম্পুর্ন শহরের ধ্বংসাবশেষ এখনও পুরাতত্ত্ববিদদের কাছে রহস্যের চাদরে মোড়া। আজকে আপনাদের এমনই পাচটি শহরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো, যা দেখলে পিলে চমকাতে বাধ্য হবেন। আসুন, শুরু করা যাক।
১. পুমা পুংকুঃ
আপনি যদি দেখতে চান, প্রাচীন যুগের মানুষেরা কতখানি ক্ষমতাশালী ছিল, তবে আপনার জন্য আদর্শ যায়গা এই পুমা পুংকু। এটি বলিভিয়ার তিয়াউয়ানাকো মনুমেন্টাল কমপ্লেক্সের কালাসাসায়া টেম্পলের দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থিত। বিশাল বিশাল পাথরের ব্লক দিয়ে সাজানো এই জায়গাটি, পাথরগুলো কমপক্ষে আশি কিলোমিটার দূর থেকে বয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। ধারনা করা হয় পুমা পুংকু প্রথম শতাব্দীর দিকে তৈরি করা হয়েছে, কিন্তু কিভাবে নিখুত আকারের বিশাল বিশাল পাথর বয়ে এনে এটা তৈরী করা হয়েছে সেটা আজও রহস্য।
পুমা পুংকুতে প্রাপ্ত সবথেকে বড় পাথরটি দৈর্ঘ্যে ৭.৮১ মিটার লম্বা, প্রস্থে ৫.১৭ মিটার চওড়া। গড় পুরুত্ব প্রায় ১.০৭ মিটার। আর ওজন? এহেম এহেম… প্রায় ১৩১ মেট্রিক টন। ২য় বড় পাথরটির হিসাব শুনবেন? লম্বায় ৭.৯০ মিটার, চওড়ায় ২.৫০ মিটার, গড় পুরুত্ব ১.৮৬ মিটার আর ওহন প্রায় ৮৫.২১ মেট্রিক টন। কিন্তু কথা হচ্ছে এত বড় বড় পাথর কিভাবে এত দূর থেকে টেনে নিয়ে আসা হয়েছিল? আর কিভাবেই বা একটার উপর একটা সাজানো হয়েছে? অবিশ্বাস্য, ঠিক না?
২. ডেরিনকুয়ুঃ
আপনি যদি একজন প্রাচীন নিদর্শনের নির্মল দর্শক হন, এবং যদি কখনো তুরস্কে যান, অবশ্যই আপনার মাটির নিচের বিশাল শহর ডেরনকুয়ু দেখে আসা উচিৎ। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যতগুলো আন্ডারগ্রাউন্ড সিটি আবিস্কার করা হয়েছে, ডেরনকুয়ু তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। এবং প্রাচীন আর্কিটেকচারের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
ধারনা করা হয় এটি সপ্তম শতাব্দীর দিকে তৈরী করা হয়েছিল। কিন্তু কিছুকিছু পুরাতত্ত্ববিদদের মতে এটি খ্রিষ্টের জন্মের ১৪০০ বছর আগে তৈরী করা হয়েছিল। মাটির নিচে অবস্থিত এই শহর প্রায় আঠার থেকে কুড়ি তলা সমান।
গবেষকদের মধ্যে এই শহর প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কি ছিল, তা নিয়ে যথেষ্ঠ দ্বিমত আছে। শহরটির আয়তন প্রায় ৭০০০ স্কয়ার ফিট; যদিও এখনও সম্পুর্ণ শহরটি খুড়ে বের করা সম্ভব হয় নি। অবাক করা বিষয় হচ্ছে এই শহরটিতে মাটির নিচে প্রায় বিশটি আলাদা আলাদা তলা রয়েছে, যা আমাদের চিন্তাধারাকে একটা লেভেলে নিয়ে যায়, যে আমাদের পুর্বপুরুষদের জ্ঞান ও ক্ষমতা কত উন্নত ছিল।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ডেরনকুয়ু এর সিকিউরিটি সিস্টেম ছিল দারুণ সহজ ও কার্যকরি। প্রত্যেক তলায় আলাদাভাবে বন্ধ করার সিস্টেম ছিল।, সেটি হচ্ছে আলাদা আলাদা পাথরের ব্যাবহার। গোল পাথর দিয়ে প্রত্যেক তলার মুখ বন্ধ করে দেয়া যেত, যেটি শুধুমাত্র ভেতর থেকে কন্ট্রোল করার ব্যাবস্থা ছিল।
৩. বালবেকঃ
হাজার বছর পুরনো এ শহরটি বর্তমানে লেবাননে অবস্থিত। পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ রোমান নগরী পৃথিবীর পুর্বাংশে গ্রীকদের হাতে তৈরী হয়েছিল। কিছু পুরাতত্ত্ববিদ মনে করেন এই নগরীটি ‘বাআল’ এর আরাধনা করা ফিনিশিয় পূজারীদের হাতে তৈরী। এরকম আরো কিছু থিওরী প্রদান করা হলেও, এই নগরীর আসল উৎস আজও অজানা।
অবশ্য কিছু প্রথাসিদ্ধ পুরাতত্ত্ববিদেরা বলেছেন, এটা আসলে গড বাআল এর জন্য তৈরী একটি ফিনিশিয় ধর্মস্থান বা স্যাংচুয়ারি; এই গ্রীক নগরীকে ডাকা হত হেলিওপলিস (সুর্যের নগরী) নামে। পরবর্তিতে সম্রাট অগাস্টাসের আমলে এটা রোমান কলোনি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে, এর আসল বয়স আজো রহস্য। যদিও কিছু প্রাচীন পুরাতত্ত্ব গবেষক জানিয়েছেন, এই প্রাগৈতিহাসিক স্থাপনার বয়স ১২,০০০ থেকে ২০,০০০ বছর পর্যন্ত হতে পারে।
এই প্রাগৈতিহাসিক স্থাপনার সবচেয়ে কুচুটে ব্যাপার হচ্ছে ট্রিলিথনগুলো। যেমন, তিনটি পাথরে তৈরী ব্লকগুলো লম্বায় প্রায় ২২ মিটার, ৩.৫ মিটার চওড়া ও ৪.৫ মিটার উঁচু। যার ওজন আনুমানিক এক থেকে দুই হাজার টনের মত। এখানে আরো ছয়টা গ্রানাইটের ব্লক আছে যেগুলো প্রায় ১০ মিটার লম্বা, ৪ মিটার উঁচু এবং ওজন আনুমানিক ৩০০ টন। আর ঠিক এই কারনেই বালবেককে বলা হয় পৃথিবীর বাইরের প্রাচীন নগরী।
৪. টেওটিউয়াকানঃ
লেবানন থেকে আমরা এবারে আবার আমেরিকায় ফিরে যাব সেন্ট্রাল মেক্সিকো ঘুরতে। বর্তমান মেক্সিকো সিটি থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত টেওটিউয়াকান মেক্সিকোর সবথেকে গুরুত্বপুর্ণ পুরাতত্ত্ব স্থাপনা।
টেওটিউয়াকান এর সর্বোচ্চ বিন্দুতে পুরাতত্ত্ববিদেরা প্রথম খৃস্টের জন্মেরও এক মিলেনিয়াম পরে গবেষনার সুযোগ পান। টেওটিউয়াকান হচ্ছে প্রি-কলম্বিয়ান আমেরিকান এরিয়ার সবথেকে প্রাচীন বড় নগরী, যেখানে আনুমানিক ১,৫০,০০০ লোক বাস করত। সেই সময়ে এটিই ছিল পৃথিবীর সবথেকে বড় নগরী। অন্যান্য অনেক প্রাচীন নগরীর মত পুরাতত্ত্ববিদেরা এটির সৃস্টি রহস্য সম্পর্কেও অজ্ঞাত। যদিও তারা ধারনা করেন, আসেপাশের বড়বড় মুর্তি বা ভাস্কর্যগুলো খৃস্টের জন্মের শত বছর আগে তৈরী।
অনেক গবেষকই বলেছেন, যখন তারা টেওটিউয়াকানকে উপর থেকে দেখেন, তখন এটাকে একটা কম্পিউটার সার্কিট বোর্ডের মত দেখায়। যেখানে সান পিরামিড আর মুন পিরামিড দুটোকে বিশাল প্রসেসর চিপ। এছাড়াও গবেষকেরা প্রাচীন মিশরের পিরামিডের সাথেও ওগুলোর দারুণ মিল পেয়েছেন।
একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে টেওটিউয়াকান এর অধিকাংশ স্ট্রাকচারেই পুরাতত্ত্ববিদেরা মিকার ব্যাবহার দেখতে পেয়েছেন। এটি এক ধরনের মিনারেল, যা ৩০০০ মাইল দূরে ব্রাজিলে পাওয়া যায়। আর এটি টেওটিউয়াকান এর ঘর-বাড়ি, বিল্ডিং, মন্দির, রাস্তা-ঘাট, মানে মোটামুটি সব জায়গায় ব্যাবহার করা হয়েছে। এমনকি পিরামিড অফ সান-এর উপরে প্রায় ৩০ সেমিঃ মিকার লেয়ার পাওয়া গেছে।
৫. প্রাচীন নগরী কারালঃ
আজকের যাত্রা মেক্সিকো থেকে আমরা আরো দক্ষিণে গিয়ে পেরুতে শেষ করব।
পেরুতে একটি প্রাচীন নগরীর সন্ধান পাওয়া গেছে, যার নাম কারাল। যার অস্তিত্ব সম্পর্কে অনেকেই ওয়াকিবহাল নয়। আর ঠিক একারনেই বর্তমানে কারাল পুরো আমেরিকার পুরাতত্ত্ববিদদের আগ্রহের শিখরে।
এখানে শুধু শহর না, বরং এখানকার মানুষদের সভ্যতা গবেষকদের বছরের পর বছর ধরে ধাঁধায় ফেলে রেখেছে।
প্রাচীন নগরীর সাথে তাদের সভ্যতা ও সাংস্কৃতিও অনেক গুরুত্বপুর্ণ। তবে পুরাতত্ত্ববিদেরা বিশ্বাস করেন কারাল-ই হচ্ছে প্রথম আমেরিকান সভ্যতা যারা নিজেদের মধ্যে লিখিত যোগাযোগব্যাবস্থা ডেভেলপ করেছিল। এই নগরীর আয়তন প্রায় ১৬৫ একর, যা পেরুতে সর্বোচ্চ। কারালের পিরামিডগুলো মিশরের পিরামিডের(৩২০০BC) সাথে তুলনাযোগ্য। পুরো কমপ্লেক্সের কন্সট্রাকশন ও এতটাই চমৎকার যা আমাদের প্রাচীন লোকদের ক্ষমতা ও মানুষিক দক্ষতা সম্পর্কে ভাবিয়ে তুলতে বাধ্য করে।
সম্পুর্ণ পড়ার জন্য ধন্যবাদ। সবগুলো লেখা সবার আগে পেতে লাইক দিয়ে বাংলাহাব ফেইসবুক পেইজের সাথে থাকুন।