বর্তমানে প্রচলিত সিনেমার পাশাপাশি চলছে এনিমেশন সিনেমার জয় জয়কার । শুধু ছোট্ট শিশুরাই নয় বড়রাও এখন বিনোদন নেয়ার জন্য এনিমেশন সিনেমার দিকে ঝুঁকছে । কিছু কিছু এনিমেশন সিনেমাতে রয়েছে রূপকথার গল্পের স্বপ্নিল ছোঁয়া যা কিছুক্ষণের জন্য আমাদের বাস্তবতার কঠিন জগত থেকে ঝলমলে স্বপ্নময় এক জগতে নিয়ে যায়, আবার কিছু কিছু এনিমেশন সিনেমায় সমাজের অন্যায়,অসঙ্গতিগুলোকে খুব সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরা হয় যা আমাদের ভাবনার জগতে ঝড় তোলে। আবার কিছু কিছু এনিমেশন সিনেমা হাস্যরসে ভরপুর থাকে যা দেখে হাসতে হাসতে আমাদের পেটে খিল লেগে যায় ; আমরা কিছুক্ষণের জন্য আমাদের একঘেয়ে জীবন থেকে আনন্দময় এক জগতে প্রবেশ করি । আজ আপনাদের সাথে এমনই কিছু অসাধার্ন এনিমেশন সিনেমার পরিচয় করিয়ে দেব যেগুলো আপনাকে হাসাবে,ভাবাবে, স্বপ্ন দেখাবে আর যদি আপনি অনেক আবেগপ্রবন হন তবে কোন কোন সময় কাঁদাতেও পারে । চলুন ঘুরে আসি এই এনিমেশন সিনেমার রাজ্য থেকে ।
১ । RATATULLIE ( 2007)
কণ্ঠ দিয়েছেন প্যাটন ওসওয়াল্ট, ইয়ান হোম , লঊ রোমানো, ব্রাইয়ান ডেনেহি সহ আরও অনেকে ।
সিনেমাটি ১ টি অস্কার জয় করেছে , হলিউড ফিল্ম পুরস্কার, আন্তর্জাতিক সিনেফিলে সোসাইটি পুরস্কার, আন্তর্জাতিক ফিল্ম মিউজিক ক্রিটিক পুরস্কার সহ ৬৪ টি আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় পুরস্কার জয় করেছে । তাছাড়াও আরও ৪২ টি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছে ।
রেমি একজন উচ্চাভিলাষী এবং আদর্শবান তরুন ইঁদুর । রেমির স্বাদ এবং ঘ্রাণ বিচার করার ক্ষমতা খুব উচ্চমাত্রার । শেফ অগাস্টে গোসটা যে খুব সম্প্রতি মারা গিয়েছে তাকে সে আদর্শ হিসেবে মানত এবং তার মত শেফ হওয়ার স্বপ্ন দেখত । সে তার সুস্বাদু রান্নার জন্য সুপরিচিত ছিল । কিন্তু তার শেফ হওয়ার পথে একমাত্র বাধা ছিল যে সে একজন ইঁদুর ।
রেমি যেখানে থাকত সেই বাড়ির বাসিন্দা একজন মহিলা যখন বাড়িতে ইঁদুরের অস্তিত্ব টের পায় তখন সে শর্টগান নিয়ে তাদের তাড়া করে এবং রেমিরা সেই বাড়ি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং সে তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে । সে প্যারিসের একটি ড্রেনে ভেসে যায় এবং শেষে গোসটার একটি রেস্টুরেন্টে নিজেকে আবিস্কার করে । এরপর তার স্বপ্ন পূরণ হওয়ার একটা সম্ভাবনা দেখা দেয় । ঘটতে থাকে একের পর এক ঘটনা ।
২ । SPIRITED AWAY (2001)
কন্ঠ দিয়েছেন রুমি হিরাগি, মিইয়ো ইরিনো, মারি নাতসুকি, তাকাসি নাইত সহ আরও অনেকে ।
সিনেমাটি ১ টি অস্কার জয় করেছে, গোল্ডেন বার্লিন বিয়ার পুরস্কার , ডারবান আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা সিনেমা ক্যাটাগরি পুরস্কার, সান ফ্রান্সিসকো আন্তর্জাতিক পুরস্কার সহ আরও ৫৩ টি আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় পুরস্কার জয় করেছে এবং তাছাড়াও আরও ২৪ টি আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছে ।
চিহিরো আর তার বাবা-মা তাদের নতুন বাড়ির উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায় । কিন্তু পথিমধ্যে তারা গন্তব্যে যাওয়ার পথ হারিয়ে ফেলে । পথ ভুলে এসে পড়ে এক অদ্ভুত গুহার সামনে । তারপর কৌতুহল বশত চিহিরো এর বাবা-মা গুহায় প্রবেশ করতে চায় কিন্তু চিহিরো তাদের বারণ করে । কিন্তু তার বাবা-মা তার নিষেধ না শুনে গুহায় প্রবেশ করে এবং গুহার অপরপ্রান্তে এক অদ্ভুত সুন্দর কিন্তু পরিত্যাক্ত বিনোদন পার্ক দেখতে পায় । তাদের কাছে জায়গাটা একটু অদ্ভুত লাগে কারণ পুরো জায়গাটায় অদ্ভুত এক ধরনের নিরবতা ঘিরে ছিল । এরপর আরও সামনে এগিয়ে যাওয়ার পর তারা অনেক সুস্বাদু খাবার দেখতে পায় এবং কোন কিছু না ভেবেই গোগ্রাসে খেতে থাকে কিন্তু চিহিরো খায় না কারন তার কাছে পুরো জায়গাটা অস্বাভাবিক মনে হতে থাকে । এক সময় খেতে খেতে চিহিরো এর বাবা- মা শুকরে পরিণত হয় । আর চিহিরো পরিণত হতে থাকে ভূতে । কিন্তু হাকু চিহিরোকে ভূতে পরিণত হওয়ার হাত থেকে বাঁচায় এবং এরপর ঘটতে থাকে অবিশ্বাস্য সব ঘটনা ।
৩। FINDING NEMO ( 2003)
কণ্ঠ দিয়েছেন আলবার্ট ব্রুট, এলেন ডি জেনেরিস, আলাকজান্ডার গৌল্ড, উইলিয়াম ডাফো সহ আরও অনেকে ।
সিনেমাটি ১ টি অস্কার জয় করেছে , গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার, একাডেমী অফ সাইন্সফিকশন, ফ্যান্টাসি এন্ড হরর পুরস্কার সহ ৪৬ টি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার জয় করেছে । তাছাড়াও আরও ৫৯ টি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছে ।
গ্রেট ব্যারিয়ার রীফে মারলিন নামে এক ক্লোন মাছ বাস করত । একদিন মারলিন তার ছেলে নিমোকে হারিয়ে ফেলে যে কিনা মুক্ত সাগরে বিচরন করতে গিয়ে মাছ শিকারিদের জালে ধরা পড়ে এবং সিডনিতে এক দাঁতের ডাক্তারের একুরিয়ামে নিজেকে আবিস্কার করে । এরপর মারলিন তার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিমোকে সেখান থেকে উদ্ধার অভিযানে নামে । অভিযানে মারলিনের ডরি নামের এক মাছের সাথে পরিচয় হয় যার ভুলে যাওয়ার সমস্যায় আক্রান্ত । মারলিন এবং ডরি দুজনে মিলে নিমোকে উদ্ধার করার জন্য এক দুঃসাহসিক যাত্রা শুরু করে যেখানে সাগরের অন্যান্য ভয়ংকর মাছ এবং প্রাণী দ্বারা তাদের প্রাননাশের ঝুঁকি থাকে । এদিকে ডাক্তারের অফিস থেকে পালানোর জন্য নিমো এবং অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীরা পরিকল্পনা করতে থাকে এবং বিভিন্ন ঘটনা ঘটাতে থাকে তাদের পরিকল্পনা সফল করার জন্য ।
৪। THE TALE OF PRINCESS KAGUYA ( 2013)
কণ্ঠ দিয়েছেন চলে গ্রেস মোরেটজ, জেমস কান, ম্যারি স্টিনবারগেন, ডারেন ক্রিস সহ আরও অনেকে ।
সিনেমাটি এশিয়া প্যাসিফিক স্ক্রিন এ্যাওয়ার্ড, ব্লু রিবন এ্যাওয়ার্ড, আন্তর্জাতিক সিনেফিলে সোসাইটি এ্যাওয়ার্ড সহ ১১ টি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার জয় করেছে । তাছাড়াও আরও ৩৫ টি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছে । সিনেমাটি ১টি অস্কারের জন্যও মনোনয়ন পেয়েছে ।
সিনেমাটি একটি বিশুদ্ধ রূপকথার গল্প বলা চলে । শুরুতে দেখা যায় একজন কাঠুরে সানুকি বাঁশ কাটতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল করে সেখানে একটি বাঁশ আলোকিত হয়ে আছে । কাঠুরে ওখানে যেতেই বাঁশটি প্রস্ফুটিত হয় এবং তার ভেতরে একজন ছোট্ট ফুটফুটে শিশু দেখতে পায় । সানুকি এবং তার স্ত্রী বিশ্বাস করে যে এই শিশু স্বর্গ থেকে এসেছে এবং তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা শিশুটিকে তাদের কাছেই রেখে দেবে । তারা শিশুটিকে প্রিন্সেস নামে ডাকতে থাকে । অদ্ভুত সুন্দর একটি স্বপ্নময় গ্রাম্য পরিবেশে সে তার বন্ধুদের সাথে হেসে খেলে দিনযাপন করতে থাকে । শিশুটি খুব দ্রুত এবং লক্ষ্যণীয়ভাবে বেড়ে উঠতে থাকে । প্রিন্সেসের বন্ধুদের মাঝে সুতেমারো নামক একজনের সাথে খুব ভাল বোঝাপড়া হয় । এর মধ্যে কাঠুরে বাঁশ কাটতে গিয়ে আবার আলোকিত বাঁশের দেখা পায় এবং বাঁশ কেটে অনেক সোনা পায় । এরপর একদিন সেই আলোকিত বাঁশ থেকে অনেক দামী কাপড় পায় । এজন্য কাঠুরে সিদ্ধান্ত নেয় সে প্রিন্সেসকে সত্যিকারের প্রিন্সেস এর পরিচয় দেবে এবং সেজন্য তারা শহরে পাড়ি জমায় প্রিন্সেসের ইচ্ছার বিরুদ্ধে । শহরে গিয়ে ধীরে ধীরে প্রিন্সেস তার গ্রাম্য জীবনের উচ্ছলতা, স্বাধীনতা তার বন্ধুদের অভাব অনুভব করতে থাকে । তাকে বিভিন্ন প্রিন্স বিয়ে করার জন্য আসে কিন্তু প্রিন্সেস বিয়ে করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে । এরপর একদিন কাঠুরে এবং তার স্ত্রী প্রিন্সেসকে হারায় ।
৫। RIO ( 2011)
কণ্ঠ দিয়েছেন লেসলি মান, জেসি আইসেনবারগ, রদ্রিগো সান্তোরো এবং আরও অনেকে ।
সিনেমাটি ASCAP ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন মিউজিক এ্যাওয়ার্ড, এনি এ্যাওয়ার্ড সহ ৩ টি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার জয় করেছে । তাছাড়াও আরও ২৯ টি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে । এটি একটি অস্কারের জন্যও মনোনয়ন পেয়েছে ।
সিনেমাটি বিরল প্রজাতির এক জোড়া নীল ম্যাকাও পাখিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে । আমাজন এর জঙ্গলে ব্লু এর বাবা-মা সহ অন্য পাখিরা নির্ভয়ে সুখে শান্তিতে দিন কাটাচ্ছিল কিন্তু একদিন হঠাৎ সেই বনে পাখি শিকারীরা হামলা চালায় এবং ছোট্ট ব্লু সহ অনেক পাখিকে ধরে নিয়ে যায় পাচার করে দেয়ার জন্য। ঘটনাক্রমে ব্লু পাচারকারীদের পাখির বাক্স থেকে নিচে পড়ে যায় এবং লিন্ডা তাকে খুঁজে পায় । লিন্ডা রিওকে খুব ভালবাসা দিয়ে বড় করতে থাকে । একদিন পাখিবিজ্ঞানী তুলিও লিন্ডার বইয়ের দোকানে এসে ব্লু কে দেখতে পায় এবং লিন্ডাকে জানায় যে ব্লু তার প্রজাতির শেষ ছেলে পাখি । তুলিও আরও জানায় যে রিও ডি জেনেরিওতে তার কাছে একটি মেয়ে ম্যাকাও আছে যার নাম জুয়েল । তুলিও লিন্ডাকে অনুরোধ করে ব্লু কে জুয়েলের কাছে নিয়ে যেতে যাতে করে তারা দুজনে মিলে তাদের প্রজাতিটাকে রক্ষা করতে পারে । কিন্তু এরপর আবার ঘটনাক্রমে ব্লু পাখি শিকারিদের হাতে ধরা পড়ে । লিন্ডা এবং তুলিও মিলে ব্লু কে উদ্ধার অভিযানে নামে । ঘটতে থাকে শ্বাসরুদ্ধকর এবং হাস্যরসাত্মক সব ঘটনা ।
সিনেমাটির অসাধারণ এনিমেশন এবং পাখিদের হাস্যরসাত্মক কথা এবং কান্ডকারখানা দর্শকদের নির্মল বিনোদন দেবে। নিয়ে যাবে পাখি রাজ্যের এক স্বপ্নময় জগতে । সিনেমাটি দেখে অনেকেরই সেই পাখি রাজ্যের বর্ণিল জগত দেখে আসার ইচ্ছা জাগতে পারে।
লেখিকাঃ শারমীন আক্তার সেতু। আমি পেশায় একজন মনোবিজ্ঞানী । কবিতা লিখতে এবং পড়তে পছন্দ করি । মনোবৈজ্ঞানিক ফিচার লেখার সাথে যুক্ত আছি। তাছাড়াও অন্যান্য বিষয়েও লিখতে এবং জানতে পছন্দ করি । আমি এর আগে পরামর্শ .কম এ লেখার সাথে যুক্ত ছিলাম । এখন কিছু ইংরেজি সাইটে অনুবাদের কাজ করছি । আমার শখ ভ্রমণ এবং গান গাওয়া । বাগান করতে পছন্দ করি এবং বিভিন্ন গাছ,ফুল্,ফল এবং নতুন নতুন জায়গার সাথে পরিচিত হতে ভাল লাগে।