বাংলাহাব ভ্রমণ- মিশন দামতুয়া

দামতুয়া ঝর্ণা!
অনেকে বলে তুক-আ-দামতুয়া!

আমার বাড়ি থেকে বেশি দূর নয়.. পার্শ্ববর্তী উপজেলা আলীকদমেই অবস্থান এটার।

ঘন্টা দেড়েকের পথ। দু’বছর ধরে প্ল্যান করছি যাওয়ার…কিন্ত ঠিক হয়ে উঠছিল না।৪/৫ টা পাহাড় ডিঙোতে হবে শুনে বন্ধুরা সব পিছিয়ে যাচ্ছিলো। সচরাচর দুই ঈদে বাড়ি যাওয়া হয় আমার। কুরবানি’র ঈদে হয়ে গেল সুযোগটা এক পাগলা ছোট ভাইয়ের কারনে। কথা হলো ঈদের পরদিন বেরিয়ে পড়বো দামতুয়ার জন্য.. টোটাল দশজনের টিম। এবার তো বেরোনোর বন্দোবস্ত করতে হয়!
কিন্তু ভোরবেলা থেকে জোর বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল!!

একবার তো ভাবলাম… এবারো বুঝি মাটি হলো সব।

ফোন দেয়া শুরু করলাম সবাইকে।শেষপর্যন্ত ঠিক হলো ঝড়তুফান যাই হোক, ট্যুর আমাদের হবেই।

সকাল ৬:৩০ এর দিকে বৃষ্টির ছাট কমে এলো কিছুটা।

blankবাসায় আলীকদম যাচ্ছি বলে বেরিয়ে পড়লাম।মাহিন্দ্র(সিএনজি টাইপ) ঠিক করাই ছিল কিন্তু টিম মেম্বার শেষমেষ ছ’য়ে এসে দাঁড়িয়েছে।তিনজন মেয়ে আর তিনজন ছেলে।

বেরোতে সাড়ে সাতটা বেজে গেল। তখনো পাহাড়ের কোলে সাদা তুলোর মতো পেজা পেজা মেঘ।

আধাঘণ্টায় পৌছে গেলাম আলীকদম বাজার। রোদের দেখা মিললো সেখানে।সেখান থেকে হালকা খাবার দাবার নিয়ে রওনা দিলাম আদুপাড়ার উদ্দেশ্যে।জায়গাটা ১৭ কিলো নামেই বেশি পরিচিত।

বুঝলাম মুগ্ধতার শুরু হলো মাত্র। সর্পিল রাস্তা যেন আকাশ ছোঁবে এক্ষুনি। এই রাস্তাটা ডিমপাহাডের রাস্তা নামেই সবাই চেনে… বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু সড়ক।

কোথাও কোথাও এতোটাই উঁচুু মাহিন্দ্রও উঠতে পারছিলো না, আমরা ঠেলেঠুলে পার করেছি।

চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ আর মাথার উপর নীল আকাশ। সূর্য তাপ ছড়াতে শুরু করে দিয়েছে ততক্ষনে। পাহাড়ের আলাদা একটা গন্ধ থাকে।বাতাসেরও থাকে অন্যরকম ভাষা।কখনো কখনো আদিবাসীদের দু’একটা ঘর চোখে পড়ছিল। এটা তাদের জন্য পায়েচলা পথ বলা চলে।
৯ টা নাগাদ আমরা ১৭ কিলো পৌছে গেলাম। সেখানেই একজন গাইড় নিয়ে নিলাম।পাওয়া যায় খুব সহজেই।এবার পুরোটাই হাঁটা পথ।হাঁটার আগে স্থানীয় একজন বার্মিজ বাম দিয়ে বললেন মেখে নিতে তাহলে নাকি জোঁকের ঝামেলা এড়ানো যাবে কিছুটা!!

হাঁটছি আর মুগ্ধতা বেড়েই চললো। কখনো লম্বা ঝিরিপথ কখনো গাছের গুঁড়ি বা বাঁশ দিয়ে তৈরি সাঁকোটাই ভরসা। ঘন্টা দেড়েক পর একটা ক্যাসকেড় এর দেখা পেলাম।ছোট্ট কিন্তু সুন্দর।ওখানেই প্রথম ঝর্ণার শব্দ শুনলাম..

গাইড বললো ওটা দামতুয়া নয়, অংপা নাম তার।

আরো কিছুক্ষণ পরে পাহাড়ের গায়ে অনেক দূরের রূপালী ধারা চোখে পড়লো।তখন আমরা একটা আদিবাসী পাড়ার কাছাকাছি… তিনটি পাড়ার এটা ছিলো দ্বিতীয়।কোথাও বাতাবিলেবুতে গাছ একদম পড়োপড়ো,এদিক ওদিক চরছে পোষা শূকর কিংবা ঝিরিতে পাহাড়ী মেয়েটি সেরে নিচ্ছিলো তার দুপুর-স্নান। পাড়ার সবাই বোধহয় এরকম আগন্তুক দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে.. হাত নেড়ে টা টা বলতে লাগলো। কে জানে এটাই হয়তো ওদের জন্য সম্ভাষনের সহজ ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তখনো আরো ঘন্টা দেড়েকের পথ বাকি।

পাহাড় চড়তে আমার বরাবরই কষ্ট হয়।বাড়তি ওজন সবসময়ই একটা ডিজএডভান্টেজ পাহাড়ে।আমি ধীরে এগোই, কিন্তু শেষ না করে ফিরি না।আমরা থেমে থেমে নিজেদের কিছুটা সময় দিয়ে উঠছিলাম।সাথে পানি, বনরুটি আর পর্যাপ্ত খেঁজুর।

blankশেষদিকে সবাই একটু অধৈর্যই হয়ে পড়েছিলাম।একদম চূড়ান্ত মুহুর্তটাতে দেখা পেলাম দামতুয়া’র উপরের অংশটার। প্রকৃতি যেন ধাপে ধাপে সিঁড়ি তৈরি করে রেখেছে তার উপর বয়ে চলেছে জলধারা।

শেষমেশ যখন দামতুয়া পৌছালাম তখন পেরিয়ে গেছে চারটি ঘন্টা।এবার স্তব্ধ হওয়ার পালা। এই বর্ষা ভয়ংকর রূপবতী করে তুলেছে ঝর্ণাটাকে। সামনেই ছোট্ট জলাশয়।ফেরার তাড়া ছিল আমাদের, তাই আর সময় নষ্ট করলাম না। ঘন্টাখানেক দাপাদাপি আর প্রাণভরে রূপসুধা পান করেছি দামতুয়ার।ততক্ষণে ভুলে গেছি আগের চারটি ঘন্টা।

blankআসার সময়ই বুঝেছিলাম সহজ হবে না ফেরাটা।সকালের বৃষ্টিতে ট্রেইলটা পিচ্ছিল ছিলোই কিছুটা তার উপর অন্যান্য গ্রুপের চলাচল পথটাকে বন্ধুর করে তুলেছিল। ফিরছি বেশ জোর কদমেই। খেয়াল করছিলাম কেমন সন্ধে নেমে আসছে পাহাড়ে। ঘড়ি দেখলাম তখন মাত্র আড়াইটা বাজে।মিনিট বিশেক পরে একদম ঘন অন্ধকার। গা ছম ছম করছিলো।পায়েচলা পথটা দেখা যায় শুধু।তারপর এলো ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি।আমি সবকিছু ভুলে ঠায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখলাম।এমন অদ্ভুত সুন্দর না দেখতে পেলে একজীবন বৃথাই। ততক্ষনে টিম এগিয়ে গেছে অনেকটাই। বৃষ্টিতেই চলছে পথচলা।আরো পিচ্ছিল আর দুর্গম হয়ে গেছে ট্রেইলটা।একটা পাহাড় পেরোতেই দম ফুরিয়ে গেলো।এইবার বেশ কষ্টই হয়ে গেল আমার জন্য। একটু এগিয়েই থামতে হচ্ছে। সাথে টেনশন বাড়ছে টিমকে পিছিয়ে দিচ্ছি না তো!

ওদের এগোতে বললাম কিন্তু ছায়ার মতো পাশে রয়ে গেলো সেই পাগলা ছোট ভাইটা। বারবার বলছি তুই এগো আমি আসছি কিন্তু সে নাছোড়বান্দা।

ঘন্টাখানেকের বৃষ্টিতে ফুলে ফেঁপে উঠেছে ঝিরি।

হাঁটুু সমান পানি তখন প্রায় কাঁধ ছুঁই ছুঁই। নিচের পাথর বুঝার সাধ্য নাই।এটা আরো দেরি করিয়ে দিচ্ছিলো আমাদের। হঠাৎ পৃথিবীটা দুলে উঠলো… বুঝলাম পিচ্ছিল পাথরে পা হড়কেছে। গিয়ে পড়লাম দুই পাথরের মাঝখানে। সেযাত্রা চেহারাটা বাঁচলেও বাহাতের অনামিকা আর ডানপায়ের গোঁড়ালি কোনটাই অক্ষত ছিলো না!

blankবাহাত ফুলে ঢোল হয়েছে লাঠিতে ভর দিতে পারছিলাম না।আর এদিকে ডানপায়ের গোড়ালি নাড়াতে জানটাই বেরোচ্ছিল প্রায়। আমি তখন ব্যালেন্স হারিয়েছি সবদিকেই কিন্তু তখনো প্রায় পুরো পথটাই বাকি।এগোতে লাগলাম আস্তে আস্তে। টিমের বাকি চারজন বেশ এগিয়েছে তখন।একসময় ডান পা আর চলছিলো না। ফেরা শুরু করার আগে ট্রেইলের অবস্থা দেখে পায়ে এংলেট পড়ে নিয়েছিলাম, ভেবেছি সাপোর্ট দিবে।আমি সচরাচর কোন ট্রেইলেই এংলেট নেই না।কিন্তু এটা উলটো আমার রক্ত চলাচল বন্ধ করে দিল।ওটা খুলে ধাতস্থ হলাম কিছুটা। তারপরো পথ যেন আর ফুরোচ্ছিল না। একটা পাহাড়ের পর আরেকটা।সামনের পাহাড়টা দেখেই মনে হচ্ছিলো এটা আর পার করতে পারবো না।আর ভাবছি আঙুলটা এবার গেছেই… বাড়িতে বলাও যাবে না! ডাক্তার দেখানো বন্ধ ঢাকা যাওয়ার আগ পর্যন্ত।

এদিকে ড্রাইভার বলেছিল ৫ টার মধ্যে ফিরতে এবং আর্মি ক্যাম্প থেকে সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে ৬:৩০ পর্যন্ত। এর এদিক ওদিক হলে আর বেরুনো যাবে না। আমার টেনশন বাড়ছিলো আর পাগলাটা বলেই চলেছে..

“আপু… অইতো চলে আসছি, এটাই শেষ পাহাড়।”

blankশেষটাও শেষ হলো একসময়। হাত-পায়ের এই দশায় কটা পাহাড় পেরিয়েছি সেটা এখন আর মনে নাই।
ছোটবড় চারটা বা পাঁচটা হয়তো আরো বেশি।

আর্মি ক্যাম্পে যখন পৌছালাম ৭ টা বেজে গেছে।অসুস্থ শুনে ওরা আর আটকায়নি।
যখন ফিরছি তখনো পাহাড়ে মায়াবী অন্ধকার আর সতেজ বুনো গন্ধ।

এটা আমার প্রথম ট্রেইল ছিলো না মোটেও।দেশ-বিদেশ, ছোট – বড় মিলিয়ে আট নাম্বার ট্রেইল।নাপিত্তাছড়া ট্রেইলের ছয়টা ধাপ এরচেয়েও কঠিন ছিল। কিন্তু প্রকৃতি বোধহয় ছোট একটা পরীক্ষাই নিয়েছিল।প্রথম কোন ট্রেইলে মনে হলো…
ফিরতে পারবো তো?

এজন্যই দামতুয়া সুন্দরীকে মনে রাখবো অনেকদিন।পাহাড়ের নেশা যাকে পেয়েছে তার কি আর রক্ষে আছে!!
পাহাড় ডাক দেয়…

আর আমি নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো ছুটতে থাকি।

কিভাবে যাবেন দামতুয়া:

ঢাকা থেকে সরাসরি শ্যামলী বাস আলীকদম বাজার যায়।অথবা চট্টগ্রাম বা ঢাকা থেকে কক্সবাজারগামী বাসে উঠে চকরিয়া স্টপেজে নামতে হবে।সেখান থেকে চাঁদের গাড়ি বা বাসে করে আলীকদম বাজার। সেখান থেকে মোটরবাইক ভাড়া করে আলীকদম-থানচি সড়ক হয়ে ১৭ কিলো নামতে হবে।ওখানেই কোন না গাইডের দেখা আপনি পেয়ে যাবেন।এরপর হেঁটে যেতে হবে পুরো ট্রেইল। অবশ্যই ভ্রমণের সময় যত্রতত্র প্লাস্টিকের জিনিসপত্র বা আবর্জনা ফেলে আসবেন না এবং স্থানীয়দের সাথে অসদাচারন করা থেকে বিরত থাকবেন।

নিজে সবুজ থাকুন এবং পাহাড়কেও সবুজ রাখুন।
আপনার ভ্রমণ শুভ হোক।

লেখিকা- অনুরণন সিফাত