আজকের এই অত্যাধুনিক বিশ্বে একটা মুসলিম প্রধান দেশের মসজিদগুলো বর্তমানে কেমন আর কেমন হওয়া উচিৎ, এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করতেই একদল স্থপতি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। তাই একটা মসজিদ বর্তমানে কেমন আর আগামীতে কেমন হতে পারে – দেখুন একজন স্থপতির চোখে, ভাবুন একজন স্থপতির ভাবনায়। The New York Times- এ প্রকাশিত In Bangladesh, Reimagining What a Mosque Might Be ফিচার অনুসরণে লিখেছেন রেহেনা রজনী।
বাংলাদেশের প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যার ৯০% জনগণই মুসলিম। যারা বেশির ভাগই মোটামুটি ধর্মভীরু। বর্তমানে এমন কোন জায়গা নেই যেখানে আজানের ধ্বনি শোনা যায় না, যেখানে মসজিদ নেই। কিন্তু এখনো পর্যন্ত প্রায় সব মসজিদই তৈরি করা হয় ঠিক সেভাবে যেভাবে আগে তৈরি করা হত। এক্ষেত্রে তেমন পরিবর্তন কিন্তু লক্ষ্য করা যায়নি। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে আধুনিক বা অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে মসজিদ তৈরি অত্যন্ত জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ আমাদের দেশের মসজিদ হওয়া উচিৎ আমাদের দেশের মানুষের জীবন যাপন ব্যবস্থা আর আবহাওয়ার উপর ভিত্তি করে। পাশ্চাত্য অন্যান্য দেশের অনুকরণে নির্মাণ আর নয়।
এসব কথা মাথাতে রেখেই তৈরি করা হয় মসজিদের শহর ঢাকার উত্তর পাশে আম্বার ডেনিম মসজিদ। আধুনিক দিনের আধুনিক মসজিদের কথা বলতে গেলে এই মসজিদটির কথা বলতেই হয়। আম্বার ডেনিম মসজিদটি নির্মাণ করেন আর্কিগ্রাউন্ড নামের সাত বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ঢাকার একটি ফার্ম। এই মসজিদটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয় ২০১৬ সালে। মসজিদটির দেয়ালগুলো কংক্রিট ব্লকের তৈরি, দেখতে অনেকটা অ্যাজটেক পিরামিডের মত মনে হতে পারে। মসজিদটিকে গরমের সময় গরমের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য রয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট খাই। আবার বর্ষার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ১৮ ফুট উপরে ছাদে একধরণের বিশেষ ছাতা রয়েছে, যেটা বর্ষা শুরু হলে আপনা-আপনিই খুলে যায়।
আম্বার ডেনিম গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীর ছোট একটি জায়গা নিয়ে নামাজের স্থান তৈরি করা হয়েছিল। মসজিদটি মূলত কিছু জিনিসের পুনঃব্যবহারের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। মসজিদটি তৈরির মাত্র একবছর আগেও এটি ছিল খোলা আকাশের নিচে কিছু বাঁশ, খুঁটি দিয়ে তৈরি অতি সাধারণ একটা নামাজের জায়গা মাত্র। কিন্তু নির্মাণ কাজ শেষ হতে না হতেই হয়ে গেল সেটি বাংলাদেশের অন্যতম সেরা মসজিদগুলোর একটি।
আম্বার ডেনিম মসজিদের অন্যতম স্থপতি জনাব জুবায়ের হাসান বলেন, “আমরা আমাদের আবহাওয়ার উপযোগী একটা মসজিদ তৈরি করতে চাচ্ছিলাম। মসজিদটিতে কোন জানালা বা দরজা কিছুই নেই। তারপরও মসজিদের সব জায়গাতেই শুধু আলো আর আলো।” তিনি আরও বলেন, “ মানুষ এখন নিজেরাই নিজেদের উপযোগী মসজিদ তৈরি করছে, এটা আসলেই একটা ভালো দিক।”
১২শ শতাব্দীর শেষ ভাগে প্রায় ৪০০ বছরের পুরাতন বৌদ্ধ শাসনামল শেষ হয় কিছু সূফী-সাধকদের ধর্মপ্রচারের জন্য ভারতীয় উপমহাদেশে এসে ধর্মপ্রচারের ফলে। ১৩শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সূফী-সাধকগণ কিছু মসজিদ তৈরি করেন পদ্মা এবং ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে। সেটাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে তৎকালীন বাঙালী মুসলিম সভ্যতা। মুসলিম শাসনামলের স্থায়িত্ব প্রায় ১৬শ সাল পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায়। পরে ১৮শ সালের মুঘল শাসনামলে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী গঠনের ফলে বেশ কিছু মন্দির নির্মিত হয়, যেগুলোও নিঃসন্দেহে পুরাতন ঐতিহ্যের ধারক এবং বাহক। তবে পুরাতন ঐতিহ্য বিবেচনায় সুলতানী আমলে তৈরি বেশ কিছু মসজিদও কিন্তু কোন অংশেই কম নয়। পূর্বে বাংলার মানুষের দেশীয় রীতিতে ঘরবাড়ী নির্মিত হত মাটি, বাঁশ বা খড় দিয়ে। কিন্তু ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর এই দেশীয় রীতি্র নির্মাণ কৌশলে সামান্য হলেও পরিবর্তন আসে। আর ১৯৭১ সালে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের নির্মাণ শিল্পেরও শুভসূচনা ঘটে। যদিও পুরাতন রীতিনীতি ও প্রথা মেনে সেসময় বাংলাদেশের বেশিরভাগ মসজিদগুলো তৈরি হত অন্যান্য আর পাঁচটা মসজিদের মতই ভীষণ সাধারণ এবং অনাড়ম্বর। কিন্তু পরে স্থপতিগণ মসজিদ তৈরিতে আধুনিকায়ন আনেন এবং বেশ কিছু মসজিদ তৈরি করেন যেগুলোর গম্বুজগুলো অনেকটা তুর্কীয় ধাঁচের, সু-উচ্চ চূড়াগুলো মুঘল আমলের মত কিছুটা বাঁকানো। যদিও এতকিছুর পরেও সেসব মসজিদ গুলোতে তেমন বাঙ্গালীয়ানা ছিল না।
এসকল মসজিদ ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ায় সেসময় আরও বেশ কিছু মসজিদ নির্মিত হয় আধুনিক নিয়মানুসারে। যার জন্য মূলত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তৎকালীন বিশিষ্ট্য স্থপতি জনাব মাজহারুল ইসলাম। ১৯৫৫ সালে তার নির্মিত কলেজ অব আর্টস এন্ড ক্রাফট নামের কলেজটিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বর্তমানে যেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষদ। ১৯৬০ সালে মাজহারুল ইসলাম এই কলেজে বেশ কয়েকজন বিখ্যাত স্থপতিদেরকে নিমন্ত্রণ জানান। তাদের মধ্যে পল রোডালফ, স্ট্যানলি টাইগারম্যান এবং লুইস খানের কথা না বললেই নয়।
সেসমকার উন্নতমানের নির্মাণের মধ্যে ১৯৬৪ সালে নির্মিত রোবার্ট বোগের তৈরি কমলাপুর রেলষ্টেশন যথার্থ একটি উদাহরণ। লুই আই কান ১৯৬২ সালে বাংলাদেশের পার্লামেন্ট তৈরির কাজ শুরু করেন। পার্লামেন্ট তৈরিতে মূল নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে ইট এবং কংক্রিট ব্যবহার করা হয়। যেটি বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত অন্যতম বিশেষ একটি স্থপত্যের নিদর্শন। যার সৌন্দর্য্য বর্ণনাতীতভাবে সুন্দর। পার্লামেন্ট সামনা-সামনি দেখতে এক রকম সুন্দর আর উপর থেকে দেখলে সৌন্দর্য্য আরেক রকম। এছাড়াও ১৯৮০ সালে তৈরি তিন নেতার সমাধী স্তম্ভ অন্যতম।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথম বারের মত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে, তৎকালীন সংস্কৃতিক মন্তীবর্গের অনুমোদনে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সমাধী স্তম্ভ তৈরি করেন। যেই সমাধী স্তম্ভটি ছিল গতানুগতিক সমাধী স্তম্ভের থেকে একেবারেই আলাদা। তারপর কাশেফ মাহমুদ চৌধুরী চট্টগ্রামের চাঁদগাঁয়ে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন ২০০৫ সালে। বর্তমানে মসজিদটি
পুরাতন,ভবিষ্যৎ নির্মাণকৌশলের এক অপূর্ব সমন্বয়।
বিগত প্রায় ৬০ বছর যাবত আমাদের দেশের বিভিন্ন নির্মাণকৌশলের প্রথা ছিল প্রায়ই একই রকম। তবে আম্বার ডেনিম মসজিদটি তৈরির পুর্বেও এরকম একটি মসজিদ তৈরি হতে পারে সেটাও ছিল কল্পনাতীত। কিন্তু সকল কল্পনাই আজ সত্যি হয়েছে। মসজিদ তৈরিতেও এখন আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। ফলাফল স্বরূপ একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায় যে বর্তমানের নির্মাণ শৈলী অত্যন্ত নান্দনিক এবং সৃজনশীলও বটে।
বাংলাদেশের মত একটা দরিদ্র দেশে, যেখানে প্রায় সব মসজিদই তৈরি হয় কারো না কারো দানকৃত জমির উপর এবং টিকে থাকে যাকাতের মাধ্যমে, সেখানে একই জিনিসের পুনঃব্যবহারের মাধ্যমে তৈরিকৃত আম্বার ডেনিম মসজিদটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে।