আজকের ইরান দেশটিকে প্রাচীনকালে পারস্য বলা হতো। আর্যজাতির যে শাখা ইরানের দক্ষিণে বসতি স্থাপন করে তারাই পারসিক। পারসিকদের প্রাণ কেন্দ্র ছিল ‘পারসিপলিস’। আর ইরানের উত্তর অংশে যারা বসতি স্থাপন করে তারা মিডীয় নামে পরিচিত ছিলো। খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দে পারসীয়রা একটি সভ্যতা গড়ে তোলে। তাদের এই উন্নত সভ্যতাকে পারস্য সভ্যতা বলা হয়ে থাকে। পারস্য সাম্রাজ্যের অপর নাম একমেনিড সাম্রাজ্য।
পার্সিয়ান সাম্রাজ্য নামটি এসেছে কয়েকটি মিলিত রাজবংশ থেকে, যারা কয়েকশো বছর শাসন করেছে। তাদের শাসনামল টিকেছিলো খ্রিস্টপূর্ব ছয়শো অব্দ থেকে বারোশো খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। সাইরাস দ্য গ্রেট খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ অব্দে এই পার্সিয়ান সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেছিলো। সেই সময় এটি পরিণত হয়েছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ সাম্রাজ্যের একটিতে। লৌহযুগের রাজবংশের এই সাম্রাজ্যটি আখেমেনীয় সাম্রাজ্য নামেও পরিচিত ছিলো। সেই সময়ে পারস্য ছিলো সংস্কৃতি, ধর্ম, বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও প্রযুক্তির প্রাণকেন্দ্র। আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের আক্রমণের আগের ২০০ বছর পর্যন্ত এভাবেই টিকেছিলো আখেমেনীয় সাম্রাজ্যের সেই পারস্য।
সাইরাস দ্য গ্রেট
পারসিয়ান সাম্রাজ্যের সূচনা হয়েছিলো আধা-যাযাবর উপজাতিদের হাত ধরে। তখন ইরানিয় মালভূমিতে ভেড়া, ছাগলসহ গবাদি পশু চরানোই ছিলো এই উপজাতিদের প্রধান কাজ।
সাইরাস দ্য গ্রেট ছিলো এমনই এক উপজাতির সর্দার। ধীরে ধীরে সে মেডিয়া, লিডিয়া ও ব্যাবিলনসহ বেশ কিছু রাজ্য জয় করতে শুরু করে। এরপর রাজ্যগুলোতে একই শাসনব্যবস্থা চালু করে সাইরাস। এভাবেই গোড়াপত্তন হয় প্রথম পার্সিয়ান সাম্রাজ্যের।
সাইরাস দ্য গ্রেটের অধীনস্ত প্রথম পার্সিয়ান সাম্রাজ্য দ্রুতই পরিণত হয় পৃথিবীর সর্বপ্রথম সুপারপাওয়ারে। প্রথম পার্সিয়ান সাম্রাজ্য আদি মানব সভ্যতার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলকে এক শাসকের অধীনস্থ করেছিলো। এই সভ্যতাগুলো হলো – মেসোপটেমিয়া, মিশরের নীল উপত্যকা এবং ভারতে ইন্দুস উপত্যকা।
পারস্য সভ্যতার বিকাশ
নিজেদের সেরা সময়ে পারস্যের বিস্তৃতি ছিলো ইউরোপের বলকান পেনিনসুলা (যেটা ভেঙ্গে বর্তমানে বুলগেরিয়া, রোমানিয়া এবং ইউক্রেনের জন্ম হয়েছে) থেকে শুরু করে ভারতের দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত ইন্দুস নদী উপত্যকা এবং দক্ষিণে মিশর পর্যন্ত। পারসীয় সভ্যতা বিকাশে সসবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছিলো সম্রাট প্রথম দারিয়ুস। তিনি বিভিন্ন দেশ জয় করে পারসীয় রাজ্যকে সাম্রাজ্যে পরিণত করেছিলেন। বিশ্ব প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসে পারসীয়দের দু’টি বিষয়ে অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ দু’টির মধ্যে একটি হলো সাম্রাজ্য পরিচালনায় দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো, অপরটি ধর্মীয় ক্ষেত্রে নতুন ধারণার প্রবর্তন। পারসিকদের শাসন ব্যবস্থা ও ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা পরবর্তী কয়েকটি ধর্ম ও সভ্যতাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। শাসন ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধনে পারস্যের মহান শাসক দারিয়ুসের অবদান ছিলো সব চেয়ে বেশি। তিনি সাম্রাজ্যের সুশাসনের জন্য একটি কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলেছিলেন। তিনি নিজেই সামরিক, বেসামরিক ও বিচার বিভাগের প্রধান ছিলেন। স্থলবাহিনীর সাথে তিনি নৌ-বাহিনীও গড়ে তোলেন সম্রাট দারিয়ুস।
সুশাসনের জন্য তিনি পারস্য সাম্রাজ্যকে চার অঞ্চলে বিভক্ত করে প্রত্যেকটির জন্য পৃথক পৃথক রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। এগুলো ছিল ব্যাবিলন, পার্সেপলিস, সুসা ও একরাটানা।
বিশাল সাম্রাজ্য ঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য অঞ্চলভিত্তিক বিভাজন ছাড়াও দারিয়ুস গোটা সাম্রাজ্যকে ২১টি প্রদেশে ভাগ করেছিলেন। প্রতি প্রদেশের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য তৈরি করেছিলেন সড়ক। তিনি ডাক ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। এতে দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে ডাক বিভাগের লোকেরা সকল প্রদেশের খবর রাজধানীতে পৌঁছাতে পারতো। পার্সিয়ানরাই প্রথম আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপের ভিতরে নিয়মিত যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করেছিলো। নতুন নতুন অনেক সড়ক নির্মাণ করেছিলো। পৃথিবীর সর্বপ্রথম ডাক ব্যবস্থা চালু করেছিলো পার্সিয়ানরা। পারসীয় দিনপুঞ্জী তৈরী করেন দারিয়ুস। পারসীয়রাই ১২ মাসে ১ বছর ও ৩০ দিনে ১ মাস গণনার রীতি প্রবর্তন করে।
পার্সিয়ান সংস্কৃতি
আখেমেনীয় সাম্রাজ্যের প্রাচীন পার্সিয়ানরা বিভিন্ন প্রকারের শিল্পের সুচনা করেছিলো। এগুলোর মধ্যে ধাতুর কাজ, পাথর খোদাই, বুনন এবং স্থাপত্যশিল্প অন্যতম। ধীরে ধীরে পার্সিয়ান সাম্রাজ্য যতো বিস্তার লাভ করেছে তাদের শিল্পকলাও ততোটাই উন্নত হয়েছে। তারা যতো আদি সভ্যতা দখল করেছে, সেই সব সভ্যতার শিল্পগুলোও নিজেদের মতো করে গড়ে তুলেছে।
প্রাচীন পার্সিয়ানদের শিল্পের উল্লেখযোগ্য একটি হলো খাড়া বাঁধের বড়ো বড়ো পাথর খোদাই করা। নাকশ-ই-রুস্তমে অবস্থিত আখেমেনীয় রাজাদের প্রাচীন সমাধি মন্দিরে এগুলো এখনও পাওয়া যায়। প্রতিটি পাথরে অঙ্কিত রয়েছে অশ্বারোহী রাজা এবং যুদ্ধ বিজয়ের প্রতিকৃতি। প্রাচীন পার্সিয়ানরা তাদের ধাতব কাজের জন্যও বিখ্যাত ছিলো। ১৮৭০ সালে স্মাগলার কিছু স্বর্ণ ও রৌপ্যের তৈরি আর্টিফ্যাক্ট খুঁজে পেয়েছিলো বর্তমান তাজিকিস্তানের অক্সাস নদী কাছে। আর্টিফ্যাক্টগুলোর মধ্যে রয়েছে কিছু ছোটো ছোটো সোনালি অশ্বরথ, মুদ্রা এবং গ্রীফনের প্যাটার্নে সজ্জিত কিছু ব্রেসলেট। (গ্রীফন পাখাওয়ালা একটি পৌরাণিক প্রাণী যেটির মাথা ঈগলের এবং শরীর ছিলো সিংহের। এটি পার্সিয়ান রাজধানী পার্সেপোলিসের প্রতীক ছিলো।)
পাকিস্তানে নিযুক্ত ব্রিটিশ ডিপ্লোম্যাট এবং মিলিটারি সদস্যরা অক্সাস ট্রেজার নামে পরিচিত এরকম ১৮০টি স্বর্ণ ও রূপার টুকরো নিয়ে এসেছিলো লন্ডনে। এগুলো এখন রয়েছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের প্রদর্শনীতে।
পার্সেপোলিস
ইরানের দক্ষিণে অবস্থিত প্রাচীন পারস্যের রাজধানী পার্সেপোলিস পৃথিবীর বিখ্যাত আর্কিওলোজিকাল সাইটগুলোর একটি। ১৯৭৯ সালে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে জায়গাটিকে।
পার্সেপোলিসের আখেমেনীয় প্রাসাদগুলো নির্মাণ করা হয়েছিলো বিশাল আকৃতির চত্বরের ওপর। প্রাসাদের সম্মুখভাগগুলো সজ্জিত করা হতো বিভিন্ন গহনা দিয়ে। এগুলোর মধ্যে লম্বা পাথরে খোদাই করা নতোউন্নত মূর্তিগুলো অন্যতম। প্রাচীন পারস্য এই মূর্তি খোদাইয়ের জন্যও বিখ্যাত ছিল
পার্সিয়ান ধর্ম
অনেকেই ভাবে পারস্য হয়তো ইসলামের সমার্থক শব্দ। যদিও পার্সিয়ান সাম্রাজ্যের অধিকাংশই ইসলাম অধ্যুষিত ছিলো, তবে সেটার সূচনা হয়েছিলো সপ্তম শতকে আরব বিজয়ের পর থেকে। প্রথম দিকে পার্সিয়ান সাম্রাজ্যের ধর্ম ছিলো জরথুস্ত্রবাদ। গ্রীকদের ভাষায় এর প্রবর্তককে জোরোয়াস্টার বলা হয়।
জরাথুস্ত্র ধর্মের মূল ভিত্তি হচ্ছে শুভচিন্তা শুভকথা এবং শুভকর্ম। মৃত ব্যক্তিদের পুনর্জীবন, পরকাল, ত্রাণকর্তার আবির্ভাব, পরকালের বিচার, স্বর্গ ও দোজখের প্রতি বিশ্বাস জরাথুস্ত্র ধর্মে স্থান পেয়েছে। নৈতিকতা, সততা প্রভৃতি মহৎ গুণ অর্জনে এ ধর্ম উৎসাহিত করে। জরথুস্ত্র মতবাদ বিশেষ করে পরকাল, ত্রাণকর্তার আবির্ভাব, স্বর্গ, পরকালের বিচার ইত্যাদির ধারণা ইহুদী, খৃস্টান এবং ইসলাম ধর্মে দেখা যায়। পারসিকদের ধর্ম দর্শন পরবর্তীকালে মধ্য এশিয়ার জনগণকে প্রভাবান্বিত করেছে।
এই ধর্মের নামকরণ করা হয়েছিলো পার্সিয়ান নবী জরথুস্ত্রের নামানুসারে। তর্কাতীতভাবেই জরথুস্ত্রবাদকে পৃথিবীর প্রথম একেশ্বরবাদ ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কালের বিবর্তনে এই ধর্মের অনুসারী সংখ্যা কমে গেলেও ইরান ও ভারতের কিছু অঞ্চলে এখনো অনেকেই এই ধর্ম পালন করে।
জরথুস্ত্রের সঠিক জন্মকাল জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ থেকে ৫০০ অব্দের ভিতর যে কোনো এক সময় জন্ম হয়েছিলো তাঁর। তিনি তার অনুসারীগণ বহু ঈশ্বরের পরিবর্তে এক ঈশ্বরের পূজা করার ধারণা দিয়েছিলেন। এর আগ পর্যন্ত পারস্যে ইন্দো-ইরানিয়ান দলগুলোর মধ্যে বহুঈশ্বরবাদ ধর্মই প্রচলিত ছিলো।
আখেমেনীয় রাজারাও জরথুস্ত্রবাদ ধর্মের অন্তপ্রাণ ছিলো। ইতিহাস ঘেটে জানা গেছে যে, সাইরাস দ্য গ্রেট শাসক হিসেবে সহনশীল ছিলো। তার সময়কালে প্রজাদের নিজেদের ভাষায় কথা বলা এবং ধর্ম পালনে কোনো বাঁধা ছিলো। সাইরাস নিজে যদিও জরথুস্ত্র ধর্মের আশা সম্প্রদায়ের (সত্য ও ন্যায়পরায়ণতা) অনুসারী ছিলেন, তারপরও তিনি কখনো পারস্যে নিজের অধিকৃত অঞ্চলে জোর করে জরথুস্ত্রবাদ ধর্ম চাপিয়ে দেননি।
ব্যাবিলন থেকে ইহুদীদের বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে জেরুজালেমে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার জন্য হিব্রু ধর্মগ্রন্থেও সাইরাস দ্য গ্রেটের বেশ প্রশংসা করা হয়েছে।
সাইরাস দ্য গ্রেটের পরে আসা আখেমেনীয় সম্রাটরাও তার মতো করেই প্রজাদের স্বাধীন জীবনযাপনে কোনো হস্তক্ষেপ করেনি বা জোর করে কিছু চাপিয়ে দেয়নি। আখেমেনীয় সাম্রাজ্যের ঐ সময়কালটাকে প্রায়ই পাক্স পার্সিয়া বা শান্তির পারস্য বলেও অভিহিত করা হয়।
পারসীয়দের বিজ্ঞানচর্চা, স্থাপত্যকলা ও লিপি
জ্ঞান বিজ্ঞানেও পারসিকরা যথেষ্ট অবদান রেখেছে। মহান শাসক দারিয়ুস মিসরীয় রীতি অনুসারে পারসিকদের জন্য পঞ্জিকা তৈরি করেন। চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান উন্নয়নের জন্য তিনি পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তিনি মিসরীয় চিকিৎসালয়ের সংস্কার এবং বিশিষ্ট ক্যালডীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী নেবুরিমানু ও ফিদিনুকে সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। শিল্পকলাতে পারসিকরা তেমন কোন সক্ষমতা না দেখালেও সম্রাট সাইরাস ও দারিয়ুসের প্রাসাদ নির্মাণে এবং সাইরাসের সমাধিসৌধ তৈরিতে পারসিকরা উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছে। পারস্য স্থাপত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন কাইরাসের সমাধি।
পারসিকরা প্রথম দিকে কিউনিফর্ম লিপিতে লিখতো এবং লেখার কাজে উনচল্লিশটি কিউনিফর্ম চিহ্ন ব্যবহার করতো। পরবর্তীতে তারা নিজস্ব লিখন রীতিও প্রচলন করে। পারস্য সভ্যতার লিখন পদ্ধতিতে ভাষার প্রচলন ছিল ২ টি।
পার্সিয়ান সাম্রাজ্যের পতন
খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০ অব্দে গ্রীসের জেরজেস দ্য ফার্স্টের আক্রমণে ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই পারস্য সাম্রাজ্য পতনের দিকে হেলতে শুরু করে। গ্রীকদের কাছে পারস্যের কিছু ভূমি হারিয়ে যাওয়ায় টান পড়তে শুরু করে সাম্রাজ্যের কোষাগারে। এজন্যই পারস্যের প্রজাদের ওপর তখন মোটা অঙ্কের কর আরোপ করতে হয়েছিলো।
খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ অব্দে মেসেডোনিয়ার আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের সৈন্যদল পারস্য আক্রমণ করার ফলে আখেমেনীয় সাম্রাজ্যের পুরোপুরি পতন সম্পন্ন হয়। এরপরের সম্রাটরা পারস্যকে আবার আখেমেনীয় যুগের মর্যাদায় ফিরিয়ে নেওয়ার অনেক চেষ্টাই করেছে। কিন্তু কখনোই সফল হতে পারেনি বা কোনো সম্রাটই সাইরাস দ্য গ্রেটের মতো পারস্যকে বিশাল অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃতও করতে পারেনি।
Feature image source : History today