বাংলাহাব গল্প- নদীর বুক চিরে বয়ে চলা অজানা প্রতারণার রক্তস্রোত (শেষ পর্ব )

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এখানে

কিন্তু নয়ন নদীকে যে জায়গায় যেতে বলল, নদী সে জায়গা খুব ভাল চেনে না। সে সি এন জি নিয়ে নিল। নয়নের বাসা বেশ অনেক দূরে এবং কিছুটা ভেতরে। নদী ভাবল কি জানি বাবা, নয়নদের বাসা এত দূরে কেন! কিভাবে যে নয়ন প্রতিদিন এতদূর থেকে কলেজ করে কে জানে! এসব ভাবতে ভাবতে সি এন জি একটা মেইন রোডে নদীকে নামিয়ে দিল, সি এন জি থেকে নেমে নদী নয়নকে ফোন দিয়ে বলল যে, সে মেইন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে এখন কোনদিকে যাবে? নয়ন তাকে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে বলল। নয়ন এসে নিয়ে যাবে। হঠাৎ করে কেন জানি নদীর আর নয়নের বাসায় যেতে ইচ্ছে করল না। মনে হচ্ছিল তার বাসায় ফিরে যাওয়া দরকার। এদিকে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে। চারিদিক তাই একটু শুনশান নিরব। এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ দেখে নয়ন তার সামনে দাঁড়িয়ে । কেন যেন নয়নের চোখের দিকে তাকিয়ে নদী চমকে উঠল কিন্তু কি কারন তা বুঝতে পারল না। নদীর হঠাৎ কেন জানি দৌড়ে চলে যেতে ইচ্ছে  হল। তখনই নয়ন তার ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলল কিরে আজ যে বড় সাদা শাড়ি পড়ে এসেছিস!! তবে কি তুই আমার প্রেমে পড়েই গেলি ! নদী একটা ফ্যাঁকাসে হাসি দিয়ে বলল, নয়ন আজ তোর বাসায় না গেলে হয় না?

নয়ন বলল কেন, আমাকে কি তোর বিশ্বাস হয় না? আরে তোরে তো আর লিটনের ফ্ল্যাটে নিয়ে যাচ্ছি না, আমার বাসায় নিয়ে যাচ্ছি। আমার বাসায় যেতে তোর ভয় কিসের!

নদী অনিচ্ছা সত্বেও নয়নের মন রক্ষার জন্য ওর বাসায় যেতে রাজি হল। বাসায় ঢুঁকেই নয়ন দরজা বন্ধ করে দিল। আর দরজা বন্ধ করে দেয়ার সাথে সাথে নদী টের পেল সে বাসায় তারা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। এবার নদীর ভয় ধীরে ধীরে তীব্র হতে থাকল। নদীর শিরদাঁড়া বেয়ে এক শীতল স্রোত নেমে গেল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল এক সেকেন্ডে। নদীর সকল চিন্তা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে । কোন কিছু আর ভাবতে পারছে না। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে নদী দৌড়ে দরজার দিকে ছুটে যেতে চাইল। কিন্তু নয়ন নদীর শাড়ির আঁচল টেনে ধরল । আঁচল টানতে টানতে নদীর পুরো শাড়ি হেঁচকা টানে খুলে ফেলে নয়ন আবার সেই বাঁকা হাসি হেসে বলল, সখি এত তাড়া কিসে! সবে তো এলে!

নদী কাঁদতে কাঁদতে বলল, নয়ন আমায় ছেড়ে দে, তোর দোহাই লাগে। আমায় ছেড়ে দে প্লিজ। আমি তোর পায়ে পড়ি নয়ন আমায় ছেড়ে দে। নদীর কান্না শুনে নয়ন আরো জোরে হো হো করে হেসে উঠল। বলল, কেন সখী ভালবাসার সাধ কি মিটে গেল! নদী লজ্জায় ক্ষোভে হাত দিয়ে মুখ লুকিয়ে ফেলল। নদী নিজের চোখ আর কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না, যা দেখছে যা শুনছে তার সবই কি সত্যি নাকি কোন ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন!

দোস্ত আসলেই তো এইটা একটা খাসা মাল নিয়া আসছো! এ কথা শুনে নদী চোখ থেকে হাত সরিয়ে দেখল আরো ৪ জন অমানুষ তার সামনে দাঁড়িয়ে কুৎসিতভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নদী নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না কিছুতেই, নয়ন! নয়ন যাকে সে এত বিশ্বাস করত সে কিভাবে তার সাথে এমন অন্যায় করতে পারে! সবকিছু তার কাছে দুঃস্বপ্ন লাগছে, মনে হচ্ছে ঘুম ভেঙে গেলেই সব ঠিক ঠাক দেখতে পাবে। দেখবে সে তার রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাহাড়ের বুকে ধীরে ধীরে ঢলে পড়া সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিল ঘুম ভাঙলেই দেখতে পাবে রাত শেষে ভোর হয়ে গেছে।

কিন্ত না, এটা তো স্বপ্ন নয় । নরপিশাচগুলো ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে। নদীর হাত পা ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে আসছে। সে শুধু নয়নের কাছে হাত জোড় করে বলছে, প্লিজ নয়ন আমাকে ছেঁড়ে দে, প্লিজ। নদীর চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে, সে শুধু দেখতে পেল ৫টা নরপশু তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। এদের মধ্যে একজন যাকে সে ভালবাসেছে মন প্রান দিয়ে, যাকে নিয়ে সে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছে ! তার স্বপ্ন ধীরে ধীরে নরপিশাচদের লালসার আগুনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে! রক্তে ভেসে যাচ্ছে ভালবাসার ঘর বাঁধার স্বপ্ন।

Image Source: Internet

নরপিশাচগুলো নদীর দেহ টেনে হিঁচড়ে রুমের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? নদীর চোখ বেঁয়ে কান্নার ফোঁটা ঝরে পড়ছে। তার মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। সেই আদর করে চুলে বিনুনি করে দেয়া, মুখে তুলে খাইয়ে দেয়া। হঠাৎ দেখতে পেল দূরে তার মা দাঁড়িয়ে আছে তাকে কোলে তুলে নেয়ার জন্য। তীব্র ব্যাথা হচ্ছে। নদীর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে মা আমাকে বাঁচাও, আমি বাঁচতে চাই কিন্তু গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হল না। নদী ঝাপসা চোখে দূরে তার হ্যান্ড ব্যাগ থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিটকে পড়া জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল, সেই লাল খামে ভরা চিঠি পড়ে আছে খুব অবহেলায় রক্তে মাখামাখি হয়ে ।

চিঠিতে লেখা,

আমার নয়ন,

তুই কি জানিস আমি তোকে অনেক ভালবাসি! অবশ্য কিভাবেই বা জানবি, আমি তো কখনো তোকে বলিনি। আজ বলছি আমি তোকে অনেক ভালবাসি। তুই কি আমাকে ভালবাসবি? আমি সারাজীবন ভালবাসা খুঁজে গিয়েছি, পাইনি । তুই কি আমার সেই ভালবাসা হবি? তুই কি পরম নির্ভরতায় হাতে হাত রেখে বলবি, নদী তুই শুধুই আমার ! আর কেউ তোকে না বুঝুক আমি তোকে বুঝব! সারাজীবন তোকে আমার ভালবাসা দিয়ে আগলে রাখব! মাঝে মাঝে খোঁপায় বুনো ফুল গুঁজে দিয়ে কি বলবি, বাহ তোকে তো একদম আমার স্বপ্নের নায়িকার মত লাগছে!

নয়ন, ভালবেসে তুই কি আমার হাতটা ধরবি? তুই কি আমার বিশ্বাস হবি? তোর হাত ধরে কি আমি অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাতে পারব? তুই কি শুধুই আমার হবি নয়ন? শুধু আমাকেই কি ভালবাসবি!!!

                                                                                                                            ইতি,

                                                                                                                            তোর সাদা শুভ্র নদী

নদী আর চোখ খুলে রাখতে পারছে না। মাথায় তীব্র যন্ত্রনা শুরু হয়ে গেছে। হঠাৎ মাথায় শক্ত কিছুর আঘাত টের পেল নদী । কেউ একজন শক্ত কোন হাতুড়ি দিয়ে তার মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করেছে । এক সেকেন্ডের মত নদীর মনে হল তার মগজ বের হয়ে যাচ্ছে । চিঠিটা ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসছে । নরপশুগুলো মদের বোতল হাতে নিয়ে হো হো করে হাসছে আর বলছে দোস্ত, হেব্বী একটা মাল আনছোস এত্তদিন পর! দেইখাই জিনিস আউট হইয়া গেছিল!!! আরে আরে ঐডা কি লাল খামে? ঐ খলিল খামডা নিয়া আস, জোরে জোরে পড়! খলিল খাম হাতে নিয়ে হো হো করে হেসে উঠে বলল, দোস্ত নয়ন এই মাল তো তোমার লগে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাইতে চায়! বুনো ফুল খোঁপায় গুইজা তোমার স্বপ্নের নাইকা হইবার চায়! নয়ন, এক দলা থু থু নদীর মুখে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, শালি! বনের মধ্যে যখন পুইতা রাখুম তহন আমারে লইয়া স্বপ্ন দেহিস!

blank

নদী আর সহ্য করতে পারছে না তীব্র ভয়, আতংক আর ব্যাথায় নদীর চোখ বন্ধ হয়ে এল। চোখ বোজার আগে নদীর চোখ বেঁয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু বেঁয়ে পড়ল আর অস্ফূট স্বরে বলল, এটা তো ভাল হল যে আমি মারা যাচ্ছি, কিন্তু এটা তো খারাপ হল যে আমি এটা জেনে মারা যাচ্ছি এ পৃথিবীতে আমাকে ভালবাসার মত কেউ নেই , এ পৃথিবীতে আমার বিশ্বাস রক্ষা করার মত কেউ নেই। তাই হয়ত এটাই ভাল হল যে, আমি আর বেঁচে নেই”।

 সমাপ্ত