একজন ডাক্তার রোগী দেখে চলছেন, তাদের চিকিৎসা করে চলেছেন। কিন্তু তার না আছে কোনো ডিগ্রি, না কোনো অভিজ্ঞতা! আবার একজন পাইলট আছেন যিনি কখনো বিমান চালাতে শিখেননি, কিন্তু দিব্যি পাইলট পরিচয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অথচ কেউ বুঝতেই পারছে না যে লোকটা আসলে পাইলট নয়! পৃথিবীর অসংখ্য ব্যাঙ্ক একাউন্ট থেকে হাজার হাজার ডলার কেউ একজন উঠিয়ে নিচ্ছে চেক জালিয়াতি করে। কিন্তু জালিয়াত ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এতগুলো খন্ডচিত্র দেখে মনে হতে পারে এগুলোর সঙ্গে কয়েকজন লোক জড়িত। কিন্তু সত্য হচ্ছে এতগুলো কাজের মূল হোতা একজনই। যিনি পৃথিবীর তাবৎ সিকিউরিটি এক্সপার্টদের নাকানিচুবানি খাইয়ে দিব্যি নিজের কাজ করে চলছেন। চরম নাটকীয়তা আর প্রতি মূহুর্তে সাসপেন্স তৈরি করে অবশেষে ঠিকই আইনের হাতে ধরা খেলেন। আর এতকিছু ঘটে গেছে তার ২১ বছর বয়স পার হবার আগেই। যার নাম ফ্রাঙ্ক এবেগনেল, পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জালিয়াতের গল্প শুনব আজ।
এবেগনেল এর জন্ম ২৭ এপ্রিল ১৯৪৮ সালে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে যায়। এরপর বাবার সংস্পর্শে থেকে এবেগনেল ব্যবসায়িক লেনদেন শিখে নেন। টালমাটাল কৈশোর পার করতে গিয়ে তিনি চোরের খাতায় নাম লেখান। একটা সময় এই কাজে বিরক্তি চলে এলে আরও বড় কাজের পরিকল্পনা মাথায় ঘুরতে শুরু করে তার। এবেগনেলের বড় পরিকল্পনার প্রথম বলি হয় তার বাবা। ১৫ বছর বয়সে তার বাবার কার্ড ব্যবহার করে এবেগনেল স্ক্যাম শুরু করেন। এই কাজ প্রায় এক মাস ধরে চলছিল, যতক্ষণ না তার বাবার কাছে ৩২০০ ডলারের বিল নোটিস আসে। তার বাবা সেই সময় ব্যবসায়িকভাবে খুবই করুণ অবস্থায় ছিলেন। এই ঘটনার পর তার মা তাকে বাচ্চাদের জন্য বিশেষায়িত স্কুলে ভর্তি করে দেন। কিন্তু ১৬ বছর পার না হতেই এবেগনেল বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে দেড় ডলার প্রতি ঘন্টায় কাজ শুরু করেন। নিজের আয় বাড়াতে তিনি ড্রাইভিং লাইসেন্সে বয়স ১০ বছর বাড়িয়ে দেন। তখন তার বয়স হয়ে যায় ২৬ বছর!
এবেগনেল চেক জালিয়াতের জন্য সেরা ছিলেন। তবে শুরুর দিকে তাকে বেগ পেতে হয়েছে জালিয়াতির উপায় বের করতে গিয়ে। প্রথমদিকে নিজের কতগুলো একাউন্ট খুলে সেগুলো থেকে বাড়তি অর্থ তুলতে শুরু করেন চেকের মাধ্যমে। একসময় তিনি লক্ষ্য করেন, গ্রাহকরা চেক পূরণের পর একাউন্ট নাম্বারের ঘরটি ফাঁকা রাখছে। তবে ব্যাঙ্ক কর্মকর্তারা এরকম চেকগুলো আলাদা করে দিচ্ছে। তাই এবেগনেল ফন্দি করে চেকগুলোতে নিজের একাউন্ট নাম্বার বসাতে থাকেন। গ্রাহকদের টাকাও তাই তার একাউন্টে জমা হতে শুরু করে। এভাবে মাত্র এক দিনের ব্যবধানে এবেগনেলেলের একাউন্টে ৪২০০০ ডলার জমা হয়।
চেক জালিয়াতি করার অভিপ্রায়ে পাইলটের পোশাক আনিয়ে নিলেও এবেগনেল সত্যি-সত্যি বিমানে চড়ে বসার সিদ্ধান্ত নেন। এই কাজকে নিরাপদ করতে তিনি প্রথমে একজন পাইলটের লাইসেন্স চুরি করে নিজের ছবি বসান, তারপর কিছু কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীকে ভাড়া করেন। তাদের কাজ ছিল স্টুয়ার্টের পোশাক পরে বিমান কর্মকর্তাদের ব্যস্ত রাখা, যাতে এবেগনেল সহজেই ক্লিয়ারেন্স পেয়ে যান। এভাবে তিনি প্রায় ২৫০ টি ফ্লাইটে বিনা খরচে ২৬ টি দেশ ঘুরে ফেলেন। তিনি পাইলট হিসেবে ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ ছিল, সেই এয়ারলাইন্সের পাইলটরা ফ্রি-তে ভ্রমণের সুযোগ পেতেন। সবসময় যাত্রী হিসবে বিমানে ভ্রমণ করলেও মাঝে মাঝে পাইলটরা তাকে বিমান চালাতে অনুরোধ করতেন। জোরাজুরির কারণে বাধ্য হয়ে একবার তিনি সত্যিই ককপিটে বসে যান! আর যাই হোক এবেগনেল তো আর বিমান চালাতে পারেন না! তাই অটোপাইলট মুড ব্যবহার করেই সেবার বেঁচে যান।
নকল পাইলট হিসেবে পরিচয় ফাঁস হওয়ার পর এফবিআই তাকে খুঁজতে শুরু করলে এবেগনেল জর্জিয়ায় গা ঢাকা দেন। এখানে তিনি ডাক্তার পরিচয় নিয়ে স্থানীয় একটি হাসপাতালে চাকরি নেন। নাইট শিফটে ইন্টার্ন ডাক্তারদেরও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পান! ইন্টার্ন ডাক্তাররা নিজেদের জাহির করতে গিয়ে অতিউৎসাহী হয়ে সব কাজ নিজেরাই করতে শুরু করে। আর এবেগনেলও বিপদ থেকে বাঁচতে তাদের সব কাজে সায় দিয়ে যান। এভাবে ১১ মাস এখানে কাজ করার পর তার পরিচয় আবার প্রকাশ পেয়ে যায়।
এফবিআই আর দেশে দেশে পুলিশের তাড়া খেয়ে এবেগনেল ভাবলেন তাকে আইন সম্পর্কে জানতে হবে। এজন্য তিনি হার্ভার্ডের সার্টিফিকেট জাল করেন এবং তিন বারের প্রচেষ্টায় পেশাজীবী পরীক্ষায় পাশ করে আইনজীবী বনে যান। এজন্য তাকে প্রায় সাত মাস পড়াশুনাও করতে হয়েছে।
কিন্তু নাছোড়বান্দা এফবিআইয়ের জ্বালায় টিকতে না পেরে এবেগনেল ফ্রান্সে পালিয়ে যান। সেখানে এক প্রাক্তন প্রেমিকা তাকে চিনে ফেলে এবং পুলিশে খবর দিলে তারা তাকে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে তাকে আমেরিকার কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু এবেগনেল কতৃপক্ষকে ধোকা দিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যায়। এভাবে বেশ কয়েকটি দেশের পুলিশ তাকে আমেরিকায় পাঠিয়ে দিলেও বারবার হাতছাড়া হয়ে যেতে থাকেন তিনি। এমনকি জর্জিয়ায় ডিটেনশন সেন্টারে থাকাকালীনও নিজের পরিচয় জালিয়াতি করে সেখান থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু পুলিশ আবার তাকে গ্রেফতার করে ফেলে।
বিচারে নানা অপরাধে তাকে সাজা দেওয়া হলেও, আমেরিকান সরকারের শিক্ষা কার্যক্রমে যোগ দেওয়ার শর্তে মুক্তি পান তিনি। মুক্তির পর তার কাজ ছিল চেক জালিয়াতদের ধরতে কতৃপক্ষের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় করা। এফবিআই ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময়ে তাকে নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়। পরবর্তীতে গ্রাহকদের চাহিদা পূরণে নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান খুলে বসেন। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের প্রায় ১৪০০০ প্রতিষ্ঠানকে নিরাপত্তানীতি তৈরির কাজে সহায়তা করেন। স্টিভেন স্পিলবার্গ ২০০২ সালে এবেগনেলকে নিয়ে ‘catch me if you can’- নামে একটি সিনেমা তৈরি করেন।
একটা সময় একজন প্রতারক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও, খুব অল্প সময়ের ভেতর আবার নিজেকে শুধরানোর সুযোগ পান। তাইতো নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তার মতো প্রতারক ধরা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা বাড়াতে পরামর্শ দিয়ে আসছেন। তিনি যেভাবে ছোটোবেলায় নির্দেশনার অভাবে ভুল পথে পা বাড়িয়েছিলেন, সঠিক নির্দেশনা আর সুযোগ পেয়ে আবার নিজেকে শুধরে নিয়েছেন। কিন্তু সমাজের বহু মানুষ এখনো ভালো কেয়ারিং না পেয়ে নিজেকে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর হয়তো সমাজের বোঝা হয়ে নিজের জীবন শেষ করে দিচ্ছে।
Featured Image: wired.co.uk