আকাশ আহমেদ, কাস্টমস অফিসের একজন কর্মকর্তা।বয়স ৪৫ এর কাছাকাছি। সৎ হিসেব সুনাম এবং দুর্নাম দুইই রয়েছে।ঘুষ দিতে পারেননি বলে সিনিয়র হয়েও তার প্রমোশন হয়নি বলে এমন কথা অফিসের আনাচে কানাচে বেশ প্রচলিত।নাম আকাশ হলে কি হবে, ব্যস্ততম এই জীবনে কোন দিন আকাশ দেখেছেন কিনা তা আমাদের জানা নেই।
২০১৭ এর জানুয়ারির প্রথম সকালটা অন্য সকল দিনের মতোই হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু কেন জানি আজকের দিনটা অন্যদিনের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। চলুন না ! আজকের সারাদিনটা আমরা তার সঙ্গী হই।
শীত আজ বেশ জাকিয়ে বসেছে। ভোর হতে চলল কিন্তু এখনো সূর্যের দেখা নেই। দূরের কোথাও কোকিলের সুর আকাশ আহমেদকে জাড়িয়ে দিয়ে গেলো। জানান দিল ভোর হয়েছে। গতরাতে একটানা ঘুমাতে পেরে বেশ আরাম মনে হতে লাগালো। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত আকাশ সাহেবের প্রায় রাতে ঘুম ভেঙে যায় বাথরুমে যাওয়ার জন্য।তার প্রতিদিন ঘুম ভাঙে পাশের বস্তির গালাগালি আর গাড়ির তীব্র হর্ণে। কিন্তু কোকিলের ডাকে ঘুম ভাঙা আজকের ভোর সম্পূর্ণই অদ্ভুত। এখনো তো বসন্তকাল আসে নি। এই অসময়ে কোকিল ডাকা সত্যিই বিস্ময়কর। তা হোক। এতো চিন্তা করার মতো সময় তো আর আকাশ সাহবের হাতে নেই। এখনই অফিসে যাবার জন্য তোড়জোড় শুরু করতে হবে। কলে পানি আছে কিনা সেটিও চিন্তার বিষয়। গিন্নিকে গরম পানির কথা বলে বাথরুমের ঢুকতেই বেশ অবাক হলেন ! কলে পানি, তাও আবার বেশ পরিস্কার।
বাথরুম থেকেই গিন্নির গলা শুনতে পেলেন,
‘শুনছো, গরম পানি হয়ে গেছে। তুমি বাথরুম থেকে বের হোও । রহিমা গরম পানি বাথরুমে রেখে আসুক।’
আকাশ বেশ অবাক হলেন।
এই এলাকায় গ্যাস থাকে না বলে প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরেই গিন্নির তীব্র ভৎসর্না শুনতে হয় আরেকটি নতুন ভাড়া বাসা খুঁজে না পাওয়ার জন্য। অন্য সময় গ্যাস থাকলেও তার চাপ এতোই কম থাকে যে চায়ের পানি গরম হতে চল্লিশ মিনিট লাগে।
রহিমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে আজ এতো তাড়াতাড়ি গরম পানি হয়ে গেলো।’
রহিমা খুব হাসি মাখা গলায় বললো, ‘চুলাতে আজ আগুন লাগছে, খালুজান।’
কাজের এই মেয়েটির হাসি মুখ তিনি কোনদিন দেখেছেন বলে মনে করতে পারলেন না।তাই চুলাতে আগুন লেগেছে বলার পরও তিনি তেমন অবাক হলেন না।
অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে ডাইনিং রুমে খেতে বসে স্ত্রী তাহমিনার হাসি মুখ দেখে নিজেকে যেন অন্য জগতের মানুষ মনে হতো লাগল আকাশ সাহেবের।সৎ হিসেব উপার্জন কম বলে স্ত্রী, এক মাত্র পুত্র ও আত্মীয়দের নানা কথা শুনতে হয় বলে তিনি পরিবার ও আত্মীয়-পরিজন থেকে সবসময় নিজেকে একটূ গুটিয়েই রাখেন।
‘ তোমার ব্যাগে টিফিন দিয়েছি, মনে করে খেও’।
তাহমিনার এই কথাই একটু অবাক হলেন।
একটু ফ্যালফ্যাল চোখে তাহমিনার দিকে তাকাতেই বলে উঠলেন,
‘আজকে গ্যাস থাকাতেই তো টিফিনটা করে দিতে পারলাম।’
বাসা থেকে বের হওয়া মাত্রই এক রিক্সা এসে উপস্থিত। এসময়টায় তো রিক্সা পাওয়া খুব দুরূহ। আজকের সব কিছুই যেন অদ্ভুত। রিক্সা থেকে বাস স্টেশনে নেমে রুটের গাড়ির জন্য অপেক্ষা। প্রায় সময় সিট পান না বলে বাসে বাদুঁরঝোলা হয়ে অফিসে যান। কিন্তু আজ যেন একটু অন্যরকম। রাস্তার চারপাশ যেন অন্যদিন থেকে আলাদা।কোথাও কোন কোলাহোল নেই। রিক্সা থেকে নেমেই দেখেন বাসের জন্য সারিবদ্ধ লাইন, যা খুবই বিরল্ । এ লাইনে এধরণের সিস্টেম কখনো তিনি দেখেননি।
একটার পর একটা বিভিন্ন রুটের সুন্দর ঝকঝকে বাস আসতে লাগলো।তার নির্দিষ্ট পরিপাটি বাসটি আসতে দেখেই আকাশ একটু চমকে গেলেন। এই লাইনে এতো সুন্দর বাস তিনি তার চাকুরী জীবনে দেখেছেন কিনা মনে করতে পারলেন না। তিনি বাসে উঠতেই যেন ভুলে গেলেন।
সম্বিত ফিরে পেলেন কন্ডাক্টরের ডাকে। সেই পরিচিত কন্ডাক্টর যার মুখে কর্কশ ধ্বনি আর যাত্রীদের সাথে প্রতিদিনের ঝগড়া তার নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা।
‘ কি স্যার যাবেন না?’
হেল্পারের ডাকে আকাশ সাহেব বাস্তবে ফিরে এলেন। বাসে উঠেই সব যাত্রীরা বসে আছেন। কোথাও কোনো লোক দাঁড়িয়ে নেই। তার জন্য্ও একটি খালি সিট বরাদ্দ রয়েছে। তিনি বসছেন না বলেই যেন ড্রাইভার গাড়ি ছাড়তে দেরি করছে।সিটে বসেই তিনি নিজের হাতে চিমটি কাটলেন বুঝতে তিনি কি জেগে আছেন?
অন্যদিন রাস্তার ধুলোবালির জন্য মাস্ক ব্যবহার করেন। আজকের দিনটি এমনই যে তিনি মাস্কটা নিতে ভুলে গেলেন। মাস্ক না এনে তার যে আপসোস হচ্ছে তা কিন্তু না। আজকের ঢাকা অন্য সকল দিনের মতো না।
আবর্জনার কোন দুর্গন্ধ তার নাকে তো আসছে না। একদিনের মধ্যে ডাস্টবিনগুলো এত সুন্দর করে কে সাজিয়ে রেখে গেল? তাঁর থেকে যেন মিষ্টি সুবাস ছড়াচ্ছে। অদ্ভুত কি অদ্ভুত! গতকালই তো এই রাস্তা দিয়ে অফিস গেলেন। ডাস্টবিনের গন্ধ আর রাস্তার ধুলোর জন্য প্রায় সময় তার সর্দি কাশি লেগে থাকে। কিন্তু আজকের রাস্তায় যেন একটু ধুলো নেই। আরো অবাক করা ঘটনা হলো, বাস এতা দূর চলে এলা, অথচ কোন ট্রাফিক জ্যাম চোখে পড়েলো না।গাড়িগুলো নির্দিষ্ট লাইনে, দূরত্ব রেখে, একটি নির্দিষ্ট স্পীডে চলছে।
রাস্তার ফুটপাতে চোখ পড়তেই দেখলেন, জনসাধনের হাঁটার জন্য পর্যাপ্ত রাস্তা। সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটছেন। মানুষের বা যানবাহনের কোন প্রতিযোগিতা নেই। রাস্তার দুইপাশের ডিভাইডারে সবুজের সমারোহ। তাতে কোথাও ফুটে আছে নানা রঙের ফুল,ফল। কোথাও দেখেন, ডিভাইডারে নানা ধরনের সব্জির গাছ । তাতে বিভিন্ন রকমের তরকারি: শশা, লাউ , করলা, ঢেরশ, পটলের চাষ হয়েছে।
একটা সাইনবোর্ডে লেখা আছে, ‘অর্গানিক এবং সম্পূর্ণ ফরমালিনমুক্ত সব্জি নিতে চাইলে এখানের রাখা বাক্সে চার্ট অনুযায়ী টাকা রাখুন। আর আপনার পছন্দমত সব্জি জমি থেকে তুলে নিন।
আকাশ সাহেব এতো অবাক হলেন যে, তিনি তার পাশের যাত্রীকে জিজ্ঞেসেই করে ফেললেন,
‘ ভাই জাগয়াটা কোথায়?’
পাশের যাত্রীটি একটু অবাক হলেন। তিনি ও আকাশ সাহেব এই বাসের নিয়মিত যাত্রী। প্রায় সময় দুজনের দেখা হয়। কিন্তু কথা হয় না। আমাদের ব্যস্ততম জীবনের নিজের মা, বাবা, সন্তানের খববই যেখানে রাখা হয় না সেখানে পাশের যাত্রীর খবর রাখার মতো এতো সময় আকাশের নেই বললেই চলে।
দুএকবার যাত্রীটি আকাশর সাথে ভাব জন্মাতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সফল হননি। আজকের দিনটি অন্যদিনের চেয়ে আলদা বলেই বোধ হয় আকাশের এই পরিবরর্তন। পাশের যাত্রীটি তাই অবাকই হলেন।
‘ভাই কি যে বলেন, আপনার শরীর ঠিক আছে তো’ এটা তো ফার্মগেইট-বিজয়সরণীর রাস্তা।আপনি, আমি তো সবসময় এই রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করি।’
‘ ওো ‘ আকাশ আর কথা বাড়ালেন না।
বাস কিছু দূর এগুতেই হাতির ঝিলের দিকে তাকাতেই চোখ পড়লো, চারপাশে মানুষ প্রাতভ্রমণ করছে, ডিঙি নৌকা দিয়ে জেলেরা মাছ ধরছে। আর সে তাজা মাছ কেনার জন্য মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।
‘গতকালওতো কি একটা কাজের জন্য হাতির ঝিলের পাশ দিয়ে গিয়েছি। কিন্তু একদিনেই এ পানি পরিস্কার হলো কি করে? ‘ নিজের মনেই প্রশ্ন করেন।
আজকের দিনটা বড়ই এলামেলো। তিনি হঠাৎ খেয়াল করলেন পাশের লোকটি কথা বলছেন।
‘ভাই ! আজকের পত্রিকা দখেছেন?’
‘ না।’
‘ দেখেন ভাই।’
পত্রিকার পাতা খুলতেই প্রথম পৃষ্ঠা জুড়ে লেখা ‘ দুর্নিতিমুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ প্রথম তিনটি দেশের একটি’- টিআইবির সর্বশেষ সমীক্ষা।
তার নিচে আরেকটি লেখা,
‘ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নগরী হিসেবে ঢাকা অন্যতম প্রধান নগরীল স্বীকৃতি পেয়েছে ইউনেস্কো থেকে।’
বাসে আজ কন্ডাক্টরের কোন উচ্চবাচ্য নেই। ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে কোন চিল্লাচিল্লি নেই। যাত্রীদের দিকে দৃষ্টি দিতেই দেখতে পেলেন, কারো হাতে গল্পের কেউ কেউ হেডফোন দিয়ে গান শুনছে । কয়েকজন কলেজ ছাত্র বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠা নিয়ে খুবই উত্তেতি। অন্য কয়েকজন অস্কার পাওয়া বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত। কেউ বা এবারের নোবল প্রাইজ কোন বাঙালির কাছে যাবে তা নিয়ে চিন্তিত।
বাসেব যাত্রীদের এসব কথা শুনতে শুনতে বাস থেকে নেমে অফিসে প্রবেশ করেন। অফিসে ঢুকেই আকাশ দেখেতে পান তার বস তার রুমে বসা। এতা সকালে বসকে দেখে একটু অবাকই হলেন।অন্যান্য কলিগরা ফুলের তোড়া নিয়ে উপস্থিত্। আকাশ সাহেব ঘাবড়ে গেলেন।
‘স্যার আপনি আমার রুমে?’
‘ আপনার রুমে আসতে কি মানা আছে না কি।’
‘না, তা না। আপনি কখনো এদিকে আসেন নাতো, তাই ।’
‘আকাশ সাহেব, ‘মিষ্টির অর্ডার দিন্।’
‘কেনো স্যার, কিসের জন্য মিষ্টি।’
‘ আপনি কি কোন খবর রাখেন না। আপনার প্রমোশন হয়েছে আর সৎ অফিসার হিসেবে রাষ্ট্রপতি তাঁর অফিসে আপনাকে মধ্যাহ্ন ভোজনের দাওয়াত দিয়েছে।’
‘এই সে চিঠি।’
‘সরি, আপনার প্রমোশোনটা এতাদিন ঝুলিয়ে রাখার জন্য এবং আপনাকে না জানিয়ে চিঠিটি খুলে ফেলার জন্য। আসলে এতা কৌতুহল হচ্ছিল যে, কি বলবো।’
এই সেই ব্যক্তি যিনি এতাদিন তার সততার জন্য বিদ্রুপ করতেন এবং দুর্নিতি না করার জন্য সবসময় আকাশকে নানাভাবে হেনস্তা করতেন।আজ ২০১৭ সালটি যেন আকাশের পৃথিবী এক নতুন রুপে দেখা দিলো। তিনি আনন্দ বেদনামিশ্রিত গলায় কিছু বলতে যাবেন, এমন সময়….
‘কি হলো আর কতক্ষণ ঘুমাবে’ – অফিসে যাবে না।’
গিন্নির চিৎকার আর পাশের বস্তির আওয়াজে আকাশ সাহেব এক অদ্ভুত ঘুম কাতর চোখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন।
এমনি আকাশ সাহেবের মতো অনেকের স্বপ্ন নিজেকে নিয়ে, বাংলাদেশকে নিয়ে। সবার স্বপ্ন যেন বাস্তবে রূপ পায় সে প্রত্যাশায় নতুন বছর সকলের জন্য আনন্দ বয়ে আনুক, নতুন বছর সকলকে সুভেচ্ছা