অপারেশন থিয়েটারের বাইরের লাল বাতিটি এখনো তার মৃদু আলো নিয়ে জ্বলজ্বল করছে । তারমানে অপারেশন এখনো শেষ হয়নি । সকলের দৃষ্টি এখন ঐ ছোট বাতির আলোতে যেন আটকা পড়েছে । বাতিটি হঠাৎ নিভে গেছে । ডাক্তারবাবু বেরুতেই নিরুপমা দেবী ছুটে যান তার কাছে ।
-“ আমার ছেলে এখন কেমন আছে ? ও সুস্থ হয়ে যাবে তো ? ওর কিছু হবেনা তো ?’’
-“ ভয় পাওয়ার কিছু নেই । আপনার সন্তান এখন বিপদমুক্ত । জ্ঞান ফিরতে সময় লাগবে । তারপর ওর সাথে আপনারা চাইলে দেখা করতে পারবেন কিন্তু তার আগে নয় ।‘’
-“ আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ জানাবো ‘’ বলতে গিয়ে কথা আঁটকে যায় রমেশের ।
– “ধন্যবাদ যদি দিতে হয় তবে এই লোকটিকে দিন। ইনি না থাকলে পরিস্থিতি হয়তো আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেত । ‘’
সাদা শার্ট পরিহিত লোকটি অনেকক্ষণ যাবৎ দূরে দাঁড়িয়ে আছে । কাছে আসবেই বা কি করে ড্রাইভার বলে কথা । মালিকের পাশে দাঁড়ানোর অধিকার টুকু অনেক সময় আমরা তাদের দিতে চাইনা । ড্রাইভার মানুষ পাশে দাঁড়ালে যদি আমাদের সম্মানের ঘাটতি দেখা যায় ।
৪৫ বছরের মধ্যবয়স্ক লোক হচ্ছেন বাদল আলী, সবার বাদল ড্রাইভার । জীবনের অনেকটা সময় পার করে দিয়েছেন এই যানবাহন নামক বস্তুটির সাথে । রমেশের বাবা আর বাদল আলী ছিলেন একই গ্রামের লোক । বন্যায় পরিবারের সবাইকে হারিয়ে আশ্রয় পান রমেশদের বাড়িতে । সে থেকেই এটিই তার পরিবার । রমেশকে তিনি সন্তানের মতো স্নেহ করলেও রমেশ তাকে তাদের বাড়ির আশ্রিত ছাড়া আর বেশি কিছু ভাবতোনা বলা ভালো ভাবতে চাইতো না । কথার ছলে অপমানের তীর ছুঁড়তেও তার বিবেকে একটুও লাগতো না । রমেশের বাবা ব্যতীত আর দুটি মানুষ এই ড্রাইভার টিকে যথেষ্ট ভালোবাসতো । রমেশের স্ত্রী আর তাদের ৬ বছরের ফুটফুটে ছেলে । ছেলেটি যখন তাকে ‘পাইলট দাদু ‘ দাদু বলে ডাকে তখন তিনি সব অপমানের কথায় ভুলে যান । যদি তার নিজের ছেলেটি বেঁচে থাকতো আজ হয়তো এরকম একজন তাকে দাদু বলে ডাকতো । ছেলে আর বৌ এর স্নেহের ব্যাপারটি রমেশ ঠিক মেনে নিতে পারতোনা ।
“সামান্য এক ড্রাইভার কে নিয়ে তোমাদের এতো মাতামাতি কিসের বুঝিনা” ।
“এইভাবে বলছো কেন । ভুলে যেওনা উনি আমাদের গুরুজন । তাছাড়া উনি তো আমাদের পরিবারেরই একজন । ‘’
“শোন , অতো আধিখ্যেতার কিছু হয়নি । রাস্তার কাউকে পরিবারের লোক বলে তুমি ভাবতে পারলেও আমি পারবোনা । বিট্টুকে ঐ লোকটার থেকে দূরে রাখবে । আমার কাছে ওর মতলব বেশ সুবিধার ঠেকেছেনা । “
“ ছিঃ ছিঃ । যে লোক টা তোমাদের এতো ভালোবাসে ,তার সম্পর্কে এমন বাজে কথা কি করে বেরুই তোমার মুখ দিয়ে ! মনে রেখ এতো অহংকার ভালো নয় ।‘’
অনেকদিন পর নিজ গ্রামে এসেছে বাদল আলী । সবকিছুই অনেক পাল্টে গেছে । তার বাড়িটিকে চেনাই যাচ্ছেনা । লোকজন না থাকলে যেমনটি হয় । গ্রাম থেকে ফেরার সময় তো আর খালি হাঁতে যাওয়া যায়না । তার সাধ্যমতো যতটুকু সম্ভব তিনি নিলেন ।
_ “ পাইলট দাদু, তুমি এসেছ ? এতদিন কথায় ছিলে বলতো । জান আমার কতটা মন খারাপ করতো তোমার জন্য । ‘’
“ আর মন খারাপ করতে হবেনা দাদুভাই । এইতো আমি চলে এসেছি ।
“ আমার জন্য কিছু আনোনি ?’
“ আমার দাদুভাইয়ের জন্য কিছু আনবোনা তা কি করে হয় ! এই নাও। “
“ মা দেখো , দাদু আমার জন্য কি সুন্দর একটি পুতুল এনেছে । মেলা থেকে এনেছ বুঝি ? আমিও তোমার সাথে মেলায় যাব ।“
হঠাৎ পেছন থেকে কেও একজন এসে বিট্টুর হাত থেকে পুতুলটি কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় ।
“ এইসব মাটির সস্তা খেলনা ভিখারির ছেলেদের হাঁতে মানাই , আমার ছেলের হাঁতে নয় ।আর এতো টাকা আসে কি করে ? তাইতো বলি আজকাল গাড়ির পেট্রোল জলের মতো খরচ হচ্ছে কেন । আমার তো অনেক আগে থেকেই সন্দেহ হতো । বাবার জন্যই কিছু বলতে পারতাম না । আজকে হাঁতে নাতে ধরেছি ‘’।
বাদল আলী কিছু না বলেই সে জায়গা হতে দ্রুত চলে গেলেন । তার চোখের জল কেউ দেখুক হয়তো এটা তিনি চাননি । পরেরদিন সকালে গাড়ির চাবিটি রমেশের বাবার হাঁতে দিয়ে বললেন ,
“ চললাম । নিজের খেয়াল রাখবেন আর বিট্টু দাদুভাইকে একটু দেখে রাখবেন । বড্ড দুষ্ট হয়েছে আমার দাদুভাইটা ।“
চলেই যাক । আজ সত্যি আটকানোর ভাষাটা রমেশের বাবার কাছে নেই ।
ছেলেটার স্কুল ছুটি হয়েছে তো দেরি হচ্ছে । এখনো ফিরছেনা কেন ? এদিকে নতুন ড্রাইভার তার ওপর মোবাইল টাও বন্ধ বলছে । ফোনের রিং হতেই তার ওপর ঝাপটে পড়ে নিরুপমা ।
_ “ কি ব্যাপার, মোবাইল বন্ধ কেন তোমার । বিট্টূ কোথায় । বাড়ি ফিরতে দেরি কেন হচ্ছে ।‘’
“ ম্যাডাম , আমাদের গাড়ির এক্সিডেন্ট হয়েছে । আমি হাসপাতাল থেকে বলছি আপনারা জলদি এখানে চলে আসুন “ ।
নিরুপমা নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা । “ একটু শান্ত হও নিরু । কিছু হবেনা আমাদের বিট্টুর ।‘’ “ ডাক্তার বাবু , বিট্টু এখন কোথায় ?’’ ।
“ আপনার এসে গেছেন । শুনুন জলদি ও নেগেটিভ রক্তের জোগাড় করুন । আমরা অনেক জায়গায় খোঁজ চালিয়েছি কিন্তু পায়নি । এখন ভালো হয় যদি আপনাদের চেনাজানা কেউ থাকে আর সে যদি রক্ত দিয়ে এচ্ছুক থাকে ।নয়লে আমাদের কিছু করার থাকবেনা ।“’
– “ কিছু একটা করুন । যত টাকা লাগে আমি দিব । “
“ দেখুন টাকা দিয়ে সবকিছু হয়না ।“
“ রক্ত আমি দিব । আপনি সব কিছুর ব্যবস্থা করুন ।“’
সেই বাদল ড্রাইভার । আজ এই গরিব লোকটি না থাকলে হয়তো বিট্টুও থাকতো না ।
“ খুব তো অহংকার তোমার । নাও এইবার নিজের ছেলের শরীর থেকে গরীবের রক্ত টা বের করে নাও । “
ক্ষমা চাওয়ার ভাষাটাও রমেশ আজ খুঁজে পাচ্ছনা । অহংকারের ছায়াটাকে সরিয়ে আজ এই লোকটি তাকে আলো দেখালো ।