পরনে মালকোঁচা ধুতি, মাথায় সাদা পাগড়ি, গায়ে লাল ব্যাজ লাগানো শার্ট, পায়ে রাবার সোলের কাপড়ের জুতো। সংখ্যায় সাত জন ওরা। সবার সামনে ছোট খাটো গড়নের একজন। বয়স আর কতই বা হবে- ২০/২১? চেহারায় এখনো বাচ্চা-বাচ্চা ভাব, অদ্ভুত এক কমনীয়তা খেলা করছে তাতে। কিন্তু আপনার ভুল ভাঙ্গবে তার হাতের দিকে তাকালে- এক হাতে রিভালবার, অন্যহাতে পিকরিক এসিডের তৈরি ভয়াল দর্শন হাতবোমা! অবাক হয়ে তার চেহারার দিকে তাকালে এখন আর সেখানে আগের সেই কমনীয়তা দেখতে পাবেন না, বরং সেখানে এসে ভীড় করেছে ইস্পাত কঠিন দৃঢ় সংকল্প। চোখ দুটো আশ্চর্য্য রকমের শীতল, ধীরে ধীরে সেখানে ফুটে উঠেছে এক রাশ ঘৃণা। ইনিই এই ছোট্ট গ্রুপটির দলনেতা। শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে ছোটখাট গড়নের মানুষটি চিৎকার করে উঠলেন- চার্জ! সাথে সাথেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল ‘Dogs and Indians not allowed’ সাইনবোর্ড ঝোলানো ভবনটির উপর। মুহুর্মুহু বিস্ফোরণ আর কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেল চারপাশ, থেকে থেকে বন্দুকের শব্দ ভেসে আসছে। নাচ-গানে মত্ত থাকা ভেতরের হল রুমটিতে মূহুর্তেই সৃষ্টি হল নারকীয় পরিবেশ!
কি? ভাবছেন কোন একশন ফিল্মের ধারা বর্ণনা করছি? মোটেও না! বলছিলাম ব্রিটিশবিরোধী মুক্তিবাহিনীর তৎকালীন পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের কথা। আর আক্রমণের নেতৃত্ব দেয়া সেই ছোটখাটো গড়নের মানুষটি ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের প্রথম নারী শহীদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার! ১৯৩২ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর, ক্লাবে সফল আক্রমণ শেষে ফেরার পথে তিনি গুলিবিদ্ধ হন, পরে ব্রিটিশ সেনাদের হাতে ধরা পড়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। আজ ৫ই মে, এই মহান বিপ্লবীর ১০৬ তম জন্মবার্ষিকী। তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করতেই আজকের বাংলাহাবের এই বিশেষ আয়োজন।
তৎকালীন ইউরোপিয়ান ক্লাব
১৯১১ সালের ৫ই মে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার ছিলেন মিউনিসিপ্যালিটির হেড ক্লার্ক। আর মা প্রতিভা দেবী ছিলেন পুরোদস্তুর গৃহিণী। ছয় ভাই-বোনের মাঝে প্রীতিলতা ছিলেন দ্বিতীয়, মা আদর করে তাকে ডাকতেন ‘রাণী’ বলে। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় বেশ ভাল ছিলেন প্রীতি। খাতেখড়িটা মায়ের কাছেই, এরপর ১৯১৮ সালে চট্টগ্রামে অবস্থিত ডাঃ খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সরাসরি তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন তিনি। ১৯২৮ সালে এই স্কুল থেকেই কৃতিত্বের সাথে মেট্রিক্যুলেশন (বর্তমানের এসএসসি) পরীক্ষায় পাশ করেন তিনি। ভর্তি হন ঢাকার ইডেন কলেজে। ১৯৩০ সালের ইন্টারমিডিয়েট পাশ পরীক্ষায় (বর্তমানের এইচএসসি) অংশ নিয়ে মেয়েদের মাঝে প্রথম স্থান অধিকার করেন, সম্মিলিত মেধাতালিকায় তার অবস্থান ছিল পঞ্চম। এরপর বিএ পড়তে যান কলকাতার বেথুন কলেজে। ১৯৩২ সালে ডিসটিংশান নিয়ে বিএ পাশ করেন। তবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে তার এবং তার আরেক সহপাঠী বীণা দাস গুপ্তের রেজাল্ট আটকে দেয়া হয়! (অবশেষে ২২ই মার্চ, ২০১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তাদের মরণোত্তর স্নাতক ডিগ্রী প্রাদান করে সম্মানিত করা হয়।)
প্রীতির মেট্রিক্যুলেশন পরীক্ষার সনদপত্র
বেথুন থেকে চট্টগ্রাম ফিরেই নন্দনকান বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে (বর্তমানে অপর্ণাচরণ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়) প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন। ছোটবেলায় দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদারের কাছ থেকে ধার নিয়ে যখন ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বায়োজপ্ত নিষিদ্ধ বই ‘দেশের কথা’, ‘বাঘা যতীন’, ‘ক্ষুধিরাম’ পড়তেন, তখন তার খুব আফসোস হত- কেন আমরা মেয়েরা এমন কিছু করতে পারি না? এই চিন্তা থেকেই ইডেনে পড়াকালীন বিপ্লবী সংগঠন ‘দিপালি সংঘ’ আর বেথুনে থাকাকালীন ‘ছাত্রী সংঘে’র সাথে জড়িত ছিলেন। তখন তার কার্যক্রম শুধু মিটিং-মিছিলে সীমাবদ্ধ থাকলেও সত্যিকারের বিপ্লবে যোগ দেয়ার সৌভাগ্য হয় চট্টগ্রামে ফিরে শিক্ষকতায় যোগ দেয়ার পর।
কলকাতায় স্থাপিত প্রীতিলতার ভাস্কর্য
একদিন সকালে পত্রিকায় পড়েন ‘চাঁদপুর স্টেশনে ইন্সপেক্টর হত্যার অভিযোগে দুই বাঙালি যুবক রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ও কালীপদ চক্রবর্তী গ্রেফতার’। রামকৃষ্ণকে চিনতেন না তিনি। নিজেকে রামের বোন পরিচিয় দিয়ে জেলের ভিতর প্রায় চল্লিশবার রামকৃষ্ণের সাথে দেখা করেন তিনি। রামকৃষ্ণের কাছেই শোনেন মাস্টারদা সূর্যসেনের অসীম বীরত্বের কথা। ধীরে ধীরে তার মাঝে মাস্টারদার সাথে দেখা করার ইচ্ছা প্রবল হয়। অবশেষে একদিন সেই সুযোগ এসেও যায়। ১৯৩২ সালের ১৩ই জুন চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের প্রধান কেন্দ্র ধলঘাটের ঘাঁটিতে মাস্টারদার সাথে দেখা করতে যান প্রীতি, সেই ঘাঁটিতে তখন বিপ্লবী নির্মল সেন আর অপূর্ব সেনও উপস্থিত ছিলেন। তাদের এই গোপন সাক্ষাতের কথা পুলিশ আগে থেকেই জানত। পুলিশের পাতা ফাঁদে অজান্তেই জড়িয়ে পড়েন বিপ্লবীরা। যখন টের পান, দেরি হয়ে গেছে অনেক। পুলিশ চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে। শুরু হয় গোলাগুলি। কোনমতে প্রীতিলতা আর মাস্টারদা পালিয়ে আসতে সক্ষম হলেও মারা পড়েন বাকি দুজন। এই ঘটনার পর মাস্টারদা প্রীতিলতাকে বলেন চুপচাপ বাড়ি ফিরে গিয়ে স্কুলের কাজে যোগ দিতে, তাহলে পুলিশ আর তাকে সন্দেহ করবে না। মাস্টারদার কথা মত প্রীতি ফিরে আসলেও ব্রিটিশদের কঠোর নজরদারিতে পড়ে যান। পরে গ্রেফতার এড়াতে একরকম বাধ্য হয়েই দুজন সহ-বিপ্লবী মনিলাল দত্ত এবং বীরেশ্বর রায়ের সাথে ৫ই জুলাই আত্মগোপনে চলে যান তিনি। বাড়ি থেকে বের হবার আগে মাকে বলেছিলেন- ছাত্রী পড়াতে যাচ্ছেন! তার এই আত্মগোপনের খবর ১৩ জুলাই আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। “চট্টগ্রামের পলাতিকা” শিরোনামের এই সংবাদে লেখা হয় “চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার ধলঘাটের শ্রীমতী প্রীতি ওয়াদ্দাদার গত ৫ই জুলাই, মঙ্গলবার চট্টগ্রাম শহর হইতে অন্তর্ধান করিয়াছেন। তাঁহার বয়স ১৯ বৎসর। পুলিশ তাঁহার সন্ধানের জন্য ব্যস্ত”।
২০১২ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উদ্দ্যোগে স্থাপিত প্রীতিলতার ভাস্কর্য
১৯৩২ এর ১০ আগষ্ট ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের দিন ধার্য করা হয়। শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সাতজনের একটা দল সেদিন ক্লাব আক্রমণ করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। মাস্টারদা ঠিক করেন সেপ্টেম্বরে আবারো হামলার চেষ্টা চালাবেন। হামলার নেতৃত্বের দায়িত্ব এবার নারী বিপ্লবীদের দেয়ার ব্যাপারে মনঃস্থির করেন। ঠিক হয় বিপ্লবী কল্পনা দত্ত এই আক্রমণের নেতৃত্ব দেবেন, প্রীতি থাকবেন তার সহযোগী হিসাবে। কিন্তু আক্রমণের মাত্র এক সপ্তাহ আগে কল্পনা পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। পুরো অভিজানের দায়িত্ব এসে পড়ে প্রীতির একার ঘাড়ে।
ইউরোপিয়ান ক্লাবের সামনে প্রীতিলতা স্মরণে স্মৃতিফলক
২৩ সেপ্টেম্বর রাতে আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। ইউরোপিয়ান ক্লাবের পাশেই ছিল পাঞ্জাবীদের কোয়ার্টার, এরপাশ দিয়ে যেতে হবে বলেই প্রীতি পুরুষদের ছদ্মবেশ নেন। বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতা যোগেশ মজুমদার রাত আনুমানিক সোয়া এগারোটার দিকে ক্লাবের ভেতর থেকে আক্রমণের সংকেত দেন। সংকেত পেয়েই বিপ্লবীরা তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আক্রমণে জড়িয়ে পড়েন।
আক্রমণ শেষে সবাই ফিরে আসলেও প্রীতি গুলিবিদ্ধ হন। আহত অবস্থায় ধরা পড়ার চাইতে প্রীতি মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করেন। নিজের রিভালবারটি আরেক বিপ্লবী যোদ্ধা কালীকিংকর দে’র কাছে দিয়ে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। দলের বাকিরা তাদের কমরেডের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। পরদিন সকালে যখন প্রীতির লাশটি আবিষ্কৃত হয়, প্রথম দেখায় সবাই তাকে পুরুষই ভেবেছিল। কিন্তু মাথার পাগড়ি সরিয়ে যখন জানা যায় আক্রমণকারী একজন মেয়ে ছিল, এই খবর শুধু ব্রিটিশ পুলিশ নয়, গোটা ব্রিটিশ সম্রাজ্যকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল!
এই স্থানটিতে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন প্রীতি। সিটি কর্পোরেশনের উদ্দ্যোগে স্থানটি সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে
মৃত্যুর আগে মা-কে একটি চিঠি লিখেছিলেন তিনি। সেই চিঠি আজো পৃথিবীর প্রতিটা কোণায় স্বাধীনতার জন্যে লড়তে থাকা প্রতিটি বিপ্লবীকে প্রেরণা যোগায়। চিঠিতে লেখা ছিল- ‘মাগো, অমন করে কেঁদোনা! আমি যে সত্যের জন্য, স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে এসেছি, তুমি কি তাতে আনন্দ পাও না? কী করব মা? দেশ যে পরাধীন! দেশবাসী বিদেশির অত্যাচারে জর্জরিত! দেশমাতৃকা যে শৃঙ্খলভাবে অবনতা, লাঞ্ছিতা, অবমানিতা! তুমি কি সবই নীরবে সহ্য করবে মা? একটি সন্তানকেও কি তুমি মুক্তির জন্য উত্সর্গ করতে পারবে না? তুমি কি কেবলই কাঁদবে?’
প্রীতিলতার সাহসিকতা, বীরত্ব আর সংগ্রাম নিয়ে এখন পর্যন্ত বেশকিছু গবেষণাধর্মী বই লেখা হয়েছে। এরমাঝে উল্লেখযোগ্য হল-
বীরকন্যা প্রীতিলতা : পূর্ণেন্দু দস্তিদার।
বীরকন্যা প্রীতিলতা : পংকজ চক্রবর্তী।
বীরকন্যা প্রীতিলতা : অজয় রায়।
বীরঙ্গনা প্রীতিলতা : হরিপদ দে
প্রথম বিপ্লবী নারী শহীদ প্রীতিলতা : চিন্ময় চৌধুরী।
ভালোবাসা প্রীতিলতা : সেলিনা হোসেন।
প্রীতিলতার চিঠিপত্র ও শেষ ইচ্ছা [দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা]
নির্মল সেন ও প্রীতিলতা [দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা]
সূর্য সেন ও প্রীতিলতা [দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা
প্রীতিলতা ও কল্পনা [দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা]
প্রীতিলতার বিপ্লবী জীবন [দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা]
প্রীতিলতার কৈশোর ও যৌবনের ইচ্ছা ও আদর্শ [দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা]
সশস্ত্র নারী বিপ্লবী ও প্রীতিলতা [দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা]
প্রীতির নিজ গ্রামে তার স্মরণে স্থাপিত স্মৃতি স্তম্ভ
প্রীতি বেশ ভালো বাঁশি বাজাতে পারতেন। বেথুন কলেজে থাকা অবস্থায় বানারসি ঘোষ স্ট্রিটের হোস্টেলের ছাদে বসে বাঁশি বাজাতেন। আর তা মন্ত্রমুগ্ধের উপভোগ করত কলেজের বাকি মেয়েরা। মেট্রিক পরীক্ষার পর রেজাল্টের অপেক্ষায় থাকা বন্ধের সময় তিনি একটি নাটকও লিখেছিলেন! এমনকি বান্ধবীরা মিলে সেই নাটক মঞ্চস্থ করে সবাইকে তাকও লাগিয়ে দিয়েছিলেন! এই সময় তার জন্য একটি বিয়ের প্রস্তাবও আসে, যদিও তিনি দৃঢ়স্বরে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন! ইডেনে পড়াকালীন ছাত্রী সংঘের সদস্য থাকা অবস্থায় লাঠিখেলা আর ছোরা চালানোতেও পারদর্শীতা অর্জন করেছিলেন তিনি। মৃত্যুর পর তার কাছ থেকে বেশ কিছু লিফলেট উদ্ধার করা হয়েছিল। এগুলোর একটিতে লেখা ছিল- ‘আমার দেশের ভগিনীরা আজ থেকে নিজেকে আর দুর্বল মনে করিবেন না।’ সত্যিকার অর্থেই প্রীতি চেয়েছিলেন এদেশের নারীরাও যেন পুরুষের পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিটি সংগ্রামে সামিল হয়। প্রীতি শুধু স্বাধীনতা কামী মানুষই নয়, সবার জন্যই অনন্ত প্রেরণার উৎস।