একটা সময় ছিল যখন আমাদের কল্পনার দুনিয়ার প্রায় সবটা জুড়ে থাকত আশ্চর্য এক জাদুর জগত! হ্যারি পটার আর তার সঙ্গীরা মিলে নিজেদের ভালো জাদু ব্যবহার করে একে-একে পরাজিত করত সব খারাপ জাদুর শক্তিগুলোকে।তখন বইয়ের প্রতিটি অক্ষর যেন হয়ে উঠত জীবন্ত।নিজেকে হ্যারি’র জায়গায় বসিয়ে দিব্যি কল্পনার জগতে চড়ে বেড়াতাম।অনেকটা সময় হয়তো কেটে গিয়েছে ঘড়ির কাঁটার তালে।কিন্তু এতগুলো বছর পরও কিশোরদের কাছে সমান জনপ্রিয় ‘হ্যারি পটার’-এর এই সিরিজটি।
আজ আমরা হ্যারিকে নিয়ে লিখব না।লিখব, আকাশছোঁয়া জনপ্রিয় এই সিরিজের লেখিকাকে নিয়ে।হ্যাঁ,জোয়ান ক্যাথলিন রাউলিং কিংবা সবার পরিচিত জে.কে রাউলিং।আমাদেরকে স্বাচ্ছন্দ্যে জাদুর জগতে ঘুরিয়ে আনা মহিলাটির নিজের জগতটা কেমন?
বলা হয়ে থাকে,পৃথিবীতে লেখালেখি করে প্রথম বিলিয়নিয়ার বনে যাওয়া লেখিকা তিনি। রাতারাতি জনপ্রিয়তা পাওয়া এ লেখিকার ক্যারিয়ারের শুরুটা মোটেই সহজ ছিল না।প্রথমবার তিনি যখন ‘হ্যারি পটারের’ পান্ডুলিপি নিয়ে একটি প্রকাশনীতে যান,প্রকাশনীর মালিক তো হেসেই খুন।এ আবার কেমন সাহিত্য!”এগুলো কেউ পড়বে না”-এই বলে তাঁকে বিদায় করে দেওয়া হয়।কিন্তু তিনি দমে না গিয়ে সেখান থেকেই নিজের আসল যাত্রাটা শুরু করেন।
১৯৬৫ সালের ৩১ শে জুলাই ইংল্যান্ডে জে.কে রাউলিং এর জন্ম।তাঁর বাবা-মা দু’জনই চাকরিজীবী হওয়ায় ছোটবেলা কেটেছে বই পড়ে। আর ছোট বোনের গল্প শুনার আবদার মেটাতে টুকটাক গল্প লিখতেন রাউলিং।ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যে পড়ালেখা করার পর লন্ডনে পাড়ি জমান রাউলিং।সেখানে অফিস সহকারীর একটা চাকরি জোগাড় করেও এলোমেলো জীবন ধারণের জন্য সে চাকরিটা হারান।তাঁর কাছে প্রতিদিনকার রুটিন মেনে চলার চেয়ে কল্পনা করাটা সহজ ছিল!তাই প্রতিনিয়তই তাঁর মাথায় ঘুরঘুর করত কেবল গল্পের আইডিয়া।
চাকরি ছাড়ার পর রাউলিং পর্তুগাল পাড়ি জমান। এখানেও তিনি ভাগ্যের সন্ধানে নেমে পড়েন।যদিও তাঁর মাথা জুড়ে কেবলই গল্প আর গল্প।এভাবেই হয়তো দিন কেটে যেত।কিন্তু সেসময় তাঁর পরিচয় হয় একজন পর্তুগিজ সাংবাদিকের সঙ্গে।কিছু সময়ের মাঝেই প্রেমে পড়ে যান দু’জনে। সেই প্রেমের গল্প বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়।তাদের কোল জুড়ে ফুটফুটে এক বাচ্চা মেয়ে জন্ম নেয়।কিন্তু সম্পর্কটা জমে ওঠার আগেই সংসার ভেঙে যায় দু’জনের। রাউলিং তখন মেয়েকে নিয়ে আবার ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান।
দেশে ফেরার পর রাউলিং এর করার মত কিছু ছিল না।একদিকে বিচ্ছেদ,অগোছালো জীবন আর অন্যদিকে মেয়ে আর কোন চাকরি নেই।এই চরম মুহূর্তে তাঁর মাথায় একটাই কেবল সমাধান আসে। আত্মহত্যা করবেন তিনি!
কিন্তু মেয়ের কথা চিন্তা করে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবেন বলে ঠিক করেন রাউলিং।এরপর চিকিৎসকের কাছ থেকে যথাযথ চিকিৎসা নিয়ে আবার লেখালেখির কাজে নতুনভাবে নেমে পড়েন তিনি।তাঁর প্রথম উপন্যাস‘হ্যারি পটার এন্ড ফিলোসফার’স স্টোন’। প্রথম ১২ জন প্রকাশক এই বইটি ব্যবসায়িক ক্ষতির কথা ভেবে প্রকাশ করেননি।পরবর্তীতে একজন প্রকাশক বইটি প্রকাশ করতে রাজি হন।তখন তাঁকে মাত্র ১৫০০ পাউন্ড অগ্রিম হিসেবে দেয়া হয়।এভাবে দীর্ঘ সাত বছরের সাধনা ছাপার কাগজে পরিণয় পায়।১৯৯৭ সালে প্রথম বইটি প্রকাশের পর ক্রমেই জনপ্রিয় হতে থাকে এই ফ্যান্টাসি সাহিত্যটি। ‘রাতারাতি’ জিরো থেকে হিরো বনে যান রাউলিং!এরপর একে-একে হ্যারি পটার সিরিজের সবগুলো বই আলাদাভাবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে আসে।বিশ্বব্যাপি মিলিয়ন-মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে হ্যারি পটার সিরিজ।জে.কে রাউলিং-কে এরপর আর অর্থাভাবে পড়তে হয়নি।
১৯৯৮ সালে হ্যারি পটার সিরিজটি প্রথম ভিজুয়্যাল পর্দায় আসে।এরপর একে-একে সবগুলো বই থেকেই সিনেমা তৈরি হয়।এতসব কীর্তির সম্মাননাও হাতে-নাতে পেতে থাকেন রাউলিং।এর মাঝে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সম্মাননা হলো হুইটটেকার প্লাটিনাম বুক এওয়ার্ড,স্কটিস আর্টস কাউন্সিল বুক এওয়ার্ড,নেসলে স্মার্টিস বুক প্রাইজসহ অসংখ্য সম্মাননা।এছাড়া কার্নেগী মেডেলের জন্য মনোনয়ন পান তিনি।দেশ-বিদেশের অনেক নামকরা পত্রিকা এবং ম্যাগাজিন সেরা ফ্যান্টাসি লেখক হিসেবে তাঁকে বেছে নিয়েছে।
হ্যারি পটার সিরিজ ছাড়াও বড়দের জন্য লেখা ‘দ্য ক্যাজুয়াল ভেকেন্সি’-ও পাঠক সমাজে সমানভাবে সমাদৃত। হ্যারি পটার সিরিজের সর্বশেষ বই ‘হ্যারি পটার এন্ড দ্য কার্রস্ড চাইল্ড’ প্রকাশের মাধ্যমে সিরিজটির পূর্ণতা দিয়েছেন জে.কে রাউলিং।সর্বশেষ বইটির চমক হলো বইটিতে হ্যারি থাকছে একজন মধ্যবয়ষ্ক অভিভাবক হিসেবে।
এত-এত প্রাপ্তির পরও জে.কে রাউলিং কখনো নিজের অতীতকে ভুলে যান নি।প্রথম জীবনের দুর্দশা আর অর্থকষ্ট তাঁকে যে আজকের মানুষটি হিসেবে গড়ে তুলেছে, সেটার দাম তিনি প্রতি পয়সায় জীবনকে বুঝিয়ে দিতে চান।তাঁর চিন্তা চেতনায় কেবলই পৃথিবীর প্রতিটি কোণায় তাঁর মত কষ্টে জীবন পাড়ি দেয়া মানুষগুলোর জন্যই।ব্যাক্তিগত জীবনে অন্তর্মুখী এই নারী তাই নিজের চেষ্টা দিয়ে পৃথিবীকে জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া মানুষদের আবাসস্থল বানাতে চান।যারা হেরে গিয়েও আবার তাঁর মত দৃপ্ত পা-য়ে উঠে দাঁড়াবে।গল্পের যাদুর দুনিয়ার রাজকন্যা গল্পের মতই বাস্তব জীবনেরও তাই সত্যিকারের রাজকন্যা।পরিশ্রম আর অধ্যাবসায়ের যাদুতে নিজেকে বদলে দেয়া এক রাজকন্যা।শতাব্দী বছর পরও হয়তো কোন বাচ্চা পুরনো বই ঘাঁটতে গিয়ে খুঁজে পাবে আশ্চর্য এক রাজকন্যার অদ্ভুদ এক জাদুকরী জগত।