এম্ব্রয়ডারি : ৯০০ বছর পুরনো এক ঐতিহ্যবাহী শিল্প…

মানুষ চিরকালই সৌন্দর্যের পূজারী,নিজেকে এবং নিজের চারপাশের সব কিছুকেই সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলতে মানুষের চেষ্টার অন্ত নেই।এই প্রচেষ্টা থেকেই মানুষ পাথর কেটে ভাস্কর্য বানিয়েছে,লোহা গলিয়ে তৈরি করেছে মূর্তি,এমনকি সুঁই-সুতা দিয়ে কারুকাজও বাদ পড়েনি শিল্প থেকে।

প্রাচীনকাল থেকে সুঁই আর সুতার সম্মিলনে যে শিল্প তৈরি হয়েছে কাপড়ের উপর,তাই আজকের যুগে “এম্ব্রয়ডারি” নামে পরিচিত।এম্রয়ডারি,সুঁই-সুতা দিয়ে বানানো বস্ত্রখন্ড এমন এক অপূর্ব সৃষ্টি যা শুধু একজনের শিল্পী মনের পরিচায়ক নয় বরং আভিজাত্যরও প্রকাশক।

কত পুরোনো এই এমব্রয়ডারির ইতিহাসঃ

হাতে বানানো এমব্রয়ডারির ইতিহাস কিন্তু আজকের নয়,প্রায় ৩০০০০ খ্রিষ্টপূর্বে ক্রোগম্যান’দের বানানো কাপড়,জুতা এবং টুপিতে হাতে বোনা সূচি-কাজের নিদর্শন পাওয়া যায়।এমনকি সাইবেরিয়া এবং চীনের প্রাচীন স্থানগুলো থেকে প্রাপ্ত সূচিশিল্পের নমুনা পরীক্ষা করে জানা যায় যে এগুলো খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ বছর থেকে ৩৫০০ বছরের মধ্যবর্তী সময়কার।

blank

জাপানিজ এম্ব্রয়ডারি

এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যকে এই এম্রয়ডারী বা সূচিশিল্পের সূতিকাগার বলে মানা হয়,ব্যাবিলনীয় সভ্যতার সাথে সাথে ফোনেশিয়ানস এবং হিব্রুরা এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করে।সুদূর ইজিপ্টে এই এম্ব্রয়ডারির কাজ কতটুকু জনপ্রিয় ছিল তা মিসরের বিখ্যাত ফারাও তুতেনখামেনের সমাধিতে প্রাপ্ত প্রাচীন এম্রয়ডারির নমুনা দেখলেই বুঝা যায়।সে আমলে মিসরের মহিলারা রঙিন সুতো ছাড়াও ব্যাবহার করতেন অতিসূক্ষ্ম লোহার তৈরি সুতাও।মধ্যএশিয়ার বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকায়,পেরুভিয়ান মমি এবং ইজিপটের কপটিক পিসগুলোতেও আমরা এই সূচিশিল্পের নিদর্শন পাই যা খ্রিস্টের মৃত্যু পরবর্তী প্রথমশতকে্র সময়ও এম্রয়ডারীর অস্তিত্বকে প্রমাণ করে।

বিয়ক্সের বিখ্যাত ধর্মীয় টাপেস্ট্রি,এমব্রয়ডারির এক অনন্য নিদর্শনঃ

নরম্যান্ডির বিয়ক্সএ সংরক্ষিত ৭০ মিটার লম্বা টাপেস্ট্রি পৃথিবীর প্রাচীন এমব্রয়ডারি কালেকশনগুলোর মধ্যে অন্যতম।এটির তৈরিকাল ১০৬৬ খ্রিস্টাব্দ বলে মনে করা হয়,এই সুদীর্ঘ মাস্টারপিসটি বানাতে ১০০ জন শিল্পীর প্রায় কয়েকবছর সময় লেগেছিলো।এখানে হেস্টিংসের যুদ্ধের প্রায় পঞ্চাশটি চিত্র আঁকা আছে রঙ্গিন সুতোর বুনটে।

blank

ধর্মীয় বইয়ের কভার

ইউরোপে এমব্রয়ডারি শিল্প এমনিতেই যথেষ্ট বিস্তৃত ছিল,মধ্যযুগের নানা শিল্পের নিদর্শনের মধ্যে এমব্রয়ডারিরও নমুনা পাওয়া যায় ইটালি এবং ফ্রান্সে।এখানে সূচিশিল্পের প্রধান কদর হত চার্চগুলোতে,সেখানে কাপড়ের উপর ফলের বীজ এবং সুতা দিয়ে তারা শিল্পকর্ম করত।এইসব এম্রয়ডারী করা কাপড়গুলো ধর্মীয় জিনিস ঢাকার জন্য ব্যাবহার করা হত।পরবর্তীতে সুচ-সুতা দিয়ে শিল্পের পাশাপাশি ক্যানভাসের উপর সূচের কাজও জনপ্রিয় হয়।কিন্তু কালের পরিবরতনের সাথে আস্তে আস্তে মানুষের মাঝে সুচিশিলপের কদর কমতে থাকে।

সুচিশিলপের পুনরায় আবির্ভাব এবং আরো জমকালোভাবেঃ

১৬শ শতাব্দীতে আবার সুচিশিলপের পুনরজাগরণ হয়,তখন শুধু লিনেন বা সিল্কই নয় ভেলভেট এবং লেদারের উপরও এমব্রয়ডারির কাজ করা আরম্ভ হয়।সোনালী বা রুপালি সুতা দিয়ে ফুল,ফল,পাখি এবং পোকার ছবি ফুটিয়ে তোলা হত।তখন নানারকম ডিজাইন বুক পাওয়া যেত যেগুলো সাদা-কালো কিংবা রঙিন রঙে রাঙানো থাকত।

blank

এরপর ১৭শ শতাব্দীতে আসে লেইসের ডিজাইন এবং এম্ব্রয়ডারী করা জামার কলারে,মোজায় লেসের ব্যাবহার ফ্যাশন জগতে এক নতুন ছোঁয়া নিয়ে আসে।লেইসের জনপ্রিয়তা যে এখনো কমেনি তা আজকালকার মেয়েদের পোশাকের ফ্যাশন দেখলেই বোঝা যায়।

ফ্রান্স,শিল্প আর সৌন্দর্যের মাতৃভূমি বলে মানা হয় এই দেশকে।আর এমন দেশে এমব্রয়ডারির মত নিখুঁত শিল্পকে লুফে নেয়া হবে না তা কিকরে হয়?

ফ্রান্সে আঠারশ শতকে এমব্রয়ডারির প্রচন্ড কদর আরম্ভ হয়,এবং এটি এমব্রয়ডারিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়।এতদিন এমব্রয়ডারির ব্যাবহার শুধু কয়েকটি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকলেও ফ্রান্সে তা ছড়িয়ে যায় সর্বস্তরের মানুষদের মাঝে।এমব্রয়ডারির কাজে এখানে রঙিন সুতার ব্যাবহার ছাড়াও নানারকম মুল্যবান পাথরের ব্যাবহার কাপড়কে করে তোলে আরো দামী,আরো আকর্ষণীয়।

blank

তখন এমব্রয়ডারির কাজে “কুইল্টিং” নামে আরেকটি সূচিশিল্পের আবির্ভাব হয়।মা’রা নিজেদের কন্যাদের এই এমব্রয়ডারির কাজ শিখাতেন এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এই শিক্ষা চলে আসত।এইসময় প্রাচ্যের সাথে বাণিজ্য যোগাযোগ বৃদ্ধি হওয়ার সাথে সাথে এমব্রয়ডারির ডিজাইনেও যুক্ত হয় প্রাচ্যের ভাবধারা।এসব এমব্রয়ডারি কাজের প্রধান গ্রাহক ছিলেন চার্চ ছাড়াও ধনী ব্যাক্তিরা,এদের অনেকেরই নিজস্ব বেতনভুক্ত সুচিশিল্পি থাকত।

আধুনিক ফ্যাশনের সাথে তাল মিলিয়ে এমব্রয়ডারির পথচলাঃ

সময়ের পরিক্রমায় নানা ডিজাইনের আবির্ভাব হলেও এমব্রয়ডারির কদর কোনো অংশেই কমেনি,বরং সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এমব্রয়ডারির ডিজাইন হয়েছে আরো সুন্দর এবং নিখুঁত।

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে সাদা কাপড়ের উপর সাদা সুতা দিয়ে নকশা করে জামা ডিজাইন করার নতুন ফ্যাশন আসে,কিন্তু পরবর্তীতে তা আবার আগের ঝলমলে এবং রঙচঙে ফ্যাশনেই ফিরে যায়।ফ্যাশনে আরো যুক্ত হয় বার্লিনের উলের ডিজাইন এবং আরটিসান সূচের কাজ,যা ১৮৭০ সালের দিকে ক্রস-স্টিচ ডিজাইন আসার ফলে জনপ্রিয়তা হারায়।

blank

ইন্ডিয়ান এম্ব্রয়ডারি

ক্রস-স্টিচ এবং অন্যান্য আভিজাত্যপূর্ণ ডিজাইনের কারণে তরুণীদের কাছে এম্ব্রয়ডারীরর কাজ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এতই জনপ্রিয় হয় যে সর্বত্র ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠে এমব্রয়ডারির দোকান।সেখানে মহিলা কারিগরেরা নিজহাতে সূক্ষ্ম সব নকশা ফুটিয়ে তুলতেন।কিন্তু ১৮৮০ সালের মাঝামাঝি সময়ে এমব্রয়ডারি কাজের জন্য মেশিনের আবিষ্কার এই কষ্টকে কমিয়ে দেয় এবং এর উৎপাদন ও সূক্ষ্মতম কারুকাজও বৃদ্ধি পায়।তখন সুইজারল্যান্ড এম্রয়ডারীর ব্যাবসায় অগ্রগণ্য হয় এবং পরবর্তীতে আমেরিকাও এমব্রয়ডারির ব্যাবসায় মনোনিবেশ করে।এখনতো এই দুই দেশ ছাড়া অন্য দেশগুলোও এমব্রয়ডারি শিল্পে বিনিয়োগ করছে।দেশে দেশে এম্ব্রয়ডারির ধরণ বদলেছে কিন্তু সুতার গাঁথুনি সেই আগের মতই রয়ে গিয়েছে,আর আমাদের নকশিকাঁথাও কিন্তু এমব্রয়ডারিরই বিশেষ শাখা।

সারাবিশ্বে এখন এমব্রয়ডারির কদর,সে হাতের কাজেরই হোক কিংবা মেশিনের কাজই হোক।তবে উন্নত প্রযুক্তিকে ধন্যবাদ দিতেই হবে,যার সাহায্যে প্রাচীন আভিজাত্যপূর্ণ নকশাগুলোকে আরো সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা যাচ্ছে কাপড়ের বুকে।

সূত্রঃ ইন্টারনেট