এই লেখাটি পড়ার সময় না থাকলে, শুনতে পারেন এর অডিও ভার্সন। ক্লিক করুন নিচের প্লে-বাটনে।
আপনি কারো সাথে মিশতে পারেন না। অচেনা কাউকে দেখলেই আপনার লজ্জা লাগে। বাইরে যাওয়ার কথা শুনলে হার্টবিট বেড়ে যায়। মনে মনে ভাবেন, আমি কারো সাথে মিশতে পারবো তো? ভালোভাবে কথা বলতে পারবো তো? বাসায় মেহমান আসলে সামনে যেতে ইচ্ছা করে না। দরজা লাগিয়ে নিজের ঘরে ঘাপটি মেরে থাকেন আর অপেক্ষা করেন, মেহমান কখন যাবে? কখন??
প্রিয় পাঠক, এই সমস্যাগুলো নিয়ে আপনি যদি বিনিদ্র রজনী পার করতে থাকেন, তাহলে এই লেখা আপনার জন্যই। আপনার কি ইচ্ছা করে না, আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলতে? ইচ্ছা করে না, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যাক্তিত্ব হয়ে উঠতে? সব লাজ-লজ্জা, সংকোচ ঝেড়ে ফেলে নিজেকে নতুনভাবে প্রকাশ করতে? নতুন ভাবে চিনতে?
তাহলে একটু ধৈর্য ধরে লেখাটি পড়ার জন্য অনুরোধ করছিঃ
১। সিদ্ধান্ত নিন
কিসের সিদ্ধান্ত? সবার আগে নিশ্চয়ই এই চিন্তাই আপনার মাথায় আসছে। সিদ্ধান্ত নিন নিজের ব্যাপারে। এইভাবে মুখ লুকিয়েই আজীবন থাকবেন আর হা-হুতাশ করবেন? নাকি এবার বাঁধ ভাঙবেন? বদলে ফেলবেন নিজেকে? নিজের কাছে নিজেকে এই প্রশ্ন করাটাই হবে আপনার কর্ম-পরিকল্পনার প্রথম ধাপ। আগে মনের কথা শুনুন। তারপর কাজ শুরু করুন।
২। ভান করুন
আপনার সিদ্ধান্ত নেওয়া শেষ। আপনি চান নিজের খোলনলচে বদলে ফেলতে। নতুন এক আপনাকে আবিষ্কার করতে। বেশ ভালো কথা। এখন আপনি প্রথম যে কাজটি করবেন, সেটা হলো নিজের চালচলন বদলে ফেলুন। আপনি হয়তো কোন কাজ করতে ভয় পাচ্ছেন। কারো সাথে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। কিন্তু এমন এক ভাব ধরুন যাতে আপনাকে দেখলে মনে হবে, আপনি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। এটা করার কারণ হচ্ছে, আপনি শুরুতেই প্রকৃত আত্মবিশ্বাসী হতে পারবেন না। নিজের জন্মগত স্বভাব পরিবর্তন করা অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এর জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ সময় আপনাকে দিতেই হবে। তো সেই সময় দিবেন বলে তো আর আপনার প্রক্রিয়া থেমে থাকবে না। তাই আপনাকে অভিনয় করতে হবে। আত্মবিশ্বাসীর অভিনয়, সাহসীর অভিনয়। ধীরে ধীরে আপনি নিজেই খেয়াল করবেন, এই অভিনয়ই আপনার আচরণের সাথে মিশে যাচ্ছে একটু একটু করে।
৩। মেলা মেশা করুন
আপনি হয়তো নিজের প্রয়োজনে বিভিন্ন যায়গায় যান। অনেক মানুষ দেখেন। কিন্তু গুছিয়ে কথা বলতে পারেন না। ধরুন, আপনি বাসে করে কোথাও যাচ্ছেন। পাশের সিটে বসা লোকটির সাথেই কথা বলুন না! কথা শুরু করতে পারেন এভাবে, “ভাই, রাস্তায় কিরকম জ্যাম দেখছেন?” দেখবেন, তিনিও আপনার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করবেন। কিংবা টিসসিতে বড় পর্দায় খেলা দেখতে গেছেন। সাকিব আল হাসান ছক্কা মারলেন। পাশের কাউকে বললেন, “ দেখছেন ভাই, সাকিব আজ ফাটায়া ফেলবে।“ যাকে বলবেন, তিনিও দেখবেন আপনাকে বলছেন, “আবার জিগায়!” এরকম কিছু পরিবেশ নিজেই তৈরী করুন। একসাথে হাসুন। আশেপাশের মানুষের সাথে মুহূর্ত যাপন করুন। এতে করে যেটা হবে, আপনি অনুভব করতে শুরু করবেন যে আপনার কথাকেও গুরুত্ব দেওয়ার মতো কেউ আছে। ধীরে ধীরে নিজেই অনুভব করবেন, আপনি বদলে যাচ্ছেন।
৪। নতুন কিছু করুন
আপনি মোটেই সামাজিক না। আপনার বন্ধু-বান্ধব কম। ক্লাসে শুধু আপনি যান আর আসেন। কিন্তু আপনি এভাবে আর থাকতে চাচ্ছেন না। তাহলে এক কাজ করুন। স্কুল/কলেজ/ভার্সিটির বিজ্ঞান ক্লাবে যোগ দিন। অথবা স্পোর্টস ক্লাবে। কিংবা আরো যেকোন কিছুতে। ভাবছেন, কিভাবে সম্ভব! ঠিকমত কথাই বলতে পারেন না, মিশতেই পারেন না কারো সাথে। আবার ক্লাব! কিছু ভয় আছে, যেগুলো ভাঙাতে হয় নিজেকে নিজে ভয় দেখানোর মাধ্যমেই। আপনি কোন ক্লাবে যোগ দিলেন। প্রথম প্রথম আপনার অনেক সমস্যা হবে। হয়তো দেখা যাবে কোন কাজ ঠিকমত করতে পারছেন না। কিংবা সবার সাথে মিশতে পারছেন না। কিন্তু কিছুদিন পর আপনি নিজেই বুঝবেন, আপনি বদলে যাচ্ছেন। ভয়ের কাজগুলোই আপনার কাছে হয়ে উঠছে আনন্দের।
৫। সবার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলুন
আপনি সবার সামনে কথা বলতে ভয় পান। আর মঞ্চে ওঠা তো দূরের কথা। কিভাবে সম্ভব! একবার সাহস করে উঠেই যান না। মরে তো আর যাবেন না। তাহলে কিসের ভয়! উঠে যা ইচ্ছা বলুন। হয়তো প্রথম দিন কথা বলার ব্যপারটা জঘন্য খারাপ হবে। সবাই হাসাহাসি করবে। করুক না! আপনি সাহস করে মঞ্চে উঠেছেন। আর তাদের যে সে সাহসটাও হয়নি!
ধীরে ধীরে এই আপনিই দেখবেন, ভালো প্রেজেন্টেশন দিতে পারছেন। হয়ে উঠেছেন দক্ষ।
৬। ভালো শ্রোতা হোন
কারো সাথে আপনি কথা বলছেন, এমন অবস্থায় অন্যমনস্ক থাকবেন না। তিনি কি বলছেন, ভালো করে শুনুন। ভালো একজন শ্রোতা হোন আগে। কে কি বললো অথবা মনে রাখতে বললো, সেগুলো ভুলে যাবেন না। যখন আপনি অচেনা কারো নাম মনে রাখতে পারবেন অথবা এমন কিছু মনে রাখবেন যা আপনার কোন বন্ধু অথবা স্বল্প পরিচিত কেউ আপনাকে মনে রাখতে বলেছিল, আপনি দেখবেন তাদের কাছে আপনার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। তারা আপনাকে বিশ্বাস করতে শুরু করবে। আপনার উপর নির্ভর করতে শুরু করবে। কাজেই, ভালো একজন বক্তা হবার আগে ভালো শ্রোতা হোন। আপনার কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে।
৭। চর্চা করুন
আপনি এখন জানেন, আপনি আসলে কি করতে চান। কিভাবে করতে চান। কিন্তু যেকোন কিছুর মতোই এর জন্যও দরকার অনুশীলন, চর্চা। আপনি এক কাজ করুন। নিজের ঘরে একটা বড় আয়না লাগিয়ে নিন। আর যদি থাকে,তাহলে তো কথাই নেই। অবসর সময়ে দরজা বন্ধ করে এই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলুন। যা ইচ্ছা হয় বলুন। যেকোন বিষয় নিয়েই বলার অনুশীলন করুন। আপনি কোন স্টাইলে কথা বলতে চান, দাঁড়াতে চান অথবা হাঁটতে চান, আয়নার সামনে ঠিক সেই ভঙ্গিমার অনুশীলন করুন। এখানে আপনি নিজে আর উপরে আল্লাহ ছাড়া কেউ আপনাকে দেখছে না। কাজেই, আপনি সম্পূর্ণ স্বাধীন, চিন্তামুক্ত! আপনার লজ্জার কোন কারণই এখানে অবশিষ্ট নেই। এই কাজের সাথে আপনি আরেকটি কাজও করতে পারেন। সেটা হচ্ছে, এই চর্চাগুলোই আপনার কোন ঘনিষ্ঠ বন্ধু অথবা পরিবারের সদস্য, যিনি আপনার এইসব কর্মকাণ্ড দেখে হাসবে না বা উপহাস করবে না, তার সাথে করা। “মক” প্রেজেন্টেশন দিন। সেইসাথে নিজের মস্তিষ্ককেও কাজে লাগান যে কিভাবে এই অনুশীলনগুলো আপনি বাস্তব জীবনে নিয়ে আসবেন।
আপনি পারবেন। আমি বলছি।
লেখক সম্পর্কেঃ ইশফাক জামান। পেশায় প্রকৌশলী, নেশায় কবি ও লেখক। শখ কবিতা লেখা, ফিচার লেখা, অনুবাদ করা। বিভিন্ন অনলাইন (অফলাইন ও) ম্যাগাজিনে লেখালেখি করছি বেশ কয়েক বছর। পেশাগত জীবনে Linde Bangladesh Ltd. এ Territory Manager হিসেবে কর্মরত আছি।