চোখ ধাঁধানো স্বর্ণ, রুপা ও হীরা দ্বারা আভিজাত অলংকৃত পোশাক হল বিশ্বের ধনী ও উন্নত দেশগুলোর অন্যতম প্রধান বিলাসিতা এবং আভিজাত্য। যা স্বনামধন্য ব্যক্তির গায়ে জড়ানোকে বিশেষ সম্মানের মনে করা হয়। তাছাড়া মূল্যবান অলংকার, ধন, রত্ন এসবতো মানুষের প্রয়োজনেই এবং মানুষই তো সেগুলো গায়ে জড়াবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মাটির নীচে চাঁপা পড়া কঙ্কালের গায়ে জড়ানো বা কঙ্কালকে মূল্যবান অলংকারে মোড়ানো এটা সত্যিই আশ্চর্যের এবং বেমানান বিষয় ! আবার কিছুটা হাস্যকর বিষয়ও বটে। কিন্তু এর পেছনে হয়ত এমন কিছু করুন, সত্য ঘটনা বা কারণ আছে যা জানলে সম্মান করতে ইচ্ছে হবে এবং নিজের অজান্তেই চোখে জল চলে আসবে। এমনি অলংকৃত কঙ্কালের সন্ধান রয়েছে জার্মানির বাভারিয়া গির্জায় এবং গ্রিসের পেলোপোনিস উপদ্বীপে। Saint Hyacinth Of Caesarea Skeleton খ্রিষ্টধর্মের আদিগুরু সেন্ট হেইচিনথ অব সিজারিয়া ও সেন্ট ক্লেমেন্টস এর কঙ্কাল। যা সোনা, রুপা, ও হীরাসহ নানা মূল্যবান মণিমুক্তা দিয়ে মোড়ানো রয়েছে এখানে।
মাত্র ১২ বছর বয়সে ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন সেন্ট হেইচিনথ অব সিজারিয়া। কারাগারে অনাহারে রেখে হত্যা করা হয়েছিল তাঁকে। তবে তাঁর অনুসারিরা এখনও তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ রেখেছে। তাঁর অনুসারিরা খুব যত্নের সাথে কঙ্কালটি সোনা, রুপা ও হীরা দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছিলেন। জার্মানির বাভারিয়া গির্জায় এখনো রয়েছে কঙ্কাল। এই গির্জাটি জার্মানির মিউনিখের নিকটেই। হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন গির্জাটি দেখতে আসে।
অবশ্য কিছুদিন আগে অবদিও এ গির্জাটির তেমন কোন মূল্যায়ন ছিল না। প্রায় অবহেলিত অবস্থায় ছিল এটি। কারণ রোমান ধর্মকেন্দ্রীক বিভিন্ন রাজারা সবসময় এটিকে অবহেলা করে গেছেন। কিন্তু খ্রিষ্টধর্মের ইতিহাসে এই গির্জাটির মর্যাদা ধীরে ধীরে সমুন্নত হয়েছে। এই গির্জাটিতে সর্বমোট ২টি কঙ্কাল রাখা আছে। একটি সেন্ট হেইচিনথ অব সিজারিয়া এবং অন্যটি হল সেন্ট ক্লেমেন্টস এর কঙ্কাল। এই দুই ধর্মপ্রচারককে রোমানদের হাতে নির্মমভাবে নির্যাতিত হতে হয়েছিল। এই কারণেই এখনও তাদের অনুসারীরা কঙ্কাল গুলো খুব যত্নে মূল্যবান মণিমুক্তা, স্বর্ণ, রৌপ্য, হীরা দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছেন। সেন্ট হেইচিনথ ছিলেন প্রথম দিকের একজন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণকারী। ৯৬ সালে তিনি ধর্মগ্রহণ করেছিলেন। তখনকার সময় জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্সসহ ইউরোপের প্রায় বেশীরভাগ দেশেই প্রাচীন রোমান ধর্ম বেশী প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেন্ট হেইচিনথ যখন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করলেন তখন সেখানকার রোমানরা তা সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। এই কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে রোমানরা তাঁকে কারাদণ্ড দেয় এবং তাঁর খাওয়া দাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়। রোমানরা তাঁকে একটি শর্ত দেয় যে, যদি সে খ্রিষ্টাধর্ম ত্যাগ করে তাহলে তাঁকে মুক্ত করে দেওয়া হবে। কিন্তু তিনি তাদের শর্ত মেনে নেননি। কিন্তু রোমানরা তখন ভিন্ন কৌশল বা ষড়যন্ত্র করল যাতে সে খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করতে বাধ্য হয় ! রোমানরা খ্রিষ্টধর্ম নিষিদ্ধ কিছু প্রাণীর মাংস তাঁর সামনে রেখে দেয় যেন তিনি ক্ষুধার জ্বালায় সেই মাংস খেয়ে খ্রিষ্টধর্মের নিয়ম ভঙ্গ করেন ও খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করেন। কিন্তু তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন তবু তিনি নিয়ম ভঙ্গ করেননি। তিনি না খেয়ে ক্ষুধার জ্বালায় একসময় মৃত্যুবরণ করেন, কিন্তু সেই মাংস স্পর্শও করেননি। ১০৮ সালে তিনি মারা যান। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর।
সেন্ট ক্লেমেন্টস সম্পর্কে জানা যায়, ৯৮ সালে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার কারণে তাঁকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছিল। খ্রিস্টধর্মের এ কাণ্ডারিকে ১২০০ সালের মাঝামাঝি সময় ডক অব বাভারিয়া বা দ্বিতীয় লুইস এই গির্জায় সমাধিস্থ করা হয়। গির্জাটি জার্মানির মেউনিখ থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে। রোমান আমলে এটি আলাদা রাজ্য হিসেবে একজন ডক বা রাজা শাসন করতেন। ১৬০০ সালের দিকে সুইডিশরা গির্জাটি নিষিদ্ধ করেন। এরপর অনেকদিন গির্জাটির তেমন কোন মূল্যায়ন ছিল না। আবার ১৮০০ সালের দিকে এ গির্জা এবং কঙ্কাল আলোচনায় চলে আসে। তাঁর ভক্তরা কঙ্কালটি খুব যত্নে এবং আদরের সাথে সোনা, রুপা ও হীরাসহ নানা মূল্যবান মণিমুক্তা দিয়ে মোড়ানোর ব্যবস্থা করেন।
আরেকটি রহস্যজনক ধন রত্নে জড়ানো কঙ্কালের সন্ধান পাওয়া গেছে যা যিশু খ্রিষ্টের জন্মেরও প্রায় দেড় হাজার বছর আগে অর্থাৎ ৩ হাজার ৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে গ্রিসের পেলোপোনিস উপদ্বীপে। এক রহস্যময় যোদ্ধার সমাধি পাওয়া গেছে সেখানে। নেসটরের প্রাসাদে খনন কাজ চালানোর সময় কাঠের তৈরি এবং অক্ষত একটি সমাধির সন্ধান পান যুক্তরাষ্ট্রের সিনসিনাটি ইউনিভার্সিটির প্রত্নতাত্ত্বিক জ্যাক এল ডাভিস এবং শ্যারন আর স্টকার। সেই সমাধিতে একজন যোদ্ধার কঙ্কাল ও কঙ্কালে জড়ানো মূল্যবান ধনভান্ডার উদ্ধার করেছেন তাঁরা। গ্রিসের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে গত ৬৫ বছরে এমন মূল্যবান কোনো আবিষ্কার আর হয়নি তাদের দেশে। অ্যানসিয়েন্ট অরিজিনস নামে একটি অনলাইনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
পেলোপোনিস উপদ্বীপের এপানো অ্যাংলিয়ানোস পর্বতের চূড়ায় নেসটরের প্রাসাদ অবস্থিত। সাড়ে ৩ হাজার বছরের প্রাচীন দুই তলার এই প্রাসাদে শয়ন কক্ষ, স্নানঘর, অতিথিশালাসহ সব ধরণের সুবিধাই ছিল। নেসটরের প্রাসাদে যে সমাধি পাওয়া গেছে, তা দৈর্ঘ্যে ২.৪ মিটার এবং প্রস্থে ১.৫ মিটার। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, প্রাসাদ তৈরির বেশ আগে প্রভাবশালী কোনো বীর যোদ্ধাকে সেখানে সমাহিত করা হয়। তাঁর মরদেহের সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হয় ধনভান্ডার, যার মধ্যে রয়েছে ব্রোঞ্জের তরবারি, যেটির হাতল সোনা ও হাতির শূড় দিয়ে তৈরি। সোনা দিয়ে তাতানো ছুরি এবং ধাতব ঢাল পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন ধাতুর তৈরি অলঙ্কার, যুদ্ধাস্ত্র পাওয়া গেছে এই সমাধিতে।
আসলে কে ছিলেন এই যোদ্ধা যার সম্পর্কে সঠিক কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেননি প্রত্নতাত্ত্বিকরা। তবে তাঁরা বলেছেন, আনুমানিক ৩০ থেকে ৩৫ বছর বয়সী এই যোদ্ধা সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কেউ একজন ছিলেন। কিন্তু অজ্ঞাত এই বীর যোদ্ধাকে ঘিরে রয়ে গেছে ঐতিহাসিক রহস্য। যার পরিচয় বা যার অতীত ইতিহাস সম্পর্কে হয়ত জানতে পারবো অদূর ভবিষ্যতে নয়ত অজানাই রয়ে যাবে…।
তথ্যসুত্র: অনলাইন