শত শত বছর ধরে বিজ্ঞান উৎসাহী ও কল্পবিজ্ঞান প্রিয় পাঠকেরা বিভিন্ন জ্ঞানীগুণীর বইয়ে অদৃশ্য হবার কলাকৌশল ও বিভিন্ন চমকরপ্রদ কাহিনী সম্পর্কে ধারণা পেয়ে এসেছেন। কোন একটি জলজ্যান্ত মানুষের হুট করে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি গুণাবলী বটে। তবে মুখের কথায় স্রেফ ছুঁ মন্তর ছুঁ বললেই আপনি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারবেন না। এর জন্য প্রয়োজন হয় বিশেষ ধরণের ডিভাইস, বা হয়ত মন্ত্রপূত একটি কাপড়ের টুকরো। এইচ. জি. ওয়েলসের “দ্যা ইনভিজিবল ম্যান” এর কথাই ধরুন না, গল্পের নায়ক এখানে যেই বিশেষ পদ্ধতিতে অদৃশ্য হবার ক্ষমতা হস্তগত করেছিলেন তাকে সংক্ষেপে বলা যায়, “রিফ্রেকটিভ ইনডেক্স” বা “প্রতিসারক সূচক”। মূলত এইচ. জি. ওয়েলসের এই মৌলিক পদ্ধতিগত আইডিয়াকে কেন্দ্র করেই আজকের দিনে অদৃশ্য হবার প্রযুক্তি উদ্ভাবন সম্ভব।
সাধারণ ভাবে আমরা জানি কোন বস্তুর উপর আলো আপতিত হলে সেই বস্তুটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে নেয়। প্রকৃতিতে উপস্থিত ভিন্ন ভিন্ন রঙ এর আলোর জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্য। সকল রঙ এর আলোই বস্তু সমূহ শোষণ করে নেয় না বরং কিছু পরিমাণ বিচ্ছুরিত হয়। যেমন গাছের পাতা, প্রায় সব রঙ এর আলো শোষণ করে নেয় কেবল সবুজ রঙ ছাড়া। সবুজ রঙ এর পুরোটাই গাছের পাতা বিচ্ছুরণ করে বলে আমাদের চোখে কেবল সবুজ ই ধরা দেয়। কোন বস্তুকে চোখে অদৃশ্য হতে হলে তাই সর্বপ্রথম শর্ত হচ্ছে বস্তুটিকে সকল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য এড়িয়ে যেতে হবে অর্থাৎ আলো বস্তুটিকে স্পর্শ না করেই এর ধার ঘেঁষে চলে যাবে, যা কিনা নিতান্তপক্ষে অসম্ভব।
এই অসম্ভবতা কে সম্ভব করার প্রয়াসেই বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করে চলেছেন। যুক্তরাজ্যের একদল বিজ্ঞানী বস্তুর পারমাণবিক পর্যায়ে এই সমস্যা সমাধান করবার চেষ্টা করেছেন। এই পদ্ধতিতে লেজার বীমের সাহায্যে বস্তুর ক্ষুদ্রতম কণা ইলেকট্রনকে এর নিজস্ব অবস্থানে জমিয়ে দেয়া হয়। কারণ আলোর সংস্পর্শে ইলেকট্রন শক্তি সঞ্চয় করে তার নিজস্ব কক্ষপথ থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে উপরের দিকে উঠে যায়, পরে অবশ্য আগের জায়গাতে ফিরে এসে স্থিতিশীলতা অর্জন করে। পুনরায় নিজ অবস্থানে ফিরে আসার সময় ইলেকট্রন নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের শক্তি নির্গমন করে যা আমাদের চোখে এসে বর্ণালী স্বরুপ হয়ে ধরা দেয়। তো কারিগরি টা হচ্ছে ইলেকট্রনকে শক্তি শোষণ করতেই বাঁধা দেয়া। তবেঁ এ পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা আছে, এভাবে করে কেবল মাত্র একক সময়ে একটি মাত্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোতে বাঁধা দান করা সম্ভব। যেমন ধরুন, বিভিন্ন রঙ এর বেলুন আপনি একসাথে একজায়গায় জমা করে রাখলেন। লেজার বীমে এমন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে রশ্মি প্রয়োগ করা হল যা হলুদ রঙ এর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সমান। তাহলে বেলুন গুলোর দিকে তাক করে লেজার প্রয়োগ করলে কেবল হলুদ বেলুন গুলো অদৃশ্য হয়ে যাবে, বাকিগুলো রইবে দৃশ্যমান। তাহলে কী হ্যারি পটারের বিখ্যাত ইনভিজিবিলিটি ক্লোক বাস্তবে হাতে পাওয়ার কোন উপায় ই নেই?
জে কে রাওলিং এর মস্তিষ্ক প্রসূত ক্লোক এর ভাবনার রুপদান দিতে গিয়েই কিনা, তবেঁ আবিষ্কৃত হয়েছে মেটা ম্যাটেরিয়াল। এক বিশেষ ধরণের প্লাস্টিক সদৃশ বস্ত যাকে ফ্যাব্রিক এ রুপদান করা গেলে প্রকৃত পক্ষেই আপনি হতে পারবেন অদৃশ্য। মেটাম্যাটেরিয়াল তরঙ্গদৈর্ঘ্য কে এমনভাবে বাঁকিয়ে দেয় যাতে তা একে স্পর্শ না করেই এর ধার ঘেঁষে চলে যায়। ফলে কোন বস্তুর উপর তরঙ্গদৈর্ঘ্য আপতিত হচ্ছে না মানেই আপনার আমার চোখে সে অদৃশ্য হয়েই ধরা দিবে। যদিও এখনো পর্যন্ত মেটাম্যাটেরিয়াল কেবল মাইক্রোওয়েভ এর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বাঁকিয়ে দেয়ার সামর্থ্য অর্জন করেছে, তবেঁ আর কয়েক বছরের মধ্যে যে কোন প্রকার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যেই এটি কাজ করতে সম্ভাব্যতা অর্জন করবে, এই উদ্দেশ্যে এটিকে বিশেষায়িত করা হচ্ছে। তবেঁ হ্যাঁ, মেটাম্যাটেরিয়াল দিয়ে তৈরী পোষাকেও আপনাকে কমপক্ষে তিনটি প্রাথমিক স্তর বজায় রাখতে হবে। প্রকৃতির তিনটি মৌলিক রঙ লাল, নীল, ও হলুদ এ তিনটি রঙ কাপড়ে প্রাথমিকভাবে স্পর্শ না করলেই আপনি অদৃশ্য হবার গুণাবলী লাভ করতে পারবেন।
এবং হতে পারে আপনার বাচ্চাকাচ্চা বা নাতী নাতনী দের যুগে জন্মদিনের উপহার হিসেবে তাদের গিফট করলেন দ্যা ক্লোক অফ ইনভিজিবিলিটি। কল্পকাহিনী এখন তো আর স্রেফ বই এর পাতায় সীমাবদ্ধ নেই, আমরা সেই কল্প যুগেই বাস করছি।
ছবিঃ ১ঃ http://www.awaken.com/2013/12/making-waves-in-the-hunt-for-invisibility-other-benefits-seen/
২ঃ https://www.zmescience.com/science/physics/invisibility-cloak-04232/
৩ঃ http://metro.co.uk/2016/07/29/a-real-life-harry-potter-invisibility-cloak-could-soon-be-here-6037684/