বাড়িতে আসার সাথে সাথেই কেমন যেনো পাগলের মতো হয়ে গেলো মা। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন একদম। তারপর বাচ্চাদের মতো আদর করতে করতে বললেন, ” তুই ঠিক আছিস খোকা? বেঁচে আছিস এখনও? কোথাও গুলি লাগেনি তো? আর এমন শুকিয়ে গেলি কেন? খাবার খাস না ঠিক মতো? ”
মায়ের কথাবার্তা শুনে একেবারে হেসে উঠলাম আমি। ফিসফিস করে বললাম – ” আমি ঠিক আছি মা। ”
পাশের রুম থেকে নোটন আর রুনু দৌড়ে এলো।পুরানো চশমাটা চোখে দিতে দিতে ঘুম ঘুম চোখে বের হয়ে এলো বড়পু। আমাকে দেখে মিষ্টি করে হাসলো বড়পু। নোটন আর রুনু দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো আমাকে।
মূহুর্তের মধ্যেই কেমন যেনো একটা উৎসব উৎসব ভাব চলে এলো ঘরের ভেতর। মা ব্যাস্ত হয়ে গেলেন চুলায় ভাত চড়ানোর জন্য।রুনু থালাবাটি নাড়াচাড়া করা শুরু করে দিলো।আর বড়পুকে দেখলাম চুলায় মাংস নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। নোটেনকে দেখলাম পাশের ঘর থেকে বাক্সমতো কি যেনো একটা নিয়ে দৌড়ে এলো আমার কাছে।
কাচের বাক্সভর্তি একগাদা সন্দেশ! দেখেই কেমন যেনো জ্বিভে পানি চলে এলো আমার। লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকালাম সন্দেশ গুলোর দিকে।সেদিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো নোটন। আহ্লাদী গলায় বললো – ” লও ভাই তোমার সন্দেশ।আম্মা তোমার জন্য জমিয়ে রেখেছিলো। এবার মজা করে খাও। আর আমাকে দিবা একটা? ”
নোটনের বলার ভঙ্গি দেখে হাসি পেয়ে গেলো আমার। হাসতে হাসতে দু’টো সন্দেশ বাড়িয়ে দিলাম ওর দিকে। তারপর কামড় বসালাম একটা সন্দেশের উপর, এবং ঠিক তখনি ঘটে গেলো দূর্ঘটনাটা। টের পেলাম তীব্র গতিতে কে যেনো কড়া নাড়ছে দরজায়।কড়া নাড়ার ধরন দেখে মনে হলো যেনো ভেঙ্গে ফেলতে চাইছে তারা দরজাটা।
মূহুর্তের মধ্যেই যেনো স্তব্ধ হয়ে গেলো চারপাশ।মায়ের দিকে তাকালাম।দরদর করে ঘামছে মা। ফ্যাকাশে আর রক্তহীন হয়ে গেছে তার মুখ সেদিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলাম।ভরসা দেয়ার জন্য বললাম – ” চিন্তা করো না মা।কিছু হবে না। “কাঁপা কাঁপা হাতে দরজাটা খুলে দিলো নোটন।তড়িৎ গতিতে ঘরের ভেতর এসে ঢুকলো কিছু মানুষ।তাদের সবার হাতে রাইফেল। হিংস্র রাজাকার ওরা।
কিছু বুঝে উঠার আগেই টের পেলাম মোটাসোটা রাজাকারটা হাতের রাইফেলটা দিয়ে মাথায় মেরে বসেছে আমার। কপাল ফেটে রক্ত বের হয়ে এলো।অন্ধকার হয়ে এলো চারপাশ।কানে এলো কয়েকটা কন্ঠের কান্না আর চিৎকারের শব্দ।টের পেলাম বিলাপ করে কাঁদছে মা। পাশে যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে নোটন।চোখ ফেটে বের হয়ে আসছে অজস্র অশ্রুকনা। ব্যথায় লাল হয়ে গেছে তার সমস্ত মুখ। শ্বাস নিতে ভীষন কষ্ট হচ্ছে নোটনের।
মোটাসোটা ঐ রাজাকারটা তার ভারী পা দিয়ে চেপে ধরে আছে নোটনের গলা। এতটুকুন বাচ্চা কি সইতে পারে এসব?
কানে এলো রুনু আর বড় আপার চিৎকার।চুলের মুঠি ধরে টানছে ওদের রাজাকারগুলো।টেনে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে পাশের ঘরে। তাদের চোখে মুখে তীব্র লালসার দৃষ্টি। জঘন্য জানোয়ারগুলোর দিকে তাকিয়ে কেমন যেনো ঘৃনায় চিড়বিড় করে উঠলো শরীরের ভেতরটা। হুঙ্কার ছেড়ে বললাম – ” ওদের ছেড়ে দে।”
একমূহুর্তের জন্য কেমন যেনো থমকে গেলো সবকিছু। স্তব্ধ হয়ে গেলো সবাই। রাজাকারগুলো ধীরে ধীরে ঘুরে তাকালো আমার দিকে। অদ্ভূত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কিছুক্ষন।
মোটা বিচ্ছিরি রাজাকারটা এগিয়ে এলো আমার দিকে। হায়েনার মতো খিক খিক করে হেসে উঠলো পশুটা। খনখনে গলায় বলল – ” ছেড়ে দিবো এদের? ”
তারপর জবাবের অপেক্ষা না করেই অদ্ভূত একটা কথা বলে উঠলো সে। যা শুনে চমকে উঠলাম আমি ভীষনভাবে। বিচ্ছিরি রাজাকারটা তার হলদেটে দাঁতগুলো বের করে বলল – ” তোমাদের ছেড়ে দিতে পারি আমি এক শর্তে। ”
মনের ভেতর হঠাৎ করেই ছোট্ট একটা আশার আলো জ্বলে উঠলো। মাথার ভেতর খেলে গেলো কতগুলো কথা।
হয়তো সত্যিই ওরা ছেড়ে দিবে আমাদের!
হয়তো যুদ্ধে ফিরে যাবো আমি!
মা, রুনু, বড়পু,নোটন আবার খাবার নিয়ে বসে থাকবে আমার অপেক্ষায়!
তারপর একদিন দেশ স্বাধীন করে আমি ফিরে আসবো সবার মাঝে।
স্বাধীন দেশের মাটিতে সুখে শান্তিতে বাস করবো আমরা!
এমনটা হলে সত্যিই ভালো হবে অনেক!!
একবুক আশা নিয়ে কথা বলে উঠলাম আমি – ” কি শর্ত? ”
মুচকি হাসলো রাজাকারটা। তারপর আমার দিকে একটু ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বলে উঠলো – ” রাজাকার বাহিনীতে যোগ দাও।মুক্তিযোদ্ধাদের খবর এনে দাও,ধরিয়ে দাও ওদের। তাহলে ছেড়ে দিবো সবাইকে। ”
পশুটার কথা শুনে রাগে ভনভন করে উঠলো মাথার ভেতরটা।শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে ছুঁড়ে ফেললাম কয়েক দলা থুথু ওর মুখের ওপর।
টের পেলাম অপমানে টাকটকে লাল হয়ে গেছে জানোয়ারটার মুখ। রাগে রীতিমতো কাঁপছে পশুটা।
এবং….তারপরেই ঘটে গেলো অঘটনটা। মূহুর্তের মধ্যেই একটা ধ্বংস যজ্ঞ ঘটে গেলো ঘরের ভেতর। বিকট শব্দে গর্জে উঠলো রাইফেল। কেঁপে উঠলো সমস্ত ঘরবাড়ি।
হতভম্ব আমি দেখলাম রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। ওরা মেরে ফেলেছে নোটনকে। মারা গেছে রুনু আর বড়পু। চুল ধরে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মাকে চুলার কাছে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে চায় ওরা আমার মায়ের মুখ!!
আর সহ্য করতে পারলাম না আমি। ঘরের কোনে রাখা মাছ কাটার বটিটা তুলে নিলাম নিজের হাতে। তারপর তা বসিয়ে দিলাম বিচ্ছিরি রাজাকারটার গলায়। ব্যাথায় ছটফট করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো পশুটা।ক্ষিপ্র গতিতে আর একটা আঘাত করার জন্য তৈরী হলাম আমি।
কিন্তু তা আর করা হলো না। তার আগেই ওদের বুলেটের আঘাতে ফুঁটো হয়ে গেলো আমার বুক।
মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গেলাম আমি। ঝাপসা চোখে দেখলাম আহত রাজাকারটাকে নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে ওরা ঘর থেকে। আর পেছনে ফেলে যাচ্ছে আমার আপনজনের লাশ।
মায়ের দিকে তাকালাম।যন্ত্রনায় ছটফট করছে আমার মা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার সাদা শাড়ি। হামাগুড়ি দিয়ে চলে গেলাম মায়ের কাছে। চোখ ফেঁটে বের হয়ে এলো কয়েক ফোঁটা অশ্রু। বুলেট বিদ্ধ বুকের ফুঁটোটা চেপে ধরে বললাম – ” মা আমাকে মাফ করে দাও। আমি বাঁচাতে পারলাম না তোমাদের। ”
মৃদু একটি হাসি দিলেন মা। তারপর কাতর কন্ঠে বললেন – ” খোকা, একটু পানি দিবি? ”
কেমন যেনো দিশেহারা হয়ে গেলাম আমি। অসহায় আমি দেখলাম একফোঁটাও পানি নেই ঘরের ভেতর। পানি ভর্তি মাটির কলসিটা ভেঙ্গে দিয়েছে ওরা। সমস্ত ঘরময় ভাঙ্গা জিনিসের ছড়াছড়ি।
কেমন যেনো দুঃখ হতে লাগলো মায়ের জন্য।আমার বেচারি মা কি তাহলে পানি না খেয়ে মারা যাবে??? হতাশ ভঙ্গিতে তাকালাম মায়ের দিকে।
ঠিক তখনি টের পেলাম দূরে কোথাও বাজ পড়লো তীব্র শব্দে। তারপরই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো। দ্রুতগতিতে মায়ের কাছে ফিরে গেলাম আমি। টেনে টেনে নিয়ে গেলাম মায়ের অর্ধমৃত দেহটাকে বাইরের দিকে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম – ” আমার মাকে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় মরতে দিয়ো না খোদা।”
খোদা আমার কথা রাখলেন। মুগ্ধ আমি দেখলাম বৃষ্টির পানি দিয়ে প্রান ভরে তার তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন আমার মৃত্যু পথযাত্রী মা।
( সমাপ্ত)
ছবিঃ http://www.artsricksha.com/readings/reading.asp?ID=54