সারাদিনের কর্ম ব্যস্ত দিন কাটানোর পর মাঝে মাঝেই ইচ্ছা করে পরিবার পরিজন বা বন্ধু বান্ধব নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার । বা কখনও কখনও ইচ্ছা করে সব কোলাহল থেকে দূরে গিয়ে একান্ত নির্জনে নিজের মত করে কিছু সময় কাটাতে । এজন্য কারও কারও পরিকল্পনা থাকে ঢাকার বাইরে বেড়াতে যাওয়ার আর কারও কারও পরিকল্পনা থাকে ঢাকার ভেতরেই কোথাও ঘুরতে যাওয়ার । কিন্তু অনেকেই দ্বিধান্বিত থাকেন কোথায় ঘুরতে যাবেন বা কিভাবে যাবেন । যারা ঢাকাতেই ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা করছেন এবং ভাবছেন কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়, তাদের পরিকল্পনাকে আরেকটু সহজ করার জন্য আজ আপনাদের ঢাকার কিছু স্থানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব । সময় করে ঘুরে আসতে পারেন জায়গাগুলোতে । আশাকরি নিরাশ হবেন না ঘুরে এসে ।
১। জিন্দাপার্ক (ইকোপার্ক )
ইট , কাঠ ,বালি সুরকির এই শহরে যারা একটু সবুজের ছোঁয়া পেতে চান ,হারিয়ে যেতে চান প্রকৃতির নির্জনতায়,নিজেকে খুঁজে পেতে চান অদ্ভুত সুন্দর স্বপ্নিল সবুজের মায়ায় তারা ঘুরে আসতে পারেন জিন্দা পার্ক থেকে । এটি একটি ইকো পার্ক এবং পার্কটি ১৫০ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত । যেখানে রয়েছে লেক, গাছবাড়ি, আধুনিক পর্যবেক্ষণ টাওয়ার,লাইব্রেরী , পরিবেশবান্ধব সাঁকো, ২৫০ প্রজাতির দুর্লভ সব গাছ এবং ফুলের সমারোহ । পুরো পার্কে রয়েছে বসার জন্য নান্দনিক সব বেঞ্চ ।
রয়েছে গ্রাম্য মাটির রাস্তা এবং দুপাশে গাছের সারি । পুরো পার্ক জুড়ে রয়েছে শুধু সবুজ আর সবুজ । পায়ের নিচের সবুজ ঘাস আর শীতল মাটির ছোঁয়া আপনার মনে এনে দেবে এক অদ্ভুত প্রশান্তি । এখানে বোটে করে লেকে ঘোরার ব্যবস্থাও রয়েছে । সর্বপরি যারা ঢাকা শহরের এই যান্ত্রিকতা থেকে বের হয়ে একটু সবুজের মাঝে সময় কাটাতে চান এবং প্রকৃতির সান্নিধ্য লাভ করতে চান তারা এই অদ্ভুত সুন্দর জায়গাটি ঘুরে আসতে পারেন।
পার্কটি নারায়ণগঞ্জ এর রূপগঞ্জ থানার পুর্বাচল উপশহরে অবস্থিত ৷ প্রবেশ মূল্য ১০০ টাকা (জনপ্রতি) । ভেতরে প্যাডেল বোট ঘন্টায় ৮০ টাকা ।
কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে জিন্দা পার্কের দূরত্ব ৩৭ কিঃ মিঃ । ঢাকা থেকে বাসযোগে কাঁচপুর ব্রীজ হয়ে ভূলতা গাওছিয়া হয়ে বাইপাস দিয়ে কাঞ্চন ব্রীজ হয়ে জিন্দা পার্কে আসা যায় । কাঞ্চন ব্রীজ থেকে ৫ মিনিটের হাটার পথ ৷ অথবা ঢাকা হতে টঙ্গী মিরের বাজার হয়ে বাইপাস রাস্তা দিয়ে জিন্দা পার্ক আসা যায়, টঙ্গী হতে জিন্দা পার্কের দূরত্ব ২৮ কিঃ মিঃ । সহজ হবে কুড়িল বিশ্বরোড এর পুর্বাচল হাইওয়ে দিয়ে গেলে ৷ লেগুনাতে জিন্দা পার্ক যেতে ৩০ টাকা নিবে ৷
২। সাদুল্লাপুর (গোলাপ গ্রাম )
গোলাপ ফুল পছন্দ করেন না এমন মানুষ হয়ত খুব কমই আছে । ফুলের দোকানে লাল,হলুদ,সাদা,গোলাপি সহ নানা রঙের গোলাপ দেখে আনন্দে আত্মহারা হন না এমন ফুল বিদ্বেষী মানুষ হয়ত খুঁজে পাওয়া মুশকিল । এখন তো ফুল আমাদের নিত্য দিনের উৎসবের সাথী । জন্মদিন,বিয়ে, গাঁয়ে হলুদ সব কিছুতেই ফুল এখন অপরিহার্য । তো এই যে এত এত ফুল আমরা দোকানে দেখি এই ফুলগুলো আসে কোথা থেকে ? যদি এমন হয় ফুল নয় পুরো ফুলের বাগানটাই দেখতে পাচ্ছেন চোখের সামনে ,হাজার হাজার ফুল আর সবুজের মাঝে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন ভীষণ মুগ্ধতা নিয়ে । উপরে বিশাল নীল আকাশ, আঁকাবাঁকা গ্রামের মেঠো পথ আর একটু একটু পর বিশাল বিশাল সব গোলাপের বাগান । কি ভাবতেই স্বপ্নময় লাগছে তাই না ? এরকম দৃশ্য উপভোগ করতে চাইলে আপনাকে যেতে হবে ঢাকার সাভারের সাদুল্লাহপুরে । এটি গোলাপ গ্রাম নামেও পরিচিত । এখান থেকেই ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ফুল যায় । শুধু ফুল নয় এখানে গেলে গ্রামীণ জীবনেরও ছোঁয়া পাবেন । যারা শহরের যান্ত্রিক কোলাহল ছেড়ে একটু সবুজের ছোঁয়া চান,পেতে চান গ্রামের ছোঁয়া, ঘুরে আসতে পারেন এই গ্রাম থেকে।
কিভাবে যাবেন
মিরপুর ১ নাম্বার মাজার রোড দিয়াবাড়ি ঘাট থেকে সাহদুল্লাহপুর ঘাটের উদ্দেশ্যে ৩০ মিনিট পরপর ইঞ্জিনচালিত বোট ছাড়ে । সাদুল্লাহপুর যেতে যেতে ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা লাগবে ।সেখানে একেক জনের জন্য ২০ টাকা থেকে ৩০ টাকা করে ভাড়া নিবে । অথবা নিজেরা হাতে চালানো বোট নিতে পারেন, যেতে দেড় ঘন্টার মতো লাগবে । এক্ষেত্রে ভাঁড়া একেকরকম হতে পারে । তবে নিজে নৌকা চালিয়ে গেলে পথ চিনতে ভুল হতে পারে সেক্ষেত্রে ইঞ্জিনচালিত বোট নেয়াই অধিক ঝুঁকিমুক্ত । ওখানে ঘাট থেকে নেমে হাতের ডান পাশ ধরে হেঁটে যেতে পারেন ১০ থেকে ১৫ মিনিট লাগবে গোলাপ বাগানের দেখা পেতে । আর যদি হাঁটতে না চান বা পথ খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় তবে রিকশাও নিতে পারেন । রিকশাওয়ালাকে বললেই হবে যে গোলাপ বাগান যাবেন । এক্ষেত্রে রিকশা ভাঁড়া ১০ থেকে ১৫ টাকা নেবে । গ্রামের ভেতরে দোকান নাও পেতে পারেন সেক্ষেত্রে সাথে পানি এবং হালকা স্নাক্স সাথে রাখতে পারেন ।
৩। আফতাবনগর
ঢাকার ভেতরে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার জন্য যারা খোলামেলা জায়গা খুঁজে বেড়ান, খুঁজে বেড়ান একটু নিরবতা তারা ঘুরে আসতে পারেন আফতাবনগরে। এখানে রয়েছে বিশাল খোলা প্রান্তর, রয়েছে দুপাশে গাছের সারি ঘেরা প্রশস্ত রাস্তা । নাম না জানা পাখির কলতান আর নিজেকে সময় দেয়ার জন্য নিরবতা । রয়েছে সুদীর্ঘ রাস্তা,যেখানে চাইলে রিকশা ভ্রমণও করতে পারেন । এর শেষ প্রান্তে রয়েছে বিশাল নদী । রয়েছে বালুচর । নদীর পাড়ে বসে চলে যেতে পারেন কোন স্বপ্নের রাজ্যে । এখান থেকে দেখতে পারেন অপূর্ব সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত । ঘুরে আসতে পারেন একা একা বা প্রিয়জনকে নিয়ে । আফতাবনগর বেশী আকর্ষণীয় হয় শরৎকালে । চারিদিক কাশ ফুলে ফুলে সাদা হয়ে যায় । চারিদিক শুভ্র সাদার মায়ায় মায়াময় হয়ে যায় । তবে এখানকার পরিবেশ সন্ধ্যায় বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে তাই সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকার ইচ্ছা থাকলে দল নিয়ে যাওয়াই অধিক নিরাপদ এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে যাওয়া নিরাপদ ।
কিভাবে যাবেন
যারা রামপুরার অধিবাসী নন তারা , যেখান থেকেই যেতে চান তাদের রামপুরা এর বাসে উঠতে হবে । তারপর রামপুরা ব্রীজ এ নেমে আরেকটু সামনে গেলেই অর্থাৎ রামপুরা ব্রীজ থেকে হাতের উত্তর দিকে অগ্রসর হলে জহুরুল ইসলাম সিটি লেখা বিশাল একটা গেট চোখে পড়বে । সেই গেটের ভেতর দিয়ে সোজা গেলেই আফতাবনগরে পৌঁছে যাওয়া যাবে।আর যারা রামপুরার অধিবাসী তারাও এভাবেই যেতে পারেন উপরন্তু রামপুরার ভেতরে বনশ্রী যাওয়ার পথে অনেকগুলো ব্রীজ আছে যেগুলো পার হয়ে তারা আফতাবনগরে প্রবেশ করতে পারেন । এখান থেকে চাইলে হেঁটেও যেতে পারেন আর চাইলে রিকশাও নিতে পারেন । রিকশা নেয়াই অধিক উপকারী কারন গেট থেকে ভেতরে হেঁটে যেতে অনেক সময় লেগে যাবে । ওখান থেকে রিকশা ভাঁড়া নেবে ৪০/৫০ টাকা । কেউ চাইলে ঘণ্টা হিসেবেও রিকশা করে এখানে ঘুরতে পারেন । সেক্ষেত্রে রিকশা ভাঁড়া ৬০ থেকে ৮০ টাকা ঘণ্টা হতে পারে । একদম ভেতরে খাবারের কোন ব্যবস্থা নেই সেক্ষেত্রে পানি এবং হালকা স্নাক্স সাথে রাখতে পারেন ।
৪। মিরপুর বেড়ীবাঁধ
যারা রিকশা করে ঘুরতে পছন্দ করেন বা নৌকা ভ্রমণ করতে চান বা একই সাথে অনেকগুলো জায়গা ঘুরে আসতে চান তারা যেতে পারেন মিরপুর-১ নাম্বার বেড়ীবাঁধে । এই জায়গাটি বিশেষ করে রিকশা করে ঘোরার জন্য অধিক উপযোগী । ঘণ্টা হিসেবে ঘুরতে পারেন রিকশা করে,হারিয়ে যেতে পারেন ট্রাফিক জ্যাম মুক্ত হাইওয়েতে । এখানে গেলে দেখতে পাবেন দুপাশে গাছের সারি, দিগন্ত বিস্তৃত খোলা প্রান্তর, দূরে সবুজ গ্রাম আর রুপালী পানির নদী । আর রিকশা করে ঘুরতে না চাইলে ঘন্টা হিসেবে নৌকা করেও ঘুরতে পারেন । আর নৌকা করেও ঘুরতে না চাইলে এখানে রয়েছে বিভিন্ন ভাসমান রেস্তোরা এবং বিনোদন পার্ক । সেখানেও সময় কাটাতে পারেন । এখানে রয়েছে অনেক পুরাতন কিছু বটগাছ । এখানে অনেক নাটকেরও স্যুটিংও হয়ে থাকে । এখানে বিকেলের পর একা একা থাকাটা ঝুঁকিপূর্ণ তাই সন্ধ্যা হওয়ার আগেই এখান থেকে ফিরলে তা নিরাপদ ।
কিভাবে যাবেন
এখানে যেতে হলে প্রথমেই যেতে হবে মিরপুর-১ নাম্বার । সেখান থেকে রিকশা করে যেতে হবে মিরপুর বেড়ীবাঁধ বটতলা । সেক্ষেত্রে ভাঁড়া নেবে ৩০ থেকে ৫০ টাকা । যদি ঘন্টা হিসেবে রিকশা করে ঘোরার ইচ্ছা থাকে তবে এখান থেকেই রিকশা চুক্তি করে নেয়া ভাল । কারন পরে রিকশা পাওয়া কষ্টকর হবে ।রিকশা ঘন্টা হিসেবে নিবে ১০০ টাকা ঘন্টা ।
জেনে রাখা ভালো
ঘন্টা হিসেবে রিকশা ভাঁড়া করে সোজা রাস্তা ধরে চলে যেতে পারেন অনেক দূর । সাথে পানি এবং হালকা খাবার নিয়ে নিতে পারেন কারন পথে খাবার নাও পেতে পারেন । ভ্রমন আরও উপভোগ্য করার জন্য সাথে নিয়ে নিতে পারেন পছন্দের গানের সংগ্রহ । রিকশা করে ঘুরতে ঘুরতে শুনতে পারেন পছন্দের গান আর কিছুক্ষনের জন্য নিজেকে আবিস্কার করতে পারেন কোন এক স্বপ্নময় রাজ্যে যেখানে কোন চিন্তা নেই, নেই কোন দুঃখ, নেই কোন হতাশা । নিজেকে নিজে সময় দেয়ার জন্য এর চেয়ে ভাল পন্থা আর কি হতে পারে ?
সবার ভ্রমণ আনন্দময় এবং উপভোগ্য হোক ।
লেখিকাঃ শারমীন আক্তার সেতু। আমি পেশায় একজন মনোবিজ্ঞানী । কবিতা লিখতে এবং পড়তে পছন্দ করি । মনোবৈজ্ঞানিক ফিচার লেখার সাথে যুক্ত আছি। তাছাড়াও অন্যান্য বিষয়েও লিখতে এবং জানতে পছন্দ করি । আমি এর আগে পরামর্শ .কম এ লেখার সাথে যুক্ত ছিলাম । এখন কিছু ইংরেজি সাইটে অনুবাদের কাজ করছি । আমার শখ ভ্রমণ এবং গান গাওয়া । বাগান করতে পছন্দ করি এবং বিভিন্ন গাছ,ফুল্,ফল এবং নতুন নতুন জায়গার সাথে পরিচিত হতে ভাল লাগে।