বন্ধু নিলয় ঢাকায় এসেছে, কিন্তু আমার সাথে দেখাই হচ্ছে না। সময়, সুযোগ মিলছে না কোনোটাই। তাই ঠিক করলাম, কাছাকাছি কোথাও ঘুরে আসব দুই বন্ধুতে মিলে। খুঁজে পেতে বের করলাম, মুড়াপাড়া রাজবাড়ি। ঠিক হলো, খুব ভোরে বেরিয়ে পড়ব। কারণ ফিরে এসে আমাকে আবার স্কুল ধরতে হবে।
আমি তো সাইনবোর্ড আছিই, নিলয়ের আসতে আসতে সাড়ে সাতটা বেজে গেল। মেঘলা’র টিকিট কাটলাম ২৫ টাকা করে। রূপগঞ্জ উপজেলায় রূপসী বাজার পর্যন্ত। মাত্র কদিন আগেই জিন্দাপার্ক ঘুরে গেছি এই রোডে। তাই সহজ হলো।
ভোর বেলায় বলে আধাঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম। ওখানকার একটা হোটেলে নাস্তা করে অটোয় চেপে বসলাম মুড়াপাড়া যাওয়ার জন্য। ২০ টাকা পার পারসন।
মুড়াপাড়া জমিদার বাড়িটির বয়স একশ বছরের বেশি। বিভিন্ন সময়ে জমিদার বাড়িটি কয়েকজন জমিদার কর্তৃক সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা হয়েছিল। এটি মুড়াপাড়া নামক গ্রামে অবস্থিত। স্থানীয়রা একে মঠেরঘাট জমিদার বাড়ি বলেও ডাকে। তবে বর্তমানে এটি মুড়াপাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ নামে পরিচিত। অটোওয়ালাকে জিজ্ঞেস করতেই বললো, ‘হ্যাঁ, কলেজই তো ওটা।’
কলেজ পর্যন্ত যাবার আগেই একটা মঠ দেখলাম রাস্তার পাশে। এটার জন্যই হয়তো মঠেরঘাট ডাকে। আরেকটু এগোতেই চোখে পড়লো ওটা। রাস্তার পাশের মাঠ পেরিয়ে স্বদর্পে দাঁড়িয়ে আছে। অটোওয়ালা আমাদের নামিয়ে দিলো আরো একটু সামনে।
একটা রাস্তা চলে গেছে কলেজ পর্যন্ত। ওটুকু হেঁটে সামনে যেতেই প্রথমে চোখে পড়লো বেশ বড় সড় একটা শহীদ মিনার। তার পাশেই জমিদারবাড়ি। সামনে এগিয়ে মাথা উঁচিয়ে দেখছি ওটা। একশ বছর আগে রড সিমেন্ট ছাড়া বানানো স্থাপত্য আভিজাত্য নিয়ে এখনো স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে- ভাবতেও অবাক লাগে।
জমিদার বাড়ির সামনে অবস্থিত শহীদ মিনার
বাড়িটি দৈর্ঘ্যেও বিশাল। ৬২ বিঘা জমির ওপর অবস্থিত। জমিদার বাড়িটির ইতিহাসও বেশ সমৃদ্ধ। এটি তৈরি করেন বাবু রামরতন ব্যানার্জী যিনি এ অঞ্চলে মুড়াপাড়া জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এরপর তার কয়েকজন বংশধর প্রাসাদটি সংস্কার ও সম্প্রসারণ করেছিলেন। ১৮৮৯ সালে জমিদার প্রতাপচন্দ্র ব্যানার্জী এই ভবনের পিছনের অংশ সম্প্রসারণ করেন ও পরিবার নিয়ে এখানেই বসবাস শুরু করেন।
তার পুত্র বিজয় চন্দ্র ব্যানার্জী ১৮৯৯ সালে প্রাসাদের সামনের অংশে একটি ভবন নির্মাণ ও ২টি পুকুর খনন করেন। ১৯০৯ সালে তার দুই পুত্র জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জী ও আশুতোষ চন্দ্র ব্যানার্জী প্রাসাদের দোতালার কাজ সম্পন্ন করেন।
১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর জগদীশ চন্দ্র তার পরিবার নিয়ে কলকাতা গমন করেন। এরপর থেকে বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। ১৯৪৮ এ তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাড়িটি দখল নেয় এবং এখানে হাসপাতাল ও কিশোরী সংশোধন কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৬৬ তে এখানে স্কুল ও কলেজের কার্যক্রম পরিচালনা করা হত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বাড়িটির দায়িত্ব গ্রহণ করে, সেটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
এখন জরাজীর্ণ মনে হলেও একসময় বেশ জৌলসপূর্ণ ছিল এই জমিদার বাড়ি
দ্বিতল এ জমিদার বাড়িটিতে ৯৫টি কক্ষ আছে। ২টি পুকুর থাকার কথা। কিন্তু আমরা একটি পুকুর দেখেছি। বাড়ির সামনে যে বৃহদাকার পুকুরটি থাকার কথা, সেটি সম্ভবত ভরাট করে মাঠ বানানো হয়েছে। পিছনের দিকে ছোট পুকুরটি আমরা দেখেছি।
জমিদার বাড়ির পেছনের অংশের পুকুরখানা
এছাড়াও পুরো জমিদার বাড়িটিতে রয়েছে বেশকিছু নাচঘর, আস্তাবল, মন্দির, ভাণ্ডার ও কাচারি ঘর। এখন আর ওগুলো আলাদা করার উপায় নেই। সবগুলো ঘর কলেজের ক্লাসরুম এবং অফিসিয়াল কাজে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া বেশিরভাগ ঘরই তালাবদ্ধ। মূল বাড়ির দোতালায় যাওয়ার সিঁড়ি খুঁজে পেলেও যেতে পারিনি। প্রথম ল্যান্ডিংয়ে সিঁড়িঘরের দরজা বন্ধ।
সিঁড়িঘরের বন্ধ দরজার সামনে থেকে হতাশ নয়নে ফিরে আসতে হয় আমাদের
মন্দিরের ওপরের চূড়াটি প্রায় ৩০ ফুট উঁচু। মূল প্রাসাদে প্রবেশের পথে রয়েছে বেশ বড় একটি ফটক। লোহার ওই ফটক দিয়েই ভিতরে ঢুকে দেখেছি আমরা। ভিতরে মূলবাড়ির সংলগ্ন অন্য একটা বাড়ির সংস্কারের কাজ চলছে।
সিঁড়িঘরের পাশেই একটা খোলা জানালা। উঁকি দিয়ে দেখি, ওপাশে সার বাঁধা দুই তিনটে বাড়ি। কেমন হন্টেড দেখাচ্ছে। কিন্তু যাওয়ার উপায় নেই। কারণ ওখানে যাবার একমাত্র দরজাটি বন্ধ।
একটি আম বাগানও আছে জমিদার বাড়ির পাশে। দু’টি পুরনো মঠ রয়েছে প্রধান সড়কের পাশে। মানে থাকার কথা ছিল দুটি। আমরা একটি দেখেছি।
ছাদে উঠতে ইচ্ছে করছিলো খুব। কিন্তু সব বন্ধ। কোথাও যাওয়ার উপায় নাই। তাই বাড়িটি থেকে বেরিয়ে পুরোটা ঘুরে পিছন দিকে গেলাম, কোনোভাবে ঢোকা যায় কি না, তা দেখতে। এক পাঁক ঘুরতেই দেখি, আশায় গুড়েবালি। পুরোটা বাউন্ডারি করা। আর ঝোঁপ জঙ্গলে একদম ছেয়ে আছে। তবুও পিছনটায় গেলাম। পুকুরের ধার ঘেষে মেঠো পথটায় হাঁটতে। বাউন্ডারির পাশ ঘেঁষে হাঁটছি, একটু এগিয়ে দেখি একটা লোহার গেইট। তাও খোলা! এক্সাইটমেন্টে চেঁচিয়েই উঠতাম মনে হয়! পায়ে পায়ে ভিতরে ঢুকে দেখি সুনসান নীরব। দিনের বেলাতেও আলো আঁধারিয়ায় ডুবে আছে। কেমন অদ্ভুত গা ছমছমে অনুভূতি হলো। এটা কি জানালা দিয়ে দেখা সেই হন্টেড জায়গাটা?
জানালা দিয়ে দেখা আমাদের সেই হন্টেড (!) জায়গা
ভালো করে তাকিয়ে দেখি, তা নয়। জমিদারবাড়ির অন্য কোনো অংশে চলে এসেছি। এখানটায় অনেকগুলো ঘর। ডানপাশের ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন ঘরগুলোয় মানুষজন থাকে। কিন্তু বাম পাশেরটা ছোট ঘর না। বেশ বড় বাড়ি। মনে হয় যেখানে দাঁড়িয়ে সিঁড়িঘর খুঁজেছি, সেই বাড়িটার পিছনের দিক। বেশিরভাগ দরজায় তালা দেওয়া। কেবল একটার দরজা ফাঁকা। ওতে ঢুকতে কেমন যেন ভয় ভয় লাগে। নিলয় চটপট করে ঢুকে গিয়ে খোলা জানালা দিয়ে উঁকি দিলো। তারপর ভিতরের দিকে ঢুকলো। আমার কেমন যেন লাগছিল ভিতরে যেতে। আমি বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলাম।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখি নিলয়ের সাড়াশব্দ নাই। দরজা দিয়ে উঁকি দিতেই আমার মনে হলো কালিগোলা অন্ধজারে পড়েছি। মোবাইল বের করে লাইট জ্বালিয়ে ওর নাম ধরে ডাকছি। উপরের কোথাও থেকে শব্দ এলো, আয়। দেখলাম, সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে ধাপে ধাপে। সিঁড়ি বাইছি, আর উপর থেকে আলো আসছে একটু একটু করে। ছয় স্টেপে ৩০ ধাপ খাড়া সিঁড়ি পেরিয়ে উপরে উঠতেই ঝকঝকে উজ্জ্বল আলোয় এসে পড়লাম। এখানটাতেই নিলয় দাঁড়িয়ে আছে। আমরা একটা ছাদে উঠে পড়েছি। ইচ্ছে হলো, খুশিতে একটা চিৎকার মারি!
এখান থেকে যতোটা সম্ভব দেখে নিলাম। বাড়িটার ছবি তুললাম। সংস্কারাধীন বাড়িটার ছাদের সাথে এই ছাদ যুক্ত। সেই ছাদে কাজ করছে রাজমিস্ত্রিরা। তাদের একজন এসে চলে যেতে বললো। আমরাও তর্ক না করে নেমে গেলাম।
ফেরার সময় পিছন ঘুরে দেখলাম, বাড়িটার একটা জানালা মাটির একদম কাছে। ওটা কি তবে মাটির নিচের ঘর? ছাদ থেকে নামার পর সিঁড়িঘরে তিনটা রুম দেখেছি তালা বদ্ধ। নিলয় বলল, ওগুলোর একটা হয়তো পাতালঘর!
পাতাল ঘরের তালা নেড়েচেড়ে দেখছে নিলয়, যদি কোনভাবে ঢোকা যায় আরকি!
ওখান থেকে বেরিয়ে আমবাগান ঘুরে দুটো মন্দিরমতো স্থাপনা পেলাম। ওগুলো ঘুরে মঠ পর্যন্ত হেঁটে গেলাম। মঠটা সংস্কার করার সময় গোলাপি রঙ করা হয়েছে বলে বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে। পোড়ামাটির কালার হলেই ভালো দেখাত।
মন্দিরের গায়ে পাথর খোদাই করে আঁকা হিন্দু মিথের দেবীরা
আমাদের দেখাও শেষ, সময়ও প্রায় শেষ। জমিদারবাড়িটি খুব আহামরিটাইপ কিছু মনে না হলেও, আমার ভালো লেগেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ করায় হয়তো অবহেলায় অনাদরে নষ্ট হচ্ছে না। কিন্তু অন্য আরেকটা ব্যাপার ভালো লাগেনি আমার কাছে। সেটা হলো, যেহেতু সরকারী কলেজ, তাই এতে ছাত্র রাজনীতি ওৎপ্রোত ভাবে জড়িত। শতবর্ষী এই স্থাপনাটিতে তাই “ওমুক ভাইকে ভোট দিন” টাইপ দেয়াল লিখন, পোস্টার দিয়ে ভর্তি করে রেখেছে। প্রাচীনত্বের মায়া নষ্ট করতে এছাড়া আর কী লাগে?
প্রাচীনত্বের মায়া নষ্ট করতে এছাড়া আর কী লাগে?
আসুন আমরা যারা ঘুরতে পছন্দ করি, সবাই শপথ করি, বেড়াতে গিয়ে পরিবেশ নোংরা না করে, পরিচ্ছন্ন রাখি। অপচনশীল বস্তু ডাস্টবিনে ফেলি, নয়তো সাথে করে নিয়ে আসি। বেড়াতে গিয়ে নিজেদের নাম গাছ কিংবা পাথরে লিখে আসার মতো গাধামি না করি।
আমরা চাইলেই তো আমাদের দেশটাকে সুন্দর রাখতে পারি।
ছবি কৃতজ্ঞতায় – ফরহাদ আহমদ নিলয়