অ্যালকেমি ও অমরত্ব সুধার খোঁজে

                                                 আইজ্যাক নিউটন এর অ্যালকেমি এর খাতার একটি পাতা

আমাদের অতীত এর হাজারো কুহেলিকার মাঝে একটি কুহেলিকা হল এই অ্যালকেমি , এটি পিরামিড এর মতই প্রাচীন , স্টোনহেঞ্জ এর মতই রহস্যময় , আর পৃথিবী এর অন্যতম রহস্যে ঘেরা এক মতবাদ এর একটি, যার নাম অ্যালকেমি বা অধিরসায়ন ।

এদেরকে এক কথাতে সোনা বানাতে চাওয়া একজাত এর পাগল হিসেবে চিহ্নিত করা হয় , কিন্ত আসলেই কি এরা তাই ছিলেন ? যুগের সর্বশেষ মহান অ্যালকেমিস্ট এর নাম শুনলে পারে যদিও এটা কখনই মনে হবে না , তার নাম ছিল আইজ্যাক নিউটন , যিনি তার জীবন এর মাত্র ১০ বছর কাটিয়েছেন ফিজিক্স এর উপর গবেষণা করে , কিন্ত উনি কাটিয়েছেন ৪০ বছর অ্যালকেমির সাধনা করে ।

তাহলে দেখা যাক কোথায় থেকে আসল এই অ্যালকেমি ,

অ্যালকেমি এর জন্ম ধরা হয় মিশরে , যদিও এই ব্যাপারে মিশরীয় কোন  নাম সরাসরি শোনা যায় না কিন্ত পরবর্তী কালের গ্রীক দার্শনিক দের লেখনি তে জানা যায় Hermes Trismegistus নামের এক মিশরীয় রাজা এর নাম , ধারণা করা হয় এই কিংবদন্তি রাজা এর হাতে ১৯০০ খৃস্টপূর্বাব্দে অ্যালকেমি এর আবিস্কার সঙ্ঘটিত হয় । এই প্রসঙ্গে বলতে হয় আরবি শব্দ আল কিমিয়াত থেকে এসেছে মডার্ন কেমিস্ট্রি শব্দটি ,আবার এই কেমিস্ট্রি এসেছে খেম শব্দ থেকে যে খেম এর অর্থ কালো মাটি মিশর এর কালো মাটি ।

তবে মিশর এর পরে ভারত এবং চীন এ স্বতন্ত্র ভাবে অ্যালকেমি এর জন্ম হয়ে থাকে ।

অ্যালকেমি এর প্রধান দুইটি শাখা এর মধ্যে একটি ছিল ক্রাইসোপয়েইয়া বা সাধারণ ধাতু কে মুল্যবান ধাতু তে রুপান্তর করার প্রক্রিয়া , এবং দ্বিতীয়ত অমৃত বা এলিক্সার অফ ইমমরটালিটি এর খোঁজ করা । এছাড়াও আরও একটি কাজ ছিল আর সেটি ছিল এমন একটি ওষুধ আবিস্কার করা , যা যে কোন রোগ বালাই কে সারাতে পারবে ।

আসলেই এই বিজ্ঞান এক রুপকথার বিজ্ঞান ।

কেননা এরই মাঝে পরশ পাথর , বা ফিলোসফারস স্টোন তৈরি করার বিষয়টিও সামনে আসে । পরশ  পাথর তৈরি করতে গিয়ে কি কি দরকার পড়বে সেটাও এই অ্যালকেমি এর বিভিন্ন গ্রিমর এ বলা আছে ।

তবে এই অ্যালকেমি এর বিদ্যা কে প্রাচীন গ্রীস এর মানুষেরা বেশ সিরিয়াস ভাবেই নিয়েছিল, আর সেটার মাধ্যমেই তাদের মাঝে গড়ে ওঠে বহু ধরণ এর পরীক্ষা , নিরীক্ষা এবং জ্ঞান এর শাখা ।

গ্রীক রা মনে করতেন এই পৃথিবী চারটি এলিমেন্ট বা পদার্থ দ্বারা তৈরি , আর সেগুলো হছে আগুন , মাটি ,পানি আর বায়ু , এদের সাথে এই পুরনো মিশর এর জ্ঞান মিশ্রিত করে দিলে পারেই তৈরি হয় কেহমিয়া , যা ছিল মিশর এর আদি নাম গ্রীক দলিল দস্তাবেজে ।

অ্যালকেমি এর গুরু দের মাঝে ছিলেন , ইব্রাহীম , মারিয়া আর ডেমোক্রিটাস এদের সর্বদা একটি বৈশিষ্ট্য ছিল ইথার বা পঞ্চম মৌলিক পদার্থ বা তত্ত্বকে খুঁজে বের করা ।

blank
অ্যালকেমির অমরত্বকে খোঁজার অন্তহীন প্রচেষ্টা

অ্যালকেমি এর সবথেকে বড় চ্যালঞ্জটি ছিল অমরত্ব এর সন্ধান , অ্যালকেমিস্ট দের মাঝে যারা মহান গুরু ছিলেন তাদের মধ্যে এই বস্তটি , আসলে একটি রুপক হিসেবে কাজ করলেও নিকোলাস ফ্ল্যামেল সহ আরও বেশ কিছু দার্শনিক ছিলেন যাদের কাছে এই কাজটি অনেক অনেক বেশী জরুরি ছিল ।

তারা একে সত্যি বলে বিশ্বাস করতেন ।

এই বিষয়ে সবথেকে বড় বইটির নাম হচ্ছে ম্যাগনাম অপাস , এই বইতেই এই অমরত্ব এর বিষয়ে সবথেকে বেশী লেখা রয়েছে ।

এই বইতেই আছে , যে বিভিন্ন জাদু আর আচার অনুষ্ঠান এর মাধ্যমে আমরা লাভ করতে পারি সেই অ্যালকেমি এর এলিক্সারকে যা একবার পান করলে পারেই যে কেউ অমর হয়ে যাবেন , যুগে যুগে বহু বহু অ্যালকেমিস্ট এই বিষয়ে কথা বলেছিলেন

নির্দিষ্ট বিশেষ পদ্ধতিতে বিভিন্ন পাথরকে মিশ্রিত করার জন্য , একজন ব্যক্তি এলিক্সার অফ লাইফকে প্রাপ্ত করতে সক্ষম হবেন , এই সমস্ত ক্ষেত্রে পান করার মাত্রই একজন ব্যক্তি অমরত্ব লাভকরবেন , বহু মুসলিম , ইউরোপিয়ান এবং চাইনিজ অ্যালকেমিস্ট রা নিজেদের এই আবিস্কার এর স্বত্ব দাবি করেছেন , বিশেষ করে চায়নাতে বহু বহু সম্রাট একে পান করতে চেয়েছেন , কিন্ত যখন এটা তাদের কাছে আনা হয়েছে এবং তারা পান করেছেন তারা সাথে সাথে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েছেন , অমরত্ব তাদের জন্য মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই বয়ে আনতে পারেনি , যেখানে তারা অনন্ত কাল ধরে রাজত্ব করতে চেয়েছেন ।

blank
নবী সোলায়মান(আ) ও শেবার রাণী বিলকিস এর কাল্পনিক চিত্র

 

অ্যালকেমি এর ক্ষেত্রে নবী সোলায়মান ও অনেক বড় একজন নাম । রাব্বানিক  সাহিত্যের মতে, সলোমন তার নম্রতার ফলে  পশু ও আত্নাদের কে  হুকুম করার অধিকার লাভ করেছিলেন, তিনি বস্তুগত সম্পদের পরিবর্তে শুধুমাত্র জ্ঞানের জন্য প্রার্থনা করতেন । সুতরাং, তার রাজত্বের উত্তরত্তোর উন্নতি হয় এবং রাজত্ব উন্নত হবার সাথে সাথে  জীনেরা তার নিকট  রত্নপাথর এবং বহুমূল্য জাঁকজমক পূর্ণ সম্পদ আনতেন  যা তার সম্পদ এবং গরিমা উভয়েই বৃদ্ধি করে । জাদু বই ছাড়াও, সলোমন  “সলোমন সীল” হিসাবে পরিচিত একটি জাদুর আংটি এর মালিক  ছিল এবং এটি  তাকে জীনদের উপর ক্ষমতা দিয়েছিল  এই আংটি সাহায্যে, রাজা নিজে আসমোডিউস স্বয়ং বা , জীনদের বাদশাহকে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তাকে তাঁর ইচ্ছা পালন করতে বাধ্য করেছিলেন। আংটি “অন্দলিবের আংটি নামেও ” নামেও পরিচিত তিনি মারা যাবার পর যুগে যুগে যারা এটিকে অর্জন করার চেষ্টা করছেন  তাদের সংখ্যা কম ছিল না। কিংবদন্তি অনুসারে, সলোমন মন্দির নির্মিত হয়েছিল জীন  এবং ফেরেশতাদের দ্বারা পাথর দিয়ে খোদাই করে । শামির নামের একজাতের জান্নাত এর পোকার মাধ্যমে যারা কিনা পাথরে কারুকাজ করতে পারে । সলোমন দুইজন  দানবকে  তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী শৃঙ্খলিত করেন ,তাদের নাম ছিল  উজজা ও আজাজেল এবং তাদেরকে সেসব গোপন রহস্য প্রকাশ করতে বাধ্য করেছিলেন যা সাধারণ কেউ জানেন না । “শিক্ষাগত” উদ্দেশ্যে, সলোমনকে হিরাম সহ একাধিক বন্ধুকে নিয়ে একদিন এর জন্য দোজখ পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন সেটিও এই সব কাহিনীর মাঝে উল্লেখ করা আছে ।

এইভাবে, একজন মানুষ স্পষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন যে, ইতিহাস জুড়ে বিজ্ঞান, জাদুর সাথে মিশ্রিত হয়েছে,যুক্তিনির্ভর  গবেষণা জাদু এর  সাথে একাকার হয়ে গেছে  , রাষ্ট্রীয় রাজনীতি জাদুমন্ত্র এর সাথে হাতে হাত রেখে চলেছে , যার ফলে রাজাকে সাহায্য করতে পারে যেন স্পিরিট আত্মারা । যদিও এখনও সলোমন নবী এর উদ্দেশ্য অনুযায়ী পরশ পাথর এবং অমৃত আবিস্কার হয়নি , তার কিংবদন্কাতী তুল্জয বই  “Clavicula Salomonis” মহাকালের ধোয়াশাঁ   মধ্যে হারিয়ে গেছে, যদিও অ্যালাইকামিক কৌশল ভুলে গেছি আমরা , কিন্ত এই জ্ঞান তাদের সাথে নিয়ে এসেছে নতুন নতুন আবিষ্কার যা এখনও আজকের এই  দিন পর্যন্ত সুবিধা প্রদান করে।

এই কারণেই অ্যালকেমি আজও বেঁচে আছে আমাদের মাঝে , বিভিন্ন রকম এর রিচুয়াল এর মাধ্যমে মিথ , লেজেন্ড এবং ফোকলোর এর মাধ্যমে এমনকি আজও কেমিস্ট্রি এর প্রায় এক চতুর্থাংশ মেশিন বা পরিমাপ ও পরীক্ষা এর বিষয়বস্ত আবিষ্কৃত হয়েছিল অ্যালকেমিস্ট দের হাতে , এই কারণে এটি অপবিজ্ঞান হয়েও বিজ্ঞান এর মাঝে স্থান করে নিয়েছে , নিউটন এর মত বিজ্ঞানীও একে নিয়ে রাতের পর রাত পার করে দিয়েছেন ।

জয়তু অ্যালকেমি ।