ভালোবেসে নাম দিয়েছিলাম তার অতন্দ্রিলা। তার ঘন কালো মেঘের মতো কোঁকড়া চুল, স্ফটিকের মত স্বচ্ছ বাদামী আধবোজা চোখ, নাকে-ঠোঁটে লেগে থাকা কোকেনের গুড়ো, সবকিছুতেই কেমন যেন এক স্বপ্নালু ভাব ছিলো। আমার অতন্দ্রিলা খুব হাসতো, কিন্তু তার চোখ কখনো হাসেনি, হাসিতে কাঁপেনি তার পুরো শরীর। অতন্দ্রিলার কোন কিছুর অভাব ছিলো না। বিএমডব্লিউ গাড়ি, দু-চারটে ক্রেডিট কার্ড, ক্যাম্পাস ভর্তি বন্ধুবান্ধব, সবই ছিলো। ছিলোনা শুধু খোঁজ নেবার মানুষ। “খেয়েছো?” কিংবা “বাড়ি ফিরছো কখন?” এই সাধারণ খবরটুকু নেয়ার মত সময় ছিলোনা তার সোশ্যালাইট মা অথবা ইন্ড্রাস্টিয়ালিস্ট বাবার কাছে।
আমি মধ্যবিত্ত ছা-পোষা ঘরের ছেলে। তবুও অতন্দ্রিলা আমায় চেনে, কথা বলে। ক্লাসে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা অতন্দ্রিলার যেসব নোটস দরকার, আমি ছাড়া আর কারই বা আছে! ওর বন্ধুরাই মনে হয় ঠেলে পাঠায় ওকে আমার কাছে। অতন্দ্রিলার সম্মোহনে সম্মোহিত হবে না, এমন কেউ কি আছে? নোটস নেয়া শেষ হয়ে গেলেই আমার সাথে কাজ শেষ তার। আবার পরের সেমিস্টার, পরের সাবজেক্ট। তবে ভাগ্যের ফের মানতেই হবে, প্রতিবার একই ক্লাসে থাকি আমি আর অতন্দ্রিলা।
এক ফেব্রুয়ারি মাসে দেখলাম অতন্দ্রিলার বেহাল অবস্থা। গাল ভেঙ্গে গেছে, চোখের নিচে কালি, চুলগুলোতে চিরুনি পরেনি বহুদিন! কানাকানিতে শুনতে পেলাম, অতন্দ্রিলার বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে। তারা কেউই রাখতে চাচ্ছেনা অতন্দ্রিলাকে নিজের কাছে। আলাদা ফ্ল্যাট কিনে দেওয়া হয়েছে তাকে, সেখানেই আছে।
দিনদিন অবস্থা খারাপ হতে শুরু করলো অতন্দ্রিলার। চেহারায় কালো কালো দাগ, ঠোঁটগুলো শুকনো, চুলগুলো কেমন নিষ্প্রাণ লালচে! ক্যাম্পাসের বন্ধুরা আর তার পাশে নেই। অতন্দ্রিলার বেস্টফ্রেন্ড রাইসার বয়ফ্রেন্ড আবিরের সাথে নাকি অতন্দ্রিলার আ্যফেয়ার চলছিলো। যদিও আবির কিংবা অতন্দ্রিলা কেউই স্বীকার করেনি। পুরো সার্কেল আবিরকে মেনে নিলেও বয়কট করে দিয়েছিলো অতন্দ্রিলাকে। আবিরের একটা আলাদা টান ছিলো অতন্দ্রিলার উপর তা সবাই জানতো। এবার তা শেষ হলো। আগে যারা অতন্দ্রিলার টাকায় ড্রাগস নিতো, তারাও ছেড়ে গেলো একসময়।
কে যেন অতন্দ্রিলার আ্যপার্টমেন্টের দেয়ালে স্প্রেপেইন্ট দিয়ে বিশ্রী সব কথা লিখে এসেছে তার নামে। এর কিছুদিন পরই ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেলো ওর একান্ত গোপন কিছু ছবি আর তার প্রাক্তনের সাথে ঘটে যাওয়া কথোপকথনের স্ক্রিনশট। অতন্দ্রিলার দিকে তাকানো যাচ্ছে না একেবারে। মাথার চুল পড়ে টাক হয়ে যাচ্ছে, অপুষ্টিতে ভুগছে ও। কেউ ডাকলে সাড়া পর্যন্ত দিচ্ছেনা এমন নেশাগ্রস্ত হয়ে থাকে সারাদিন। সব ফ্যাকাল্টি বলছে ওকে সেমিস্টার ড্রপ দিয়ে দিতে। দিতেই হবে ওকে৷ গত ১৫ দিনে এই একবার ক্লাসে এলো ও। ঐ তো, কফির মগ সামনে নিয়ে বসে আছে আমার অতন্দ্রিলা। তাকিয়ে আছে শুন্য চোখে। আমি আর সইতে পারলাম না। উঠে গেলাম তার কাছে, বসলাম তার সামনে।
অতন্দ্রিলা আজ আমার, শুধু আমার। কোন এক বিকেলে সে চোখ তুলে তাকিয়েছিলো আমার দিকে। দেখতে পেয়েছিলো, এক সমুদ্র ভালোবাসা নিয়ে বসে আছি তার জন্য। আর আমাদের পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আজ অতন্দ্রিলা আমার বিবাহিতা স্ত্রী, আজ মাঝরাতে ঘুম থেকে পাশ ফিরে চোখ মেললেই দেখা মেলে আমার অতন্দ্রিলার। ঘুমিয়ে আছে অতন্দ্রিলা, আমার এত কাছে, আমার অতন্দ্রিলা। যখন দূরে ছিলো তখনও আমারই ছিলো, আর কারো নয়।
যখন ক্লাসের শেষ বেঞ্চে বসে ঢুলুঢুলু চোখে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকতো, তখনও আমার ছিলো।
ও তখনও আমার ছিলো, যখন আমি ওর সাথে আবিরের আ্যফেয়ারের গুজব ছড়িয়েছিলাম।
ও তখনও আমার ছিলো যখন ওর দারোয়ান কে ঘুষ দিয়ে ওর বাড়ির দেয়ালে বিশ্রী সব নোংরা কথা লিখে দিয়ে এসেছিলাম।
ও তখনও আমার ছিলো, যখন ওর পাসওয়ার্ড হ্যাক করে ওর ফেসবুক একাউন্টে ঢুকে ভাইরাল করে দিয়েছিলাম সবকিছু।
ভালোবেসে তার নাম দিয়েছিলাম অতন্দ্রিলা। আমার অতন্দ্রিলা।
(বিদেশী গল্পের ছায়া অবলম্বনে)
( অতন্দ্রিলা নামটি অমিয় চক্রবর্তীর ‘রাত্রি’ কবিতা থেকে ধার করে নেয়া)
Photo Courtesy: Pinterest