আমাদের মধ্যে কেউ কেউ চিন্তা করার সময় কিংবা অস্থিরতায় কলম কামড়িয়ে থাকি। স্কুল জীবনে কারণ-অকারণে কলম চিবিয়ে কলমের তেরোটা বাজানোর স্মৃতি কম বেশি সবার আছে। যে কলম ঘুরিয়ে, চালিয়ে জীবনে নানা পরীক্ষায় উর্ত্তীন হয়েছি, নিজেকে যোগ্য ভাবছি, আমরা কি জানি এই কলমে বয়স কতো ? এটি পাঁচ হাজার বছর পুরনো জিনিস। প্রাচীন মিশরে গিরিমাটি, উদ্ভিজ আঠা, মৌমাছির শরীর নিঃসৃত মোম, নল খাগড়া ইত্যাদির সমন্বয়ে প্রথম কালি তৈরী করেছিল।
প্রযুক্তির উৎকর্ষতা হাতে হাতে মোবাইল, আর অফিসে -ঘরে ঘরে কম্পিউটার এনে দিয়েছে। যা কিনা কলমের অনেক কাজ করে দিচ্ছে বটে তবে তাই বলে এইসবের ফলে কলমের উপযোগিতা এতোটুকু কমেনি। সারা বিশ্বে বিভিন্ন ধরণের কলমের ব্যবহার রয়েছে যেমনঃ বল পয়েন্ট, ফাউন্টেন,সফট-টিপ, রোলিং বল ইত্যাদি। আজকের লিখা বল পয়েন্ট কলমের কিছু জানা-অজানা বিষয় নিয়ে।
বলপয়েন্ট কলম- একটি কলম, যেখানে একটি দন্ডের অগ্রভাগে বলের তীক্ষ্ণ অংশ একটানাভাবে সংযুক্ত থাকে। নলের ভেতরে যেখানে কালি ধরা থাকে সেটির একপ্রান্তে একটি ছোট ধাতব বল আটকে থাকে। চিঠির ক্ষেত্রে, এটি কাগজের উপর ঘুরে থাকে, পিছন থেকে কালি দ্বারা ভিজতে থাকে। এক্ষেত্রে বল এবং প্রাচীরের মাঝখানে একটি ছোট্ট ফাঁক থাকে যা ফলে এটি কাগজের উপর আবর্তিত হতে পারে এবং চিহ্ন সহকারে টেনেও নেওয়া যায়। সবচেয়ে সুলভ এবং সহজ হওয়ায় এটি অধিকতর জনপ্রিয় কলম। এখানে কালির যে পেষ্ট ব্যবহার করা হয় , তা ফাউন্টেন কলমের কালির চেয়ে ভিন্ন। এটি তেল-ভিত্তিক এবং বেশি ঘনত্বপূর্ণ, এইরূপে কেন্দ্রস্থল থেকে তার ফুটো প্রতিরোধ নকশা করা হয়।
আধুনিক যে বল পয়েন্ট কলম আমরা ব্যবহার করছি। এই আকার ও অবস্থায় এসেছে তিনজন উদ্ভাবকের হাত ধরে, যার জন্য সময় অতিবাহিত হয়েছে ষাট বছর। প্রথম ব্যক্তি হিসেবে যার নাম স্বীকৃত তিনি হলেন জন লাউডন , মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৮৮৮ সালের ৩০ শে অক্টোবর মূলসূত্র ব্যবহার করে কলম তৈরী করেন। তবে সেই বল পয়েন্টটি কাগজের উপর ব্যবহার করার উপযোগী ছিল না। লিকিং সমস্যা ছিল।পরবর্তীতে তার নকশাকে কিছুটা উন্নত করে, লিকিং সমস্যা কিছুটা কমিয়ে লাস্লো বিরো এবং তার ভাই জর্জ একটি নতুন ভার্সনের কলম সামনে নিয়ে আসেন। যা কিনা প্রথম বারের মত ব্যবসায়িকভাবে গুরুত্ব লাভ করে ছিল। তার পরের বছর ব্যারন মার্সেল বীচ সবচেয়ে উপযোগী ভার্সন আনতে সক্ষম হন এবং প্যারিসে এর উৎপাদন শুরু করেন। বর্তমানে নানা প্রযুক্তির হাত ধরে বল পয়েন্ট কলমের কালি, বল, বডিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে।
ফাউন্টেইন কলম ব্যবহারে সকল সমস্যার সমাধান স্বরূপ এই বলপয়েন্ট কলম বহুল ব্যবহৃত এবং জনপ্রিয়। চলুন জানি, প্রতিদিন ব্যবহৃত সাধারণ এই জিনিসের আরো কিছু চমৎকার তথ্য।
১। বলপয়েন্ট মূলত গ্রেট ব্রিটেনের রয়েল এয়ার ফোর্সের জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। কেননা ফাউন্টেইন কলম দ্বারা মহাকাশে লিখা সম্ভব না। বায়ুমন্ডলী চাপ হ্রাস জনিত কারণে এবং অভিকর্ষের প্রভাবমুক্ত ভারহীন অবস্থায় এটির সাহায্যে লিখা সম্ভব ছিল না। উল্লেখ্য দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ্বের সময় পাইলটরা বলপয়েন্ট কলম ব্যবহার করেছিল উচ্চতায় ভাল কাজ করার গুনে।
০২। যে কলম জীবনকে সার্থক করার ক্ষমতা রাখে সে কলমই আবার জীবন শেষ করতে পারে। অনেক সময় খেলার চলে কলমের ক্যাপ মুখে চলে যায়। অনেকে গিলে ফেলে। এভাবে প্রতি বছর এই বল পয়েন্ট কলমের কারণে বিষম খেয়ে ১০০ জন মৃত্যুবরণ করেন।
০৩। বলপয়েন্টের প্রথম গোছা বিক্রি আরম্ভ হয়েছিল ১৯৪৫ সালে নিউ ইয়র্কে। সারি ছিল এমন ,কর্তৃপক্ষ কয়েকশ পুলিশ দিয়ে বেষ্টনী দিয়েছিল। দিনে বিক্রি হয়েছিল ১০,০০০ কলম, যদিও নতুনত্বে দাম পড়েছিল কলম প্রতি ১২ ডলার, যা আমেরিকার শিল্প শ্রমিকের আট ঘন্টা শ্রমের প্রাপ্তি। বছরে যুক্তরাষ্ট্রে দুই বিলিয়নের বেশি কলম তৈরী হয়।
০৪। কালি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বলপয়েন্ট কলমের নল বাদ্যযন্ত্রবিশেষের মত বাঁকান ছিলঃ তাদের ডবল দৈর্ঘ্য ছিল। পরে উৎপাদন খরচ কমাতে পাতলা, মসৃন নল তৈরী করা শুরু করে। বলপয়েন্ট কলম তৈরীতে মেটাল, প্লাস্টিক এবং বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহার হয়ে থাকে। শুরুর দিকে সাধারণ ষ্টিল বল ব্যবহৃত হতো। তাছাড়া বল পয়েন্ট কলমের কালি তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। ভুল হলে মুছার সুযোগ না থাকলেও আর্টিষ্টরা তাদের আর্টওয়ার্কের জন্য বল পয়েন্ট ব্যবহার করে থাকেন।
০৫। প্রায় সকল ইউরোপিয়ান ভাষায় বল পয়েন্ট কলমকে বুঝাতে “ball” শব্দ ব্যবহৃত হয়ঃ ইংরেজিতে “ballpoint”, স্প্যানিশ ভাষায় «bolígrafo» , ইতালিয়ান ভাষায় «penna a sfera» , জার্মানীতে «Kugelschreiber»। শুধুমাত্র আর্জেন্টিনাতে কলমকে “birami” বলা হয়, উদ্ভাবককে সম্মান জানাতে বলা হয় Laszlo Biro pen। তিনি মৃত্যুবরন করেছেন খুব বেশি বছর হয়নি, ১৯৮৫ সালে।
০৬। প্রতি সেকেন্ডে পৃথিবীতে ১২৫ টি কলম বিক্রি হয়ে থাকে। কলম বাজারের এক-তৃতীয়াংশ হল আমেরিকায় বি আই সি এর মালিকানাধীন। যা ১৯৮৩ সাল থেকে সাত বিলিয়নের অধিক কলম বিক্রি করেছে।
০৭।আমেরিকাতে গড়ে ব্যক্তি বছরে ৪.৩টি কলম ব্যবহার করে, একটি ভাল কলম দিয়ে ৫০হাজার শব্দ লিখা যায়।
০৮। ৯৫% তদন্তে দেখা যায়, কোন ব্যক্তিকে কলম দেওয়া হলে ,প্রথম শব্দ হিসেবে নিজের নামই লিখে থাকে।
০৯। আমেরিকায় ইংলিশ স্পিকিং কলম-কম্পিউটার রয়েছে, যা বিশেষ ধরণের কাগজের সহকারে বিক্রি হয়। যা লিখায় ভুল সংশোধন করতে সক্ষম, স্প্যানিশ ভাষা অনুবাদ করতে সক্ষম এবং শব্দ উচ্চারণ করতেও পারে।
১০। গিনিস বুকের রেকর্ড অনুসারে সবচেয়ে দামী কলমের দাম হল এক মিলিয়ন ইউরো। এই প্লাটিনাম কলমের নাম “মন্টেগ্রাপ্পা”। বিশ্বের সবচেয়ে বড় কলম হল ১৮ ফুট ০.৫৩ (৫.৫ মি)এবং ওজনের দিক থেকে ৮২.৮০পাউণ্ড ১.২৪ আউন্স (৩৭ কেজি)। ২০১১ সালে Acharya Makunuri Srinivasa এটি তৈরী করেন।
মজার বিষয় হল বলপয়েন্ট কলম দিবসও আছে। কখন? ১০ই জুন উদ্ভাবকদের(বিরো এন্ড ব্রাদার) স্মরণ করে দিনটি পালিত হয় । কেননা ১৯৪৩ সালের এই দিনে ইউরোপিয়ান প্যাটেন্ট অফিসে তারা প্যাটেন্টের আবেদনপত্র পূরণ করেন। এই প্যাটেন্ট রাইটস পরবর্তীতে বৃটিশ পার্লামেন্ট কিনে নিয়েছিল। নানা বাহারের আ্যপসের এই যুগে চলুন বলপয়েন্ট দিবসে প্রিয় মানুষকে একটি চিঠির সাথে একটি বল পয়েন্ট কলম উপহার দেয়।
লেখিকা সম্পর্কেঃ এ্যানি মাসুদ। ভাল লাগে লেখালেখি, বই পড়া,কবিতা লেখা। এছাড়া নতুন এবং সিম্পল রান্না শিখতে এবং খাওয়াতে পছন্দ করি। ইউ এস এ বাংলা পত্রিকা “ঠিকানা”য় মুক্তাঙ্গনে নিয়মিত লিখা হয়। তাছাড়া অনলাইনে লেখালেখির সাথে জড়িত বছর খানেক ধরে। পরিবারকে সময় দিতে ভালোবাসি। কাজ করি কিন্তু চাকরি করি না।