২০১৬ সালের সেরা কিছু বাংলা মৌলিক থ্রিলার বই

বাংলাদেশে মৌলিক থ্রিলার লেখার চর্চা খুব বেশিদিন আগের না। এর আগে বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকজন অল্প কিছু মৌলিক থ্রিলার লিখলেও মূলত ২০১২ সালে বাতিঘর প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত শরীফুল হাসানের ‘সাম্ভালা’ আর ২০১৩ সালে মাশুদুল হকের ‘ভেন্ট্রিলোকুইস্ট’ এর ব্যাপক পাঠক প্রিয়তা পাওয়ার পর এই চর্চা খুব ভালভাবে শুরু হয়। আর এখন তো প্রতি বছরই বেশকিছু সাড়াযাগানো মৌলিক থ্রিলার প্রকাশিত হচ্ছে। আজ এই বছর প্রকাশিত কিছু মৌলিক থ্রিলারের কথা বলব আমি।

 

১। অক্টারিন – তানজীম রহমানঃ বইটি হাতে নেয়ায় পর পাঠক একটি অদ্ভুত জিনিস খেয়াল করবেন। সূচিপত্রের মত করে বইটিতে বইটি পড়ার একটা টাইম টেবিল দেয়া আছে। ব্যাপারটা হচ্ছে এইরকম- আপনি দিনের বেলায় ক্লাসের ফাঁকে বসে যদি ভূতের বই পড়েন আপনার কাছে সেটা হাস্যকর লাগবে। কিন্তু সেই একই বই গভীর রাতে যখন চারপাশ নিস্তব্ধ, লাইট নিভিয়ে রিডিং ল্যাম্প জ্বেলে যদি পড়েন, ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করে দেবেন! বইয়ের শুরুতে লেখক সেইরকমই একটা টাইম টেবিল দিতে চেয়েছেন কোন সময় বইটি পড়ে আপনি সবচেয়ে বেশি মজা পাবেন। তবে আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আপনি যদি লেখকের বেঁধে দেয়া সময় না মেনেও বইটি পড়েন, তাহলেও আপনার মজা একটুও কমবে না। সত্যি কথা বলতে কি, এই জনরার আর কোন বই আগে বাংলাদেশে আর কখনো লেখা হয়নি। বাংলা সাহিত্যে ‘ইসলামি মিথ’ নিয়ে এইবারই প্রথম কিছু লেখা হল! মিথ, ইতিহাস, কিছু ফ্যাক্ট আর ফ্যান্টাসি ফিকশন সব মিলিয়ে অসাধারণ একটা বই হল অক্টারিন।

 

২। মিনিমালিস্ট – মাশুদুল হকঃ অন্য থ্রিলার গুলির মত বইয়ের শেষে মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মত টুইস্ট এতে নেই। কিন্তু চ্যাপ্টারে চ্যাপ্টারে চমকে দেওয়া টুইস্ট ছিল প্রায় পুরো বই জুড়েই। মিনিমালিস্ট এমন একটা বই, যেটা আগা গোড়া ইতিহাস আর তথ্য দিয়ে পরিপূর্ণ হলেও পড়তে একবিন্দু বিরক্তি লাগে না। তবে অবশ্যই বইটা সময় নিয়ে পড়া উচিৎ। এবং খুব মনোযোগ দিয়ে। কারণ তা না এমন সব ব্যাপার মিস হয়ে যেতে পারে যার কারণে কাহিনিতে তালগোল পাকিয়ে ফেলার সমূহ সম্ভাবনা আছে। লেখক বইয়ে ইউনিক কিছু আইডিয়া নিয়ে কাজ করেছেন। একেক সময় একেক চরিত্রকে উত্তম পুরুষে রেখেছেন। এতে প্রত্যেকটা চরিত্রের মনোভাব বোঝা গেছে খুব ভালভাবে। নাম পুরুষে মাঝেমাঝে চরিত্রের মনে কী চলছে সেটা ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাই এটার দরকারও ছিল কাহিনীর প্রয়োজনে। মনোযোগ দিয়ে না পড়লে কিন্তু পাঠক বুঝতে পারবে কখন কে কথা বলছে।

 

৩। মিথস্ক্রিয়া – কিশোর পাশা ইমনঃ ইতিহাস কপচানো বই হয়ত অনেকেরই পছন্দ না। কিন্তু সেই ইতিহাস যদি সুনিপুণ ভাবে দক্ষ হাতে পারফেক্ট জায়গায় সাজানো থাকে, তবে? এমন একটা বই খুব ধৈর্য্য আর সময় নিয়ে হাতে নিতে হয়। অসাধারণ একটা প্লটে দারুণ ভাবে সাজানো একটা উপন্যাস। কাহিনির গতিও দারুণ। কে.পি-র লেখালেখী নিয়ে যাদের আগে থেকে ধারণা আছে তাদের কাছে হোমিসাইড ডিটেক্টিভ আসিফ আহমেদ আর কন্ট্রাক্ট কিলার ইরফান আহমেদ দুটোই খুব প্রিয় চরিত্র। আর আগের ধারনা না থাকলেও সমস্যা নেই, এই বই পড়তে গিয়ে আপনি তাদের ভক্ত হয়ে যাবেন। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা গোপন কাল্টগুলো সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারবেন। স্পয়লার ফ্রি একটা ছোট্ট টুইস্টের কথা বলি- বাংলাদেশের খুব বিখ্যাত একটা জায়গা নিয়ে এখানে এমন সব ফ্যাক্টের আলোচনা করা হয়েছে, পড়তে গিয়ে আপনি বিশাল একটা ধাক্কা খাবেন। অবিশ্বাস করবেন কিন্তু হেসে উড়িয়ে দিতে পারবেন না, ব্যাখ্যাটা আজগুবি কিন্তু ফ্যাক্টগুলি যে মিথ্যা নয়! সবমিলিয়ে বলা যায়, মিথস্ক্রিয়া ইতিহাস, বিজ্ঞান, ধর্ম আর ফিকশনের সংমিশ্রনে চমৎকার উপভোগ্য একটা বই।

 

৪। ফিনিক্স – জাহিদ হোসেনঃ চমৎকার বর্ণনাভঙ্গী। ছোট ছোট ব্যাপারগুলির এত সুন্দর বর্ণনা যে খুঁটিনাটি সমস্ত কিছু চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আবার বিশদ বর্ণনা হলেও মোটেও একঘেয়ে নয়। খুবই উপভোগ্য। লেখনিতে হিউমার বেশ প্রবল। এই তো গেল লেখনি প্রসঙ্গ, এখন আসি কাহিনিতে। খুব টান টান উত্তেজনাকর একটা কাহিনি। একই সময়ে দুই জায়গার কাহিনি টেনে গেছেন লেখক। দুই জায়গাকে মিলিয়েছেন এমন একটা অবস্থানে যে পাঠক শিরদাঁড়া সোজা করে বইয়ে মনোযোগ দেবে। মাঝখানে কাহিনীতে একটু ধীরতা আসলেও শেষের টুইস্টটা অভূতপূর্ব। পুরোটা পড়া শেষ হলে পাঠক নিজের অজান্তেই বলে বসবেন ‘মাইরি! কি পড়লাম এটা!’ প্রথম উপন্যাস ‘ঈশ্বরের মুখোশ’ নিয়ে অনেককে নেতিবাচক বলতে শোনা গেলেও এই বইটি সব ধরনের থ্রিলার পাঠকদের মন কাড়তে সক্ষম হয়েছে।

 

৫। ফোরটিএইট আওয়ার্স – রবিন জামান খানঃ একটা আদর্শ মার্ডার মিস্ট্রির মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘কে খুনী’ শেষ পৃষ্ঠা পড়ার আগ পর্যন্ত পাঠক সেটা কখনোই ধরতে পারবে না। কিন্তু একটা মার্ডার মিস্ট্রি শুরু করার পর প্রথম দশ মিনিটেই যদি আপনি বুঝে ফেলেন খুনী কে আর পনেরো মিনিটের মাঝেই যদি আপনার কাছে খুনের মোটিভ পরিষ্কার হয়ে যায়, তাহলে সে বইটিকে রসকষহীন ভাবাই স্বাভাবিক, তাই না? ‘ফোরটিএইট আওয়ার্স’ ব্যতিক্রম এই জায়গাতেই। ৩০০+ পৃষ্ঠার বই, প্রথম ২০ পৃষ্ঠার মাঝেই আপনি জেনে যাবেন খুনী আর খুনের মোটিভ সম্পর্কে। কিন্তু আপনার আগ্রহ একটুও কমবে না। প্রাইম সাসপেক্ট কিভাবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে আর আসল খুনী কিভাবে ধরা পড়ে এটা জানতে বইটি আপনাকে টানা পড়ে যেতে হবে। প্রথম উপন্যাস ‘২৫শে মার্চ’-এর মত অতটা ভালো না হলেও বইটি পড়তে একেবেরে খারাপ লাগবে না।

 

৬। সার্কেল – জাবেদ রাসিন ও তাকরীম ফুয়াদঃ বাংলাদেশে যৌথ বই লেখার চর্চা ‘সেবা’ ছাড়া আর অন্য কোথাও প্রচলিত ছিল না। বইমেলা ২০১৫ তে জাবেদ রাসিন ও তাকরীম ফুয়াদ মিলে ‘ব্ল্যাকগেইট’ লেখার মাধ্যমে সেবার বাইরে এই রীতির প্রবর্তন করেন। এই বইটা হচ্ছে প্রথম বই ব্ল্যাকগেইটের স্যিকুয়াল। ব্ল্যাকগেইট পড়া না থাকলে এই বইটা পড়ে প্রকৃত মজাটা পাওয়া যাবে না। কিন্তু যারা আগে ব্ল্যাকগেইট পড়েছেন তাদের কাছে এই বইটি আরেকটা মাস্টারপিস। সারাদেশে সিরজ বোমা হালমা, প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার নীল নকশা এবং সেই হত্যার ষড়যন্ত্র ন্যাৎসাত করার জন্য দেশের সবচেয়ে চৌকশ অফিসারদের একটা রাপিড টিমের দিনরাত নিরলস কাজ করে যাওয়া, সব মিলিয়ে চমৎকার একটা বই।

(বিঃদ্রঃ তালিকাটি স্বীকৃত কোন তালিকা নয়, লেখকের ব্যক্তিগত পছন্দানুযায়ী করা হয়েছে।)