খেলা যখন শুরু হচ্ছে, আমি নিজের আবাসস্থল থেকে অনেক দূরে। শেরপুর বাসস্ট্যান্ডে বাসে বসে অপেক্ষা করছি। টসে জিতে সাকিব বোলিং নিলো, মনটা খুশিতে ভরে উঠেছে এই ভেবে যে বাসায় গিয়ে বাংলাদেশের ব্যাটিং দেখতে পারব। খেলা শুরু হলো … আপডেট দেখছি … একটা একটা করে উইকেট পড়ছে… তখন মনে হলো ধুর শালা, কী মিসটাই না করছি। পাঁচ নাম্বার উইকেট পড়ে যাওয়ার পর বান্ধবী উচ্ছ্বসিত গলায় বললো, দোস্ত পাঁচটা গেছে!
পাঁচ আর শ্রীলংকা বনাম বাংলাদেশ খেলার বাজে এক ইতিহাস আছে। একদা ৬ রানে শ্রীলংকার ৫ উইকেট ফেলার পরেও বাংলাদেশ শ্রীলংকার সাথে জিততে পারেনি। মুখ গোমড়া করে উত্তর দিলাম, তারপরেও দেখিস, একশ রানে অল আউট করতে পারবে না।
সত্যিই পারেনি।
লম্বা জার্নি করে বাস থেকে নেমে যেন আর তর সয় না। ইচ্ছে হয় এক ছুটে বাসায় চলে যাই। রাস্তা থেকে বাসা দশ মিনিটের হাঁটাপথ। ওটুকু পথ আসতে গিয়ে মাঝে মাঝেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়তে হচ্ছে। রাস্তার দুইপাশের প্রত্যেকটা দোকানেই খেলা চলছে।
খেলা দেখছি। টান টান উত্তেজনা। শেষ ওভার। আল্লাহ আল্লাহ করছি। প্রথম দুই বলে পরপর দুটি বাউন্সার দিল! পরেরটার উচ্চতা আরও বেশি ছিল। লেগ আম্পায়ারকে খুব ভদ্রতার সাথেই ব্যাপারটা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো মাহমুদউল্লাহ। ওই সময়ে জুস হাতে ব্যাটসম্যানদের কাছে এলেন বারোতম খেলোয়ার নুরুল হাসান। থিসারা পেরেরার সাথে নুরুলের বাকবিতণ্ডা, আম্পায়ারদের হস্তক্ষেপে নুরুল বেরিয়ে আসা, এবং এরপর বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব আল হাসানকে দেখানো হলো স্ক্রিনে। তখনই ঘটনা নতুন দিকে মোড় নিল।
সাকিব উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করলো, নো বল না দেওয়ার কারণ। আম্পায়ারের কাছে যথাযথ জবাব না পেয়ে সাকিব দুই ব্যাটসম্যানকে ইঙ্গিত করলেন বেরিয়ে আসতে। অ্যাম্পায়ার ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও ও মানলো না। আবারো গাটস দেখিয়ে মাহমুদউল্লাহ-রুবেলকে চলে আসতে বললো।
সবরকম প্রতিবাদ করেও শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকলেন ঠাণ্ডা মাথার রিয়াদ। সাইলেন্ট কিলার খ্যাত রিয়াদ যদি সত্যিই সাকিবের রাগে তাল মিলিয়ে মাঠ ছেড়ে চলে আসতেন সেটা খুব বাজে হতো। টান টান উত্তেজনা, রিয়াদের ম্যাচ উইনিং ছক্কা আর অপুর শুরু করা সেই যৌথ নাগিন ডান্স শ্রীলংকা বহুদিন মনে রাখবে।
খেলার পর ঘটনার বিচার করতে বসলেন ম্যাচ রেফারি ক্রিস ব্রড। শুনানির হয়নি। সবকিছু বিচার করে বাংলাদেশ ড্রেসিংরুমে একটা কাগজ পাঠিয়ে দিলেন, সাকিব-নুরুলদের ১ ডিমেরিট পয়েন্ট ও ২৫ শতাংশ জরিমানা—এ শাস্তি মানতে তাঁদের আপত্তি আছে কি না! সাকিব-নুরুল বিনা বাক্য ব্যয়ে সই করে দিলেন ব্রডের কাগজে! শ্রীলংকার ক্রিকেটারদের কোনোরকম শাস্তি দেওয়া হয়েছে কি না, জানা যায়নি।
গতকাল বাংলাদেশের এই অসাধারণ জয়ের পর পরই অনলাইনে ভাইরাল হয় দুইটি নেতিবাচক খবর। এক. ম্যাচ শেষে ড্রেসিংরুমে ভাংচুর করেছেন বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা! দুই. বাংলাদেশ বনাম শ্রীলংকা ম্যাচ শেষ হবার আগেই ফাইনালের টিকিট ছাপা হয়ে গেছে। ওতে লেখা, ফাইনাল হবে ভারত বনাম শ্রীলংকা।
প্রথম ঘটনায় ক্রিকেটাররা ক্ষুব্ধ হয়ে নিজেদের ড্রেসিংরুমেই ভাংচুর করেছেন, এমনটা খুবই হাস্যকর, যেখানে বিনাবাক্য ব্যয়ে সাকিব-নুরুল শাস্তি মেনে নিয়েছেন। সিসি ক্যামেরায়ও এমন কিছু পাওয়াও যায়নি। হয়ত ড্রেসিংরুমের কাঁচের ঐ অংশটুকুতে কারিগরি কোন ত্রুটি ছিল যার কারণে সামান্য ধাক্কাতেই সেটি ধ্বসে পড়েছে।
কোনরকম তথ্য কিংবা ভিডিও প্রমাণ ছাড়াই সনাৎ জয়সুরিয়ার মতো সাবেক ক্রিকেটার যখন এই ঘটনাকে ‘তৃতীয় শ্রেণীর আচরণ’ বলে টুইট করলেন, তখন সত্যিই মনে হয়, এই শ্রীলংকা কি সেই শ্রীলংকা?
কালকের পুরো ম্যাচে বোঝা গেছে, ওরা সমস্ত অনৈতিকতা দিয়ে হলেও আমাদের হারাতে চেয়েছে। এই অগ্রিম ছাপানো টিকিটের ছবি দেখে অনেকেই ভেবে নিচ্ছে, এটাও আরেকটা চতুর্থ শ্রেণীর কাজ।
কিন্তু ঘটনা হলো, ত্রিদেশীয় কিংবা দুইয়ের অধিক দল নিয়ে টুর্নামেন্ট হলে সেখানে প্রথম পর্বের ম্যাচ শেষ হওয়ার আগে আগেই (যদি গ্যাপ বেশিদিন না থাকে) দ্বিতীয় পর্ব, সেমিফাইনাল, ফাইনালের টিকেট ছেপে ফেলে(এমনকি বিজ্ঞাপন বোর্ড, ফেস্টুন, ব্যানার এসবও)। এক্ষেত্রে নিশ্চিতকারী দল/দলগুলোর সাথে যাদের সম্ভাবনা আছে তাদের নামসহ দুই বা ততোধিক ধরনের টিকিট ছাপা হয়। টিকিটে ছাপা নাম নিয়ে তাই বিতর্কের সুযোগ নেই। ইন্ডিয়া যেহেতু আগেই নিশ্চিত করেছে, ইন্ডিয়া ভার্সাস শ্রীলংকা আবার ইন্ডিয়া ভার্সাস বাংলাদেশ দুইটাই ছাপা হবে।
এটাও জাস্ট বিতর্ক সৃষ্টি করার জন্যই ভাইরাল করা।
দুইটা ঘটনাই দুই দেশের এগেইনস্টে বিতর্ক তৈরির উদ্দেশ্যে ছড়ানো হয়েছে।
সব মিলিয়ে গতদিনের ম্যাচে যেসব ঘটনা ঘটেছে, দিনশেষে সেসব যেন একটা কথাই বোঝাচ্ছে, বাংলাদেশ আর মিনোস দল নয় যে, এই দেশের সাথে সবধরণের জোচ্চুরি করে পার পাওয়া যাবে।
আগামিকালকের ম্যাচ বাংলাদেশ জিতুক কিংবা হারুক, হৃদয়ে বাংলাদেশ।