প্রচণ্ড চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে গেল তৃষার । কোথায় ভেবেছিলো আজ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে অফিস ছুটি , লম্বা একটা ঘুম দেওয়া যাবে। তার আর হলো কোথায় ! চোখ দুটি বলছে “ তৃষা মা আমার , তুই আরেকটু ঘুমিয়ে নে । ছুটির দিনের ঘুম এইভাবে নষ্ট করতে নেই সোনামণি ‘’। আর কান দুটি যেন চোখের সতীনের মতো বলছে , “ অনেক ঘুম হয়েছে মহারাণী । আর ঘুমিয়ে কাজ নেই । ছুটির দিন বলে সারাবেলা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে হবে এটা কোথায় লিখা আছে বাছা আমার ।শীঘ্রই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়। দুই সতীনের লড়াই শেষে “কান “ দুটোকে তার বিজয়ী হিসেবে মানতে হলো । কিন্তু তৃষা এখন বুঝতে পারছেনা এতো শব্দ আসছে কথা থেকে । প্রথমে ভেবেছিলো পাশের বাড়ির বাচ্চাগুলো হয়তো চেঁচামেচি করছে । এখন তো মনে হচ্ছে এই বিকট শব্দের উৎপত্তিস্থল তার নিজ ঘর ।
বসার ঘরে গিয়ে দেখে বাবা আর ভাই চুপ করে বসে আছে আর কাজের রিনা মাসি মায়ের মাথায় জল ঢালছে । কি হয়েছে জানতে চাওয়ার সাথে সাথে মা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিল
– “ আমার পহেলা বৈশাখটা মাটি হয়ে গেলরে তৃষা। কত শখ করে বিশটা দোকান ঘুরে ওই শাড়ীটা কিনে এনেছিলাম । কত প্ল্যান ছিল আমার । ঐ শাড়িটা পরে ঘুরতে বেরুবো , ফেসবুকে ছবি দিব । এইবার নিশ্চয় আমার ছবি গুলো রায় গিন্নির চেয়ে বেশি লাইক কামাবে । কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল ‘’ এই বলে তিনি আবার ডুকরে কেঁদে উঠলো ।“ ঘরে এতজিনিস থাকতে কিনা আমার এতো সাধের শাড়ীটাকেই উধাও হতে হলো।
-“ তোদের মাকে সে কখন থেকে বলছি বাজারেতো আরো অনেক শাড়ী রয়েছে । তৃষা আর তুমি বেরিয়ে না হয় অন্য একটা কিনে নিবে । হয়তো দেখা যাচ্ছে যা গেছে তার চেয়ে আরো ভালো কিছু পেয়ে গেছো”।
– “ তুমি চুপ করো । সারাজীবনতো কাটিয়ে দিলে ঐ অফিস আর খবরের কাগজ নিয়ে । ফ্যাশনের কিছু বোঝো ?’
মায়ের এই ধমকের পর স্বান্তনা দেওয়ার সাহস আর কারোরই ছিলোনা । মা এমনি । তার এই ছোট্ট সংসার আর নতুন ডিজাইনের শাড়ী । এই দুটোই যেন তার পৃথিবী । কাজ শেষে সারাদিন একা থাকে । তাই তৃষা মাকে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিল যাতে অবসর সময়টা মায়ের ভালোই কেটে যাই । কিন্তু এই অ্যাকাউন্ট অনেকটা “ খাল কেটে কুমির আনার” মতো হয়ে গেল তাদের জন্য । মায়ের যে বান্ধবীগণ রয়েছেন তারা সবাই যেন এক নতুন প্রতিযোগিতাই নেমেছে । কার চেয়ে কার ছবিতে বেশি লাইক, কমেন্ট পড়বে আন্টিরা এখন সে চিন্তায় মশগুল সর্বদা । সারাদিন অফিসের এতো চাপ , তারপর বাড়ি ফিরে এসে মায়ের এই অনলাইন জগতের গল্প । আবার না শুনতে চাইলেও বিপদ । মায়ের চোখ দুটো থেকে অবিরাম বর্ষণ হতে থাকে ।
কিন্তু আজকের বৃষ্টি যেন কিছুতেই থামছেনা । রিনা মাসি এতো জল ঢালছে মনে হচ্ছে একটু পর একটা প্রবল বন্যা হতে পারে । মা শোকে এতটাই জমে গেছে যে, পহেলা বৈশাখে শাড়ী পরে ফেসবুকে ছবি দেওয়া ছাড়া যে আরো অনেক কাজ থাকে সেটা মায়ের মাথা থেকেই বেরিয়ে গেছে ।
-“ মা, আজ আমাদের সবাই মিলে বেরুনোর কথা আছে । তুমি তো দেখছি সে কথা ভুলেই গেছো। এমন জলভর্তি মাথা নিয়ে বেরুলে লোকে কি বলবে বলো তো। তোমার একটা ছবিও ভালো আসবেনা । আর তোমার বান্ধবীদের ……’’
– “ অনেক বলেছ, আর বলতে হবেনা । কিগো বীণার মা , কাজকর্ম না করে বসে থাকলে চলবে কি ? জলদি কাজ শেষ করে নাইতো বাপু। বিকেল বেলা মেয়েকে নিয়ে এসো । মনে থাকবে তো ?’’ “ আজ্ঞে দিদি , মনে থাকবে।‘’
পরিবারের সবার সাথে সময় কাটানোর ব্যপারটাই অন্যরকম । তা যদি আবার বিশেষ কোন উপলক্ষ্যে হয় । সারাদিন ঘোরাফেরার পর সবাই খুব ক্লান্ত । মায়ের সে মন খারাপের ব্যাপারটি এখন আর নেই । হঠাৎ কলিং বেলটা বেজে ঊঠলো ।
“ মনে হয় বীণার মা এসেছে । ওদের তো নেমতন্ন করেছিলাম । দরজাটা খুলে দিয়ে আয় তো মা ‘’। বীণা আর রিনা মাসিকে দেখে মায়ের চোখ দুটো ছানাবড়া । যেন তারা মেয়ের দুটো কিডনি খুলে নিয়ে বসে আছে । তৃষা অবশ্য এরকম কিছু দেখবার জন্য আগে থেকেই প্রস্ত্রুত ছিলো । কিন্তু মা তো আর প্রস্তুত ছিলোনা । তার হারিয়ে যাওয়া শাড়ী বীণার কাছে কি করে গেল । তবে বীণার মা…। না না ,চুরির অভ্যেস এই মহিলার নেই।এতো বছর ধরে দেখে আসছে । কিন্তু বীণার কাছে কি করে ? নতুন কিনেছে নিশ্চয়। কিন্তু এতো দাম তো কিনতে পারার কথা না । মায়ের মনে একটা প্রশ্নের জাল তৈরি হয়ে গেছে তৃষা তা ভালই টের পাচ্ছিলো ।
-“ কি সুন্দর লাগছে তো কে বীণা । শাড়ীটা খুব সুন্দর মানিয়েছে তো কে । “
-“ মাসি এর আগে আমাকে এতো সুন্দর উপহার কেউ দেয়নি । দিদি যখন কাল আমকে শাড়ীটা দিয়ে বললো আপনি আমার জন্য এটা নিজে পছন্দ করে কিনেছেন তখন মনে হচ্ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে দামি উপহারের মালিক আমি । কিন্তু আবার একটু খারাপ লাগছিল এটা ভেবে, আমাকে এতো ভালো একটা উপহার দিলো কিন্তু আমার তো মাসিকে দেওয়ার মতো কিছু নেই । স্কুলের টিফিন খরচ থেকে সামান্য কিছু টাকা জমিয়েছিলাম দিয়ে এই চুড়ি গুলো আপনার জন্য কিনে এনেছি ম্যাডাম । জানিনা এই সস্তা উপহারটুকু আপনি গ্রহন করবেন কিনা “ তৃষা দেখছে মায়ের চোখ জলে ছলছল করছে ।
_ “ পছন্দ হবেনা কি বলছিস , এইবার পহেলা বৈশাখে এর চেয়ে ভালো উপহার আমাকে কেউ দেয়নিরে ‘’। বলার পর মা আড়চোখে তৃষার দিকে একটু তাকালো এই চাহনিতে কোন অভিমান নেই ।
“ তৃষা ,দাঁড়িয়ে আছিস কেন ওখানে ? জলদি আয় ।আমার দুই মেয়ের সাথে একটা সেলফি তুলি । ফেসবুকে অ্যাড করতে হবে তো ।‘’