খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করতে গেল শোহান। হলের ভাংগা আয়নায় মুখে গিজগিজে দাড়ি গোঁফ দেখে মুখ কুচকে উঠল ওর। হাত বাড়িয়ে ট্রিমারটা নিয়ে সুইচ অন করল।
আজ শোহানার সাথে দেখা হবে। গত চার বছর এই দিনটা শুধু শোহানার জন্যই আলাদা করে রাখে ও। শোহানা বলেছে এরকম দাড়িতে ওকে খুব ভাবুক মনে হয়। তাই দাড়ি কখনো ছোট করেনা শোহান।
শখ করে কেনা ট্রীমারটা কোন কাজেই লাগছেনা। রোজ দাত ব্রাশ করার সময় ওটা অন করে মটরের শব্দ শুনতে খুব ভাল লাগে ওর।
ফ্রেশ হয়ে আলমারি থেকে বাসন্তী রঙয়ের ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবিটা বের করে পরল শোহান, সাথে নীল রঙের স্ক্র্যাচড জীন্স। তারপর শখ করে কেনা সোনালী ফ্রেমের নীল লেন্সওয়ালা রোদচশমাটা পরে আরেকবার আয়নায় চেহারাটা দেখে নিল। এই চশমাটাকে কোনভাবেই খ্যাত বলতে পারবেনা শোহানা।
স্টেশনে পৌছে শোহান দেখল শোহানা তখনো আসেনি। মুঠোফোনে ডায়াল করতে সে বলল, ‘আমার আসতে আধা ঘন্টা দেরী হবে।’
: ‘কোন সমস্যা নেই সোনা, ওটুকু সময় আমি হেডফোনের গিট্টূ খুলেই কাটিয়ে দেব।’
আধাঘণ্টার জায়গায় এক ঘণ্টা পনের মিনিট পর এল শোহানা, ততক্ষনে একবার গিট্টূ ছাড়িয়ে আবার গিট্টু লাগিয়ে ফেলেছে শোহান।
শোহানাকে একটা ছেলের বাইকে চড়ে আসতে দেখে ভ্রু কুচকাল শোহান। ওকে নামিয়ে দিয়ে পাঞ্জাবির বোতাম থেকে একটা লাল গোলাপ বের করল ছেলেটা, মিষ্টি হেসে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরল। উচ্ছ্বল হেসে গোলাপটা নিয়ে খোপায় গুজে রাখল শোহানা।
:’স্যরি, দেরি করে ফেললাম। আসলে রুহানের সাথে একটু বেরিয়েছিলাম তো…।’
:’এই রুহানটা আবার কে?’
:’আরে, আমার ক্লাসমেট। ওই তো আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেল।’
:’ও আচ্ছা। আমাদের আজকে প্লান কি?’ হাতের চারটে গোলাপের তোড়াটা আলগোছে পাঞ্জাবীর পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল শোহান।
:’এইতো, তোমার সাথে কিছুক্ষণ গল্প-গুজব করব, ঘোরাঘুরি করব তারপর আমার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাব।’
:’রুহানের সাথে এত খাতির কিসের তোমার? এইসব ছেলেদের সাথে বেশী মিশবা না। এই টাইপের ছেলেরা বেশী সুবিধার হয়না।’
:’এই টাইপের ছেলে মানে কি? আমার বন্ধুদের নিয়ে একদম বাজে কথা বলবা না তুমি।’
:’আচ্ছা বাদ দাও। চল আমরা কোন পার্কের বেঞ্চিতে বসে গল্প করি।’
:’পার্কের বেঞ্চিতে? লোকে দেখলে কি মনে করবে? পার্কে ছেলেমেয়েদের একসাথে দেখলে কিসব বলাবলি করে মানুষ, জানোনা তুমি? আর তাছাড়া আমার কাজিনদের সাথে যদি দেখা হয়ে যায়…।’
:’তোমার কাজিনরা পার্কে আসবে কেন?’
:’একদম ফালতু প্রশ্ন করবা না। চল আমরা কোন রেস্টুরেন্টে যাই।’
:’চল।’
একটা রিকশা ডেকে উঠে বসল দুজন। শোহানার সাথে পরিচয়ের চার বছর পূর্তিতে চারটা গোলাপ আর জারবেরা ফুলের তোড়াটা দেয়ার ছুতো খুঁজছে শোহান, কিন্তু যুতসই কোন সুযোগ পাচ্ছেনা। ইতিউতি করে পাঞ্জাবীর পকেটে হাত ঢুকাতেই ওর দিকে তাকাল শোহানা-
:’এইটা কি পরছো তুমি ? এই রঙের প্যান্টের সাথে কেউ এই রঙের পাঞ্জাবী পরে কেউ? আর এই অদ্ভুত রঙের সানগ্লাস কিনেছ কেন? এইটা কি ১৯৫০ সাল? এমন কটকটে রঙের সানগ্লাস পরে কেউ এখন?’
সবগুলো হোমওয়ার্কে একসাথে লাল কালি খেয়ে বিহবল শোহান কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময় শোহানার ফোন বেজে উঠল।
:’হ্যা রুম্মান, বলো।’ কয়েক সেকেন্ড ওপাশের কথা শুনে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আমি ক্যাসেল সালামের সামনে অপেক্ষা করছি তোমার জন্য।’
:’ক্যাসেল সালামের সামনে অপেক্ষা করছি মানে? এই রুম্মানটা আবার কে?’
:’স্যরি শোহান। আজকে তোমার সাথে যেতে পারছিনা। রুম্মান আমার ছোটবেলার বন্ধু। ওর সাথে বিকেলে বেরনোর কথা ছিল। কিন্তু ওর ফ্লাইট কাল ভোরে তাই বিকাল থেকে ও ব্যাস্ত থাকবে। এখন না হলে আর দেখা হবেনা ওর সাথে।’
ক্যাসেল সালামের সামনে শোহানাকে নামিয়ে দিয়ে একটু সামনে এসে রিকশাটা ছেড়ে দিল শোহান। রাস্তার অন্য পাশ থেকে দেখল, পাঁচ মিনিট পর একটা ঝকঝকে ল্যান্সারে শোহানাকে তুলে নিল- রুম্মান নয়, শোহানের ক্লাসমেট সাজ্জিদ।
দীর্ঘশ্বাস চেপে আস্তে করে চোখের কোনাটা মুছে নিল শোহান। তারপর নীল লেন্সের রোদ চশমাটা খুলে ছুড়ে ফেলল ডাস্টবিনে। এমন খ্যাত রঙের চশমা আজকাল কেউ পরে?
চশমার পাওয়ার অনেক বেশী হওয়ায় যেকোনো সানগ্লাস পরতে পারেনা ও। এই চশমাটা অর্ডার দিয়ে বানাতে হয়েছিল।
এইরকম সং সেজে তপনের আড্ডায় যাওয়া যাবেনা, টিশার্ট- পোলো কিছু একটা পরতে হবে হলে গিয়ে।
চারটে গোলাপ আর জারবেরার ছোট্ট তোড়াটা পকেট থেকে বের করতে ভুলে গেল ও। পাঞ্জাবিটা আবার পরার আগ পর্যন্ত ওখানেই শুকিয়ে ময়লা কাগজ হতে থাকবে ফুলগুলো।