আগের পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অনেকেরই জ্বীন-ভুত-পরী নিয়ে অনেক মাথা ব্যাথা। তারা কি সত্য, নাকি মিথ্যা, তারা শুধুই কি মিথ, পুরোটাই গুঁজব নাকি আসলেই ফ্যাক্ট? না, আমি কোন জ্বীন-ভুত বিশারদ নই। তবে ডেমন নিয়ে মনের কোনে একটু তরল জায়গা বরাবরই ছিল, আম্মু-আব্বু, দাদী-নানীদের মুখে সেই ছোটবেলা থেকেই ভূতের গল্পও শুনে ঘুমিয়েছি কি না তাই। সেই তরল জায়গায় কবে কবে যে শেওলা জমে গেছে জানিনা। সেখান থেকেই এদের উপরে একটু পড়াশুনা করতে শুরু করেছিলাম আর কি। আর যেহেতু, বাংলা হাবের মত ওয়াইড প্ল্যাটফর্মের সাথে যুক্ত যখন হয়েই গেছি, ভাবলাম যা পড়ছি, সবার সাথে শেয়ার করলে দোষ কোথায়। তাই সিরিজ আকারে শুরু করলাম ডেমনলজি। সাথে থাকুন, আশা করি খারাপ লাগবে না। আর সিরিজটি পছন্দ হোক বা না হোক, নিচে কমেন্টে আপনার অনুভূতি জানাতে ভুলবেন না। আর শেয়ার করাটা কিন্তু বাঞ্ছনীয়।
আজ সিরিজের পঞ্চম পর্বে লিখতে চেষ্টা করলাম বেলজেবুব সম্পর্কে কিছু কথা।
বেলজেবুব (বাল-জেবুল, বেলজেবুল, বেলজেবুব) হচ্ছে একজন ডেমন প্রিন্স। উৎপত্তিগতভাবে কনানীয় প্রতিমা বেলজেবুব এর অর্থ ‘লর্ড অফ ফ্লাইস’ বা ‘পতঙ্গদের রাজা’। যদিও বলা হয়ে থাকে বেলজেবুব নামটা বাল-জেবুল এর বিকৃতরূপ। বাল-জেবুল ছিল কনান’দের নেতা, একজন ফিনিস দেবতা। বাল-জেবুল শব্দের অর্থ ‘লর্ড অফ দ্য ডিভাইন অ্যাবোড’ বা ‘লর্ড অফ দ্য হ্যাভেনস’।
দেখতে বিশাল, কুৎসিত মাছির মত বেলজেবুব কে কেউ কেউ অবশ্য বিশাল উচ্চতার একজন মনস্টার হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন, যে জায়ান্ট একটা সিংহাসনে বসে থাকে। তবে আধুনিক বিশ্লেষণে ডেমনলজিস্টরা তার থ্যাঁতলানো চেহারা ও বুক, বিশাল নাক, মাথায় শিং, বাদুড়ের পাখনা, হাঁসের মত পা, সিংহের ন্যায় একটা লেজ ও সারা দেহে কালো পশমে আবৃত হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
বিশ্বাস করা হয়ে থাকে বেলজেবুব যীশুর সময়ে ডেমনদের প্রিন্স ছিল। ফারিসি পন্ডিতেরা যীশুর বিরুদ্ধে বেলজেবুবের নামে ডেমন এক্সরসিজমের অভিযোগ তুলেছিলেন। সেখান থেকেই শয়তান দিয়ে শয়তান বা অপবিত্র আত্মা বধ করার ব্যাপারটার উদ্ভব। এই ঘটনা ম্যাথিউ (১২:২৪-২৯), মার্ক (৩:২২-২৭) ও লুক (১১:১৪-২২) এ বর্ননা করা হয়েছে।
“জেরুজালেম থেকে যে ব্যাবস্থার শিক্ষকেরা এসেছিলেন তারা বললেন, ‘যীশুকে বেলজেবুবে পেয়েছে, ভূতদের রাজার সাহায্যে যীশু ভূত ছাড়ায়।’ তখন তিনি তাদেরকে কাছে ডেকে দৃষ্টান্ত দিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘কেমন করে শয়তান নিজে শয়তান ছাড়াতে পারে? কোন রাজ্য যদি নিজের বিপক্ষে নিজে ভাগ হয়ে যায়, তবে সেই রাজ্য টিকতে পারে না। আবার কোন পরিবারে যদি পারিবারিক কলহ শুরু হয়, তবে সেই পরিবার এক থাকতে পারে না। আবার শয়তান যদি নিজেই নিজের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তবে সেও টিকতে পারে না, তার শেষ হবেই। কেউই একজন শক্তিশালী মানুষের বাড়িতে ঢুকে তার দ্রব্য লুঠ করতে পারে না, যদি না সে সেই শক্তিশালী লোকটিকে আগে বাঁধে। আর বাঁধার পরেই সে তার ঘর লুঠ করতে পারবে।” (মার্ক ৩:২২-২৭)
সিউডেপিগ্রাফিকাল পুঁথি টেস্টামেন্ট অফ সলোমনে বেলজেবুব বা বেলজেবুলকে ডেমনদের প্রিন্স হিসেবেই বর্ননা করা হয়েছে, আর সে জাদুর আংটির সাহায্যে রাজা সলোমনের বধে ছিল। ডেমন অরনিয়াস এর মত রাজা সলোমন বেলজেবুবকেও বধ করেছিলেন। বেলজেবুব বাঁধা দিতে চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু জাদুর আংটির ক্ষমতার কাছে পরাস্ত হয়।
বেলজেবুব অবশ্য নিজেকে ‘দ্য রুলার অফ অল ডেমনস’ হিসেবে পরিচয় দেয়। রাজা সলোমন বেলজেবুবকে সব ডেমনের পরিচয় ব্যাখ্যা করতে বলেছিলেন। বেলজেবুবও বিপদে পড়ে তা দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। সে রাজা সলোমনকে জানায় যে সে সন্ধ্যাতারায় (ভেনাস) বাস করে। সে নিজেকে একমাত্র ডেমন প্রিন্স মনে করে, কারণ বেহেশতে সেই ছিলেন সবচেয়ে উচু র্যাংকের এঞ্জেল। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে সেই কিন্তু সবার আগে বেহেস্ত থেকে বিদেয় হন। তার সাথে ছিল ফলেন এঞ্জেল, অ্যাবেজেথিবো। অ্যাবেজেথিবো সম্পর্কে তো আগের পর্বেই লিখেছি।
সলোমন এই কথা শুনে অ্যাবেজেথিবোকে হাজির করতে বলেন, কিন্তু বেলজেবুব কোন ডেমনকে হাজির করতে অস্বিকার করে। তবে একথা জানিয়ে দেয়, এফিপ্পাস নামের কোন এক ডেমন এসে অ্যাবেজেথিবোকে নিয়ে আসবে।
বেলজেবুব আরো জানায় সে অত্যাচারী ও স্বেচ্ছাচারী রাজাদের ধ্বংস করে, মানুষের উপরে শয়তান চালান করে, আর ধার্মিক মানুষ, বিশেষ করে প্রিস্টদের ভিতরে যৌনকামনা জাগ্রত করে। সে আরো যুদ্ধ বাঁধায়, খুনের উৎসাহ দেয় ও হিংসা বাড়ায়। সে ঈশ্বর ও ইমানুয়েল (যীশু) কে দারুণ ভয় পায়। আর তার উপরে কেউ Elo-I Oath দিলে সে চলে যায়।
সলোমন বেলজেবুবকে তার টেম্পল নির্মানের জন্য থিবান মার্বেল কেটে ব্লক করার কাজ দেয়। এত বড় একজন ডেমনকে এত ছোট কাজ দেয়ার কারনে আবার অন্যান্য পাতি শয়তানেরা নাখোশ হয়। তাই সলোমন বেলজেবুবকে বলেন যে যদি সে তার মুক্তি চায়, তবে টেম্পল সাজানোর জন্য বেহেশতী জিনিসের নাম বলতে হবে। বেলজেবুব তাকে গন্ধরস (Myrrh) গাছের পোড়া তেল, লোবান (Frankincense), Sea Bulb নামক উদ্ভিদবিশেষ, জটামাংসী (Spikenard) ও জাফরান দিয়ে তার বাড়ির সুরক্ষা বাড়াতে বলে ও ভুমিকম্পের সময় সাতটা আলোর ল্যাম্প লাগাতে বলে। এই প্রক্রিয়ায় সন্ধ্যায় ল্যাম্প জ্বালালে বেহেস্তি ড্রাগন এসে সুর্যোদয় পর্যন্ত বাড়ির চারপাশে চক্কর ও প্রহরা দেবে। এই কথা শুনে রাজা সলোমন রেগে গিয়ে বেলজেবুবকে আবার পাথরের ব্লক কাটার কাজ দেয় ও অন্যান্য ডেমনদেরও কাজে মন দিতে বলে।
গসপেল অফ নিকোডেমাস বইতে বেলজেবুব কিভাবে স্যাটানের কাছে থেকে দোজখের শাসন ছিনিয়ে নেয় তার বর্ননা দেয়া আছে। যীশুর ক্রুসিফাইং এর পরে স্যাটান বেলজেবুবের সাথে দম্ভ করে যীশুকে দোজখে নিয়ে গিয়ে তার কৃতকর্মের জন্য শাস্তি দিতে চায়। কিন্তু বেলজেবুব স্যাটানকে তা করতে নিষেধ করে, কারণ যীশু এতই ক্ষমতাবান যে দোজখের শান্তি নস্ট করবেন। মানে দোজখে তারা যেসব করছে তা তছনছ করে দেবেন আর কি। ইন্টারেস্টিং না?
কিন্তু তবুও স্যাটান যীশুকে নিয়ে দোজখে হাজির হয়। তাই দেখে সুযোগ বুঝে বেলজেবুব স্যাটানকে দোজখের মুখে ধাক্কা দিয়ে দোজখের ভিতরে ফেলে দেয়। কিন্তু স্যাটান তবুও যীশুকে ছাড়ে না ও যীশুকে নিয়েই পড়ে যায়। বেলজেবুব তখন সব ডেমনকে ডেকে তাকে গেটে ব্যারিকেড দিতে সাহায্য করতে আবেদন জানায়। কিন্তু তারা যীশুকে ঠেকাতে পারে না। যীশু স্যাটানকে পায়ের নিচে ফেলে অবরুদ্ধ আত্মাদের চেইনটি ছিড়ে ফেলেন। তিনি সব আটকে পড়া সাধু-ঋষিদের মুক্ত করেন, ফলে তারা সাথে সাথেই বেহেশতে চলে যায়। বেলজেবুবের তখন আর কিছুই করার ছিল না। যখন যীশু সেখান থেকে চলে যান, স্যাটান বেলজেবুবকে দোজখের জমিদারী ছেড়ে দিয়ে পৃথিবীতে নেমে আসে।
মধ্যযুগে বেলজেবুবকে অনেক শক্তিশালী ডেমন হিসেবেই বিবেচনা করা হত। তৎকালীন জাদুকরী ডাকিনীরা ক্রাইস্টের নাম নিতে অস্বীকার করত ও “Beelzebub goity, Beelzebub beyty [বেলজেবুব উপরে, বেলজেবুব নিচে]” বলে ভজন ও নাচন করত। তাদের নৈশ ভোজনের রুটিতেও যীশুর বদলে বেলজেবুবের নাম খচিত থাকত।
গুপ্ত-উপাসনায় বেলজেবুবের সাথে ডাকিনীদের রতিসঙ্গমের অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। ডাকিনীরা কোন এক গোপন অন্ধকার জায়গায় উপবৃত্তাকারে জড় হয়। তারপর সোজা হয়ে শুয়ে পড়ে। এরপরে তারা এক ধরনের তরল পান করে যা প্রথমে তাদের শরীরে প্রচুর ঘাম উৎপন্ন করে এবং পরে তাদের দেহ অবশ করে ফেলে। যখন তাদের আর নড়াচড়া করার ক্ষমতা থাকে না, তখন বেলজেবুব তাদের সাথে রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হয় ও একইসাথে গুপ্ত-উপাসনা শুরু হয়।
সপ্তদশ শতাব্দীতে যখন হাই সোসাইটিতে ব্ল্যাক ম্যাসের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে, শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে বেলজেবুবের নাম জপ করা হত। জাদুবিদ্যা অনুযায়ী, একজন জাদুকর মৃগীরোগ, অঙ্গবিকৃতি বা শ্বাস বন্ধ হয়ে নিজের মৃত্যুর রিস্ক নিজের হাতে নিয়ে তবেই বেলজেবুবকে ডাকতে পারে। কারণ একবার বেলজেবুব আসলে তাকে ফেরত পাঠানো খুব কঠিন। তাকে ডাকার মন্ত্র হচ্ছেঃ
বেলজেবুব লুসিফার ম্যাডিলন
সলিম স্যারয় থেউ
অ্যামেক্লো স্যাগরায়েল প্রারিডুন
ভেনিত বেলজেবুথ অ্যামেন।
বেলজেবুব এর নামেও ভয়াবহ ডেমনিক পজেশনের কুখ্যাতি আছে। তাদের মধ্যে ১৫৬৬ সালে ফ্রান্সের লাওনে নিকোল ওব্রির পজেশন, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে নানদের উপর ঘটা Loudun পজেশন ও Aix-En-Provence পজেশন এগুলো উল্লেখযোগ্য। Aix-En-Provence পজেশন এর ব্যাপারে বালবেরিথ অধ্যায়ে লিখেছি।
আরলিং পজেশন ছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ঘটা সবথেকে মারাত্মক পজেশনের ঘটনা, যেখানে বেলজেবুব এনা একল্যান্ড নামক এক তরুণীর শরীরে তার বাবা জ্যাকবের আদেশে পজেজ করে। জ্যাকবের উদ্দেশ্য ছিল তার মেয়ের সাথে সেক্সুয়ালি রিলেশন করা। ব্যাপারটা এতটাই করুণ, যে এ নিয়ে আর লিখতে চাচ্ছি না। তবে ১৯২৮ সালের ২৩ শে ডিসেম্বর সে এনাকে ছেড়ে চলে যায়। যাওয়ার আগে ভয়ঙ্কর চিৎকার করে বলে যায় “বেলজেবুব, জুডাস, জ্যাকব, মিনা – হেল, হেল, হেল”। যাওয়ার সময় বিচ্ছিরী একটা দুর্গন্ধ বের হয়েছিল। উল্লেখ্য, মিনা ছিল এনার আন্টি ও জ্যাকবের বৌ।
বেলজেবুব সেভেন ডেডলি সিন (সাতটি মারাত্মক পাপ) এর পঞ্চম পাপ, Gluttony শাসন করে।
ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না। আপনারা শেয়ার করলে বারবার লিখতে আগ্রহ বাড়ে। আর সর্বদা নতুন কিছু জানতে বাংলা হাবের সাথেই থাকুন। অসংখ্য ধন্যবাদ।
(ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত ও প্রতীকী)