প্রশান্ত মহাসাগরের আতঙ্ক : দ্য ডেভিল’স সি

প্রশান্ত মহাসাগরে রয়েছে এমনই এক রহস্যময় জায়গা, যা ডেভিলস সী বা শয়তানের সাগর নামে পরিচিত। কি ঘটেছিল হারানো জাহাজ, প্লেন এবং সেই যাত্রীদের সাথে, কোথায় হারিয়ে যায় আর তাদের ধ্বংসাবশেষও কেন খুঁজে পাওয়া যায় না!? বিষয়টির একটু আলোচনা করা যাক।

জাপান এবং বোনিন দ্বীপের মধ্যবর্তী একটি জায়গা যা ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেল নামে পরিচিত। আর সাগরের যে এলাকায় এটি অবস্থিত তাকে বলা হয়ে থাকে ডেভিলস সী বা শয়তানের সাগর। এটি জাপান, তাইওয়ান এবং ইয়াপ দ্বীপপুঞ্জকে সংযুক্ত করেছে। যুগের পর যুগ ধরে এই স্থানটিতে শক্তিশালী কোন অদৃশ্য রহস্য লুকিয়ে আছে। যার সমাধানতো দূর বরং সমাধানের চেষ্টা করা হলেও গায়েব হয়ে গিয়েছে ! এসব কারণেও যায়গাটি একটি অশুভই নয় বরং লোমহর্ষক ভয়ঙ্কর স্থান হিসেবেই সবার কাছে পরিচিত। ভূতুড়ে রহস্যময় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেলকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের জমজও বলে থাকে। নৌকা থেকে শুরু করে বিশাল জাহাজ এমনকি এই অঞ্চলের উপর থেকে উড়ে যাওয়া বিমানগুলোও মুহূর্তেই কোন প্রকার সংকেত ছাড়াই গায়েব হয়ে যায়। কি ঘটে বা কোথায় যায় এবং এর ভেতরের দুর্ভাগা মানুষের সাথেই বা কি লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে থাকে , তা আজও জানা সম্ভব হয়েনি আর সম্ভব হবে বলেও আশা নেই।

ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেল নামকরণের একটি ইতিহাস রয়েছে। চীনে প্রায় ১০০০ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে একটি পৌরাণিক মতবাদ রয়েছে যে, এই শয়তানের সাগরের পানির গভীরে লুকিয়ে রয়েছে এক বিশাল ড্রাগন। যখন সে পানির নিচে চলাফেরা করে তখন সাগরের বুকে বড় বড় ঢেউ, ঘূর্ণিপাক, সামুদ্রিক ঝড়সহ চারিদিকে ঘন কুয়াশায় ঢেকে যায়। বিশাল ড্রাগন তার অসম্ভব ক্ষুধা নিবারণের জন্য বিভিন্ন জাহাজ বা বিমান খেয়ে ফেলে। আবার অনেকেই নাকি এখানে এক রহস্যময় নারীকে দেখেছেন। এ কারণেই যায়গাটি ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেল বা শয়তানের সাগর নামে পরিচিত।

১৯৫২-৫৪ সালে মোট পাঁচটি সামরিক জাহাজ এ জায়গা অতিক্রম করার সময় প্রায় ৭০০ লোকসহ নিখোঁজ হয়ে যায়। আবহাওয়াবিদরা জানান, ঐ মুহূর্তের আবহাওয়া একদমই শান্ত ছিল এবং জাহাজগুলো থেকে কোন প্রকার সংকেত বা সাহায্যও চাওয়া হয়নি ! তবে কি ঘটেছে তাদের সাথে !? ফলে অনেকেই এই পৌরাণিক মতবাদটিই সত্য বলে ধরে নেন।১২০০ শতাব্দীর দিকে কুবলাই খান বেশ কয়েকবার জাপানকে দখলে নিতে এগিয়েছিলেন শয়তানের সাগরের মাঝ দিয়ে। কিন্তু প্রতিবারই সেখানে এসে জাহাজ নিখোঁজ হয়ে গিয়েছে। শেষবার প্রেরিত যুদ্ধ জাহাজে প্রায় ৪০,০০০ সৈন্য ছিল যা ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেল পার হওয়ার সময় হাজার হাজার সৈন্যবাহিনীসহ গায়েব হয়ে যায় ! যার কোন সন্ধান আজও মেলেনি।

এসব অদ্ভূতুড়ে ঘটনার অনুসন্ধানের জন্য ১৯৫০ সালে জাপান সরকার ৩১ জন ক্রু-বিশিষ্ট কাইও মারু নং ৫ নামক একটি বিশেষ জাহাজ পাঠান। দুর্ভাগ্যবশত এই অনুসন্ধানকারী জাহাজটিও নিখোঁজ হয়ে যায়। ফলে জাপান সরকার এই জায়গাটিকে সমুদ্রযাত্রার জন্য বিপদসংকুল হিসেবে ঘোষণা করে।

এই রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য বিজ্ঞানীরা হন্যে হয়ে একের পর এক গবেষণা চালাচ্ছেন। ১৯৯৫ সালে ল্যারি কুশ নামক একজন আমেরিকান লেখকের প্রকাশিত ‘দ্য বারমুডা ট্র্যায়াংঙ্গেল মিস্ট্রি সলভ্‌ড’ বইটিতে ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেলে বিভিন্ন জাহাজ বা বিমান নিখোঁজের কারণ হিসেবে বইটিতে বলা হয়েছে, এই এলাকায় সমুদ্রের তলদেশে প্রচুর পরিমাণে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি এবং ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা রয়েছে। আর এই কারণেই এখানে প্রায়শই নতুন নতুন দ্বীপ জেগে ওঠে এবং অনেক দ্বীপ বিলীন হয়ে যায়।

blank

অনেক গবেষক বলে থাকেন, এসব অগ্ন্যুৎপাত এবং ভূমিকম্পের কবলে পড়ে এ জায়গা থেকে অতিক্রমকারী জাহাজ বা নৌকাগুলো এবং যার কারণে জলযানগুলো সমুদ্রের অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়। ফলে পরবর্তীকালে তাদের আর কোন সন্ধান পাওয়া যায় না।পরিবেশবিদদের মতে, এমন অগ্ন্যুৎপাত বা ভূমিকম্পের কারণে সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রতিনিয়ত বদলাতে থাকে। আরো আশ্চর্যের বিষয় হল, বিশ্বের কোন মানচিত্রেই ডেভিলস সী এর অস্তিত্ব নেই ! এ কারণে এই স্থানটির আয়তন বা অবস্থান সম্পর্কেও তেমন কোন সুস্পষ্ট ধারণা করা সম্ভব হয়না।১৯৭২ সালে লন্ডনের সাগা ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ‘দ্য টুয়েলভ ডেভিল’স গ্রেভ ইয়ার্ডস এরাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড’ অনুচ্ছেদ থেকে জানা যায়, পৃথিবীতে সর্বমোট ১২টি স্থান রয়েছে যেখানে তীব্র চৌম্বকীয় আকর্ষণ অনুভূত হয়। আর ডেভিলস সী বা শয়তানের সাগরে অবস্থিত ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেল ঠিক এমনই এক জায়গা।সায়েন্টিফিক আমেরিকানে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেলের এই স্থানটিতে প্রায় ৩৭,০০০ মাইল এলাকা জুড়ে গভীর সামুদ্রিক খাদ এবং প্রচুর পরিমাণে উদগিরিত লাভা ও কার্বন-ডাইঅক্সাইড রয়েছে।blank

১৯৭৩ সালে ল্যারি কুশ এবং আসাহি সিম্বুন (জাপানের একটি সর্বোচ্চ পঠিত সংবাদপত্র) এর সহ সম্পাদক শিগেরু কিমুরার যৌথ প্রয়াসে লেখা একটি বই থেকে মায়োজিনশো নামক সক্রিয় আগ্নেয়গিরি সম্পর্কে জানা যায়। মারু নামক জাহাজটি যেখানে নিখোঁজ হয়েছিল এই আগ্নেয়গিরিটির অবস্থান ঠিক সেখানেই ছিল। এই আগ্নেয়গিরি থেকে থেমে থেমে অগ্ন্যুৎপাত হয় যা প্রচন্ড আলোড়নের সৃষ্টি করে এবং শান্ত সমুদ্রকে মুহূর্তেই উত্তাল করে তোলে, যার ফলে যানগুলোকে প্রবল আকর্ষণে পানির অভ্যন্তরে টেনে নিয়ে যায়।

আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতকে প্রাধান্য দিয়ে থাকলেও এখনো সুনিশ্চিত হওয়া যায়নি এর আসল কারণ সম্পর্কে। বিজ্ঞানের যুগে প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক প্রকৃতির রহস্যে উন্মোচন অনেক ক্ষেত্রে ততটাই দুঃসাধ্য ব্যপার। ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেল এমনই এক প্রাকৃতিক রহস্যময় স্থান, যার রহস্য উন্মোচন অনেক বড় চ্যালেঞ্জ বিজ্ঞানের জন্য। আশা রাখি উন্মোচন হবে যুগ যুগ ধরে তামাশা সৃষ্টিকারী শয়তানের সাগর বা ডেভিলস সী এর রহস্য। তবে মাঝে মাঝে মনে হয় সত্যিই কি রাজ সিংহাসন পেতে এই জায়গাটিতে শয়তান বা রাক্ষুসীদল একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করছে নাকি শুধুমাত্র আগ্নেয়গিরিই এর মূল কারণ ?
তথ্যসুত্র: ইন্টারনেট

ছবিঃ

১ঃ http://www.ancient-origins.net/unexplained-phenomena/bermuda-triangle-pacific-devil-s-sea-connected-missing-ships-and-other-strange-021511

২ঃ http://www.pictame.com/user/smart.universe/2115917712/1160279552059663362_2115917712

৩ঃ http://www.ntd.tv/inspiring/life/alien-base-moon.html

৪ঃ https://www.parhlo.com/here-are-the-8-things-you-didnt-know-the-bermuda-triangle/