হ্যাঁ এই কথাটা থেকেই বোঝা যায় কোনভাবেই মাদক গ্রহন গ্রহণযোগ্য নয় । মাদক বর্তমান বিশ্বের একটি ভয়াবহ মারনাস্ত্র । এটা একদিন বা দুদিনে হয়ত কাউকে মেরে ফেলবে না তবে এটি ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে খুব কষ্টদায়ক মৃত্যুর দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় । কৌতূহলবশত বা অভ্যাসবশত বা বন্ধু মহলের চাপবশত কোনভাবেই মাদক গ্রহন কাম্য নয় । যেকোনো ধরনের মাদকের রয়েছে ভয়াবহ রকমের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া । তাই যেকোন অবস্থাতেই মাদক গ্রহন বর্জনীয় ।
মাদক কি :
মাদক এমন এক ধরনের দ্রব্য যা ব্যক্তির শারীরিক এবং মানসিক অবস্থায় পরিবর্তন আনতে পারে । সহজভাবে বলা যায় যে, যেসব রাসায়নিক দ্রব্য এবং ঔষধ গ্রহণে মানুষের স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উপর প্রভাব পড়ে এবং যে দ্রব্য আসক্তি সৃষ্টি করে, তাই মাদকদ্রব্য । অর্থাৎ মানুষ নেশার জন্য যা ব্যাবহার করে তাই মাদক দ্রব্য ।
মাদক দ্রব্য হিসেবে যেসব রাসায়নিক দ্রব্য বা ঔষধ ব্যবহার করা হয় সেগুলো সাধারনত নেশা করার জন্য তৈরি করা হয় না ।বিভিন্ন রোগ নিরাময় বা স্বল্পমেয়াদে ব্যাথানাশক বা উত্তেজনা প্রশমনকারী হিসেবে ব্যবহার করা হয় । কিন্তু যখনই কেউ এগুলোকে নেশা করার জন্য ব্যবহার করে এবং অপ্রয়োজনে দীর্ঘমেয়াদে সাময়িক সুখ লাভের জন্য ব্যবহার করে তখন সেগুলোকে মাদক দ্রব্য নামে অভিহিত করা হয় এবং এর অপর নাম মাদক দ্রব্যের অপব্যবহার ।
পুরো বিশ্ব জুড়ে মাদক একটি ভয়াবহ বিভীষিকার নাম । কিছু কিছু মাদকের রয়েছে চরম মাত্রায় পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া যা ব্যক্তির মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে । আসুন আজ জেনে নেয়া যাক বিশ্বের কিছু মারাত্মক মাদকের কথা এবং এগুলো গ্রহনের ফলে কি কি বিপদ হতে পারে সেই বিষয়ে ।
১। হেরোইন :
হেরোইন এক ধরনের ব্যাথানাশক । এটি মাঝে মাঝে ঠান্ডা কাশি কমানোর জন্যও ব্যবহার করা হয়ে থাকে কিন্তু সবসময় না । হেরোইন সাধারনত নেশার দ্রব্য হিসেবে ব্যবহার করা হয় এর সাময়িক আনন্দ অনুভূতি প্রদান করার ক্ষমতার জন্য । এটি আফিম থেকে এসেছে এবং এই ভয়ংকর মাদকটি প্রতিবছর হাজার হাজার মৃত্যুর কারন । এই মাদকের প্রতি শরীরের সহনশীলতা খুব তাড়াতাড়ি তৈরি হয় তাই ব্যক্তির শরীরে এই মাদকের চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকে ।
সল্প মেয়াদে এটা গ্রহন করার ফলে ব্যক্তির খাবারে অরুচি দেখা দেয় এবং বমি বমি লাগতে পারে ,ব্যক্তির মধ্যে মাতাল ভাব দেখা দিতে পারে, চিন্তাশক্তি লোপ পেতে পারে,সিদ্ধান্তহীনতা তৈরি হয় এবং ব্যক্তির মধ্যে দ্বিধা দ্বন্দ্ব দেখা দেয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে । তার শরীরের চামড়া অকারনে চুলকাতে পারে , চোখ সংকুচিত হয়ে যেতে পারে , আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা তৈরি হতে পারে, এটি গ্রহনের ফলে ব্যক্তির শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে থাকে এবং শ্বাস প্রশ্বাস ধীরগতি সম্পন্ন হয় ।
এর প্রতি আসক্তি তৈরি হলে এবং দীর্ঘদিন এটা গ্রহন করলে শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেয়, খিঁচুনি হতে পারে, বিচারবুদ্ধি লোপ পেতে পারে , অস্বাভাবিক আচরনের উদ্ভব হতে পারে এমনকি শেষ পর্যন্ত ব্যক্তির মস্তিস্ক কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে যার ফলে ব্যক্তির মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে ।
২। কোকেইন :
কোকেইন একটি শক্তিশালী আসক্তি সৃষ্টিকারী উত্তেজক মাদক । মানুষের সাধারন আবেগীয় অভিজ্ঞতার তুলনায় এটি চরম মাত্রায় আনন্দ বা হতাশার অনুভূতি দিতে সক্ষম । কোকেইন সাধারনত ডোপামিনকে মস্তিস্কের ভেতরের নিউরনের মধ্যেকার ফাঁকা তৈরি করতে বাঁধা দেয় এবং এতে করে মস্তিস্কে বেশী বেশী ডোপামিন জমা হতে থাকে এবং এর ফলে মস্তিস্ক উদ্দিপ্ত হতে থাকে ।
হাজার হাজার বছর ধরে দক্ষিন আফ্রিকার লোকজন কোকোয়া পাতা (Erythroxylon coca), যা কোকেইন এর উৎস ; চাবাতো এবং পাকস্থলীতে গ্রহন করত এর উদ্দিপনা শক্তির জন্য । ১০০ বছর আগে থেকে কোকোয়া গাছ থেকে শোধিত রাসায়নিক কোকেইন হাইড্রোক্লোরাইড (cocaine hydrochloride) আলাদা করা হত । ১৯০০ শতকে বিভিন্ন ধরনের শক্তিদায়ক ঔষধে কোকেইন প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হত এবং বিভিন্ন ধরনের অসুখের জন্য এ থেকে ওষুধ তৈরি করা হত ।
সিনথেটিক লোকাল এনেসথেটিক ( synthetic local anesthetic) আবিস্কারের আগে ডাক্তাররা ব্যাথানাশক হিসেবে কোকেইন ব্যবহার করত । যাহোক, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, কোকেইন এর শক্তিশালী আসক্তি ক্ষমতার জন্য এটি বারংবার ব্যবহার করার ফলে এটি মস্তিস্কের গঠন এবং কার্যপ্রণালীতে পরিবর্তন আনতে পারে ।
কোকেইন অতিমাত্রায় গ্রহন করার ফলে কিছু নিশ্চিত প্রভাব পড়ে ব্যক্তির উপর যেমন – তীব্র মাত্রার বুক ব্যাথা, ঘাম, দ্রুত শ্বাস প্রশ্বাস, বমি, দ্রুত হৃদ স্পন্দন এবং দৃষ্টি বিভ্রম ইত্যাদি ।
দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব হিসেবে ব্যক্তির হৃদপিণ্ডের এবং মস্তিস্কের রক্ত শিরাগুলোর স্থায়ী ক্ষতি, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট এটাকের ঝুঁকি, স্ট্রোক এবং মৃত্যু ঝুঁকি বৃদ্ধি , কলিজা, বৃক্ক এবং ফুসফুসের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাওয়া, চরম মাত্রায় দন্ত ক্ষয় , অপুষ্টিজনিত সমস্যা এবং ওজন কমে যাওয়া , ব্যক্তির মধ্যে শ্রবণসংক্রান্ত এবং স্পর্শজনিত বিভ্রম তৈরি হয় , ছেলে মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই যৌন সমস্যা দেখা দেয় , প্রজনন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ক্ষতি গ্রস্থ হয় এবং বন্ধ্যাত্ত হয় , চরমমাত্রায় বিষণ্ণতা দেখা দেয়, বিরক্তি এবং মেজাজ ওঠানামা করে , ঝুঁকিপূর্ণ আচরনের আশঙ্কা বাড়ে ইত্যাদি ।
৩। বারবিচুর্যাটস :
বারবিচুর্যাটস এমন একটা মাদক যা কেন্দ্রীয় স্নায়ু ব্যবস্থায় মানসিক বেদনানাশক হিসেবে কাজ করে এবং এটা ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টিকারী বস্তু হিসেবে কাজ করে যা মৃদু অনুত্তেজনা সৃষ্টি করা থেকে ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ অসাড় করে দিতে পারে । যেকোনো ধরনের উত্তেজনা প্রশমনকারী এবং ঘুমের ঔষধ এই বারবিচুরিক এসিড (barbituric acid ) থেকে উৎপন্ন হয় । বারবিচুর্যাটস এমন এক শ্রেণীর ঔষধ যা প্রশান্তিদায়ক- সম্মোহনী প্রভাবের জন্য পরিচিত । এটি সাধারনত ঘুম আসাকে তরান্বিত করা এবং উদ্বিগ্নতা কমানোর কার্যকরী ভুমিকার জন্য পরিচিত ।
এটি উচ্চমাত্রায় আসক্তি সৃষ্টিকারী এবং প্রায় সময়ই এটি অতিমাত্রায় গ্রহনের ঝুঁকি থাকে । অনেকে আবার এটিকে মদ বা হেরোইন এর সাথে মিশিয়ে খায় । এটিকে যখন মাদক হিসেবে নিয়মিত অধিক মাত্রায় গ্রহন করা হয় তখন এর ফলে ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে থাকে । যারা এটা অধিক মাত্রায় গ্রহন করে তাদের নিউমোনিয়া এবং ব্রংকাইটিস হওয়ার উচ্চ ঝুঁকি থাকে । এটি গ্রহনের ফলে যেসব ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে সেগুলো নিচে দেয়া হল
শারীরিকভাবে নিস্তেজ হয়ে যাওয়া , চিন্তাশক্তি কমে যাওয়া ,আবেগীয় অস্থিরতা পরিলক্ষিত হওয়া , মেজাজে তারতম্য দেখা দেয়া যেমন- যে কেউ যখন তখন অকারনে হাসতে হাসতে কাঁদতে পারে । বিরক্তি অনুভব করা , শত্রু ভাবাপন্ন মনোভাব পোষন ,নিন্দা করা,হাত পায়ের পেশীর উপর থেকে নিয়ন্ত্রন হারিয়ে যাওয়া অর্থাৎ কোন কিছু শক্তভাবে ধরতে না পারা, দ্বিধা দন্দে ভোগা , অস্বাভাবিক উত্তেজনা অনুভব করা , মাথা ঘোরা, তন্দ্রাভাব, চামড়ার সমস্যা, গিড়ায় গিড়ায় ব্যাথা, বিচার বুদ্ধির অবনতি হওয়া ইত্যাদি মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ব্যক্তির মধ্যে । শেষ ধাপে ব্যক্তি কোমায় চলে যেতে পারে এবং মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে ।
৪। ম্যাথাডন :
ম্যাথাডন একটি কৃত্রিম ব্যাথানাশক ঔষধ যার প্রভাব মরফিন এর মত কিন্তু এটা মরফিনের চেয়েও দীর্ঘস্থায়ী কাজ করে এবং এটি বিকল্প ঔষধ হিসেবে হেরোইন এবং মরফিন এর আসক্তির চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় । এই বিকল্প ঔষধটি সাধারনত রিহ্যাব সেন্টারগুলোতে ব্যবহার করা হয় যেহেতু এটা শরীরে মরফিনের মতই প্রভাব ফেলে । হৃদপিণ্ডের উপর এর নিশ্চিত প্রভাব লক্ষ করা যায় । ম্যাথাডন মানুষের প্রতিক্রিয়া করার ক্ষমতাকে ধীর করে দেয়, অনেক বেশি নিস্ক্রিয় এবং অলস করে দেয় ফলে ব্যক্তির হাঁটা চলা বিপদজনক হয়ে পড়ে । অর্থাৎ যে কেউ খুব সহজেই যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হতে পারে কারন বিপদজনক পরিস্থিতিতে তার যত তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নেয়ার দরকার তত তাড়াতাড়ি সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না এই মাদকের নেতিবাচক প্রভাবের ফলে ।
মানব শরীরে এর স্বল্পমেয়াদী প্রভাব হিসেবে অত্যানন্দ অনুভব, প্রশান্তি অনুভব, তন্দ্রা তন্দ্রা অনুভূতি , শিথিল অনুভূতি, চোখের পিউপিল ছোট হয়ে যাওয়া, মেজাজের ওঠানামা ইত্যাদি দেখা দেয় । এটি নেয়ার পর যখন শরীরে ম্যাথাডনের মাত্রা কমে যায় তখন হঠাত বিষণ্ণতা থেকে অতি আনন্দের অনুভূতি হতে পারে যা ব্যক্তির বিভিন্ন ধরনের পারিবারিক এবং সামাজিক সম্পর্কে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে ।
অতিমাত্রায় এটি গ্রহন করলে ব্যক্তির শ্বাস প্রশ্বাসে কষ্ট হতে পারে অথবা ছোট অগভীর শ্বাস প্রশ্বাস হতে পারে, নিম্ন রক্তচাপ, মাংসপেশিতে টান পড়া, বমি বমি ভাব অথবা বমি হওয়া, ঠোঁট এবং হাতের নখ নীল হয়ে যাওয়া এবং সবশেষে ব্যক্তি কোমায় চলে যেতে পারে ।
৫। লাইসারজিক এসিড ডায়াথিলামাইড (Lysergic acid diethylamide ) :
লাইসারজিক এসিড ডায়াথিলামাইড যা এসিড নামেও পরিচিত । এই ঔষধটিকে সংক্ষেপে LSD ও বলা হয়ে থাকে । এটি সাধারনত একটি সাইকেলেডিক ঔষধ যা মানসিক প্রভাবের জন্য ব্যবহার করা হয় । LSD একটি অর্ধ – স্ফটিক ঔষধ যা লাইসারজিক এসিড থেকে তৈরি । এটি একটি রংহীন, গন্ধহীন, স্বাদহীন স্ফটিক দ্রব্য যা পানি বা মদের মধ্যে দ্রবণীয় । যখন কেউ এটি ব্যবহার করে তখন তার স্থান,কাল, দূরত্ব এবং সময় সম্পর্কে বোধ লোপ পায় । এমনকি যারা এটা গ্রহন করে তারা এমনও বলতে পারে যে তারা ‘রঙ’ শুনতে পাচ্ছে , ‘শব্দ’ দেখতে পাচ্ছে ইত্যাদি । এটা প্রথমবার ব্যবহার করার পর থেকেই এর নেতিবাচক প্রভাব প্রকাশ পেতে থাকে এবং ব্যক্তির অতীতের কথা বার বার মনে হতে পারে ,যেখানে সে কখনও কোন নেতিবাচক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিল । এমনকি এটা গ্রহন করা বন্ধ করে দিলেও এই ফ্ল্যাশ ব্যাক বার বার হতে পারে । এই মাদকের প্রভাবে ব্যক্তি বিচার বুদ্ধি এবং আচরনের ওপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলে । এর ফলে ব্যক্তি নিজেকে প্রায় প্রায় কোন বিপদজনক পরিস্থিতির মধ্যে নিজেকে আবিস্কার করতে পারে ।
এই মাদক গ্রহনের ফলে ব্যক্তির চোখের তারা বা পিউপিল বড় হয়ে যেতে পারে ,শরীরের অতি উচ্চ তাপমাত্রা বা অতি নিম্ন তাপমাত্রা পরিলক্ষিত হতে পারে, খাবারে অরুচি দেখা দেয়, ঘুম কমে যায়,কাঁপুনি হয় ,ব্যক্তির দৃষ্টি এবং চিন্তার বিভ্রম ঘটে, আকার, আয়তন সম্পর্কে ধারনা লোপ পায় ইত্যাদি ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত হয় ব্যক্তির মধ্যে ।
দীর্ঘ মেয়াদে ব্যক্তির কারডিওভাস্কুলার এর কাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে অথবা হঠাত করে হৃদপিণ্ড কাজ বন্ধ করে দিতে পারে । চরম পর্যায়ে ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে অথবা মারাত্মক আহত হতে পারে ব্যক্তি ।
লেখকঃ শারমিন সেতু। সাইকোলজিস্ট/ কাউন্সেলর, সি ডব্লিউ এফ ডি