ঈদ-উল-ফিতর মুসলিমদের সর্ববৃহৎ উৎসব। মুসলিম দেশগুলোতে বড় করে ঈদ উৎসব পালিত হয়। এছাড়াও অনেক অমুসলিম দেশেও বর্তমানে ঈদ উৎসব পালিত হচ্ছে। এই ফিচারে আমরা বিভিন্ন দেশে ঈদ উৎসব কিভাবে পালন করা হয় তা তুলে ধরবো।
মিসর এর ঈদ-উল-ফিতর
মিসরে এ ঈদ-উল-ফিতর আনুষ্ঠানিকভাবে তিনদিনের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এ সময় স্কুল,কলেজ,ইউনিভার্সিটি,সরকারি অফিস এমনকি কিছু কিছু দোকান,রেস্টুরেন্ট ও বন্ধ থাকে। সামান্য নাস্তা করে এবং সবাই একত্রিত হয়ে সম্মিলিত ঈদের প্রার্থনার মধ্য দিয়ে দিনটি শুরু হয়।
বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন,পাড়া-প্রতিবেশী একে অপরকে ঈদ মোবারক বলে ঈদের শুভেচ্ছা জানায়। ঈদের প্রথম দিনটি সকলে কাটায় আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা সাক্ষাত করে, বাকি দিনগুলো তারা কাটায় সিনেমা হলে পার্কে বা সমুদ্র সৈকতে। “হারম এল শেইখ” নামক জায়গাটি ঈদের ছুটি কাটানোর জন্য অন্যতম জনপ্রিয় স্থান। শিশুরা বড়দের কাছ থেকে নতুন জামা এবং ঈদ সালামি পেয়ে থাকে।
বিভিন্ন রকম খাবার রান্না করা হয় যার মধ্যে “ফাতা” ঈদের বিশেষ একটি খাবার । এটি বাদাম এবং চিনি দিয়ে তৈরি। “কাহক” নামক আরও একটি খাবার আছে যার কারনে মিসরের বেকারিগুলো ঈদের সময় কোলাহলপূর্ণ থাকে। টেলিভিশনেও বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্প্রচারনের মাধ্যমে ঈদ উদযাপিত হয়। শিশুরা রাতে সবাই একসাথে হয়ে গল্পগুজব করে অথবা বড়দের কাছ থেকে গল্প শুনে,গানের আসর বসে। বাচ্চাদের জন্য মোটরসাইকেল ভাড়া করে শহর ঘুরে বেড়ানো অপরিহার্য বলা যায় মিসরে। মিসরের মানুষেরা সকলে মিলে একসাথে ঈদের আনন্দ উপভোগ করে বলে তাদের রাস্তাগুলো এ সময় অনেকবেশি কোলাহলপূর্ণ থাকে।
বাংলাদেশে ঈদ-উল-ফিতর
বাংলাদেশে ঈদ-উল-ফিতর তিনদিনের সরকারি ছুটি হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ধর্মীয় অনুষ্ঠান। সাধারণত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলো এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ থাকে। সকালবেলা ঈদের নামায আদায় করা,বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সাক্ষাৎ করা আর যাকাত-ফিতরা আদায় করার মধ্য দিয়ে ঈদের আনন্দ শুরু হয় এ দেশে। নতুন জামাকাপড় এবং মেয়েদের হাতে মেহেদী পরা বাড়িতে অথবা বন্ধুদের সাথে মজাদার খাবার খাওয়া একটি অন্যতম জনপ্রিয় ঈদের রীতি।
ফিলিপাইনে ঈদ-উল-ফিতর
ফিলিপাইনে ঈদ-উল-ফিতর সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্রিষ্টান এবং অমুসলিমদের কাছে ওয়াকাস নগ রমজান অথবা রমজান হিসেবে পরিচিত। সরকার কর্তৃক প্রজাতন্ত্র আইনের 9177 ধারা অনুসারে এ দিনটিকে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০২ সালের ১৩ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি একই নির্দেশ জারি করে ১০৮৩ ধারাতে,যা পৃথিবীর একমাত্র খ্রিষ্টান দেশে এটি করা চালু করা হয়।এই আইনের মাধ্যমে ফিলিপিনো মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে অন্যান্য প্রধান ধর্মগুলোর মধ্যে সম্প্রীতি,ঐক্য ও শান্তিসৃষ্টি হয়। ২০০২ সালের 6 ডিসেম্বর ফিলিপাইনে প্রথম জাতীয়ভাবে মুসলিম সম্প্রদায় নামায আদায়ের মাধ্যমে ঈদ উদযাপন করে। অধিকাংশ ফিলিপিনো মুসলিমরা কুরিনো গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড এবং ম্যানিলা মসজিদে প্রত্যেক ঈদ পালন করে।
দক্ষিন আফ্রিকার ঈদ-উল-ফিতর
প্রতি বছর শত শত মুসলমান রমজানের শেষ দিন সন্ধ্যাবেলায় কেপ টাউনের গ্রিন পয়েন্টে চাঁদ দেখার জন্য জড়ো হয়। সবাই সমবেত হয়ে একে অপরের সাথে সাক্ষাৎ করে। মাগরিবের নামায আদায় করে এবং আনুষ্ঠানিক চাঁদ দেখার ঘোষণা দেয়। এখান থেকেই শুরু হয় দক্ষিন আফ্রিকার ঈদ-উল-ফিতরের আমেজ। সকালে ঈদের নামায আদায়ের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয় ঈদ। নতুন জামাকাপড় পড়ে আত্মীয় এবং প্রতীবেশীদের বাসায় যাওয়া আর সুস্বাদু সব বিভিন্ন রকমের কেক,বিস্কুট,সমুসা খাওয়া বাচ্চাদের জন্য এক আনন্দময় ব্যাপার। এখানকার শিশুরা বড়দের কাছ থেকে হরেক রকমের উপহার পেয়ে থাকে প্রতি ঈদে।
অস্ট্রেলিয়া
অস্ট্রেলিয়া প্রধানত অমুসলিম দেশ হওয়া সত্ত্বেও এখানে মুসলমানরা বিপুলভাবে ঈদ পালন করে। এমনকি যে এলাকায় মুসলমান বেশি সেখানে ঈদ-উল-ফিতর কে ছুটির দিন হিসেবে দেখা হয়। যেসব এলাকায় মসজিদ আছে সেখানে পুলিশ তাদের ঈদ উদযাপন করার সময় নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। তারা নির্বিঘ্নে নামায সম্পন্ন করে এবং নামাযের পরবর্তী উৎসব উৎযাপন করে। ঈদের নামাজ খেলার মাঠ বা স্টেডিয়ামেও অনুষ্ঠিত হয়। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ১৯৮৭ সাল থেকেই ঈদ ফেয়ার উদযাপন হয়েছিল। সেখানে লক্ষাধিক মানুষ সমবেত হয়েছিল। তারপর থেকে এটি প্রতিবছর হচ্ছে আরও বিভিন্ন শহরে। শুধু মুসলিম নয় অমুসলিমরাও এখানে অংশগ্রহণ করে। মেলবোর্নে সরকারী ছুটির দিনে বড় করে ঈদ উদযাপন করে। অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরায় পুলিশ ফেডারেশন ঈদ উৎসবের জন্য স্পন্সর করে। এসব উৎসবে বিভিন্ন রাইড,স্টল থাকে ও নানান দেশের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।
চীনের ঈদ উৎসব
অমুসলিম দেশ চীনে ঈদ উল ফিতর শান্তিপূর্ণ ভাবে পালন করা হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা জিনজিয়ান ও নিংজিয়া প্রদেশে তিনদিনের সরকারী ছুটি ঘোষণা করা হয়। অন্য প্রদেশে একদিন করে ছুটি দেওয়া হয়। হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় সরকারীভাবে ভেড়ার গোশত প্রদান করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা খাবার প্রদান ও সরবরাহ করে থাকে। ইউনান প্রদেশের মুসলিমরা নামাযের পর ‘সাইয়েদ আজাল’ এর কবর যিয়ারত করে। সেখানে গিয়ে তারা কুরআন তিলাওয়াত করে।ঈদ উল ফিতরের প্রধান খাওয়া থাকে বিভিন্ন পশুর গোশত।
যুক্তরাজ্য
ঈদ উল ফিতর যুক্তরাজ্যে সরকারি ছুটি হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। তবে বর্তমানে অনেক মুসলিম ব্রিটেনে বসবাস করে তাই বিভিন্ন পেশাজীবী লোক এই দিনে ছুটি নেয়। দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত পুরুষরা সাধারণত পাঞ্জাবী জুব্বা, শেরওয়ানি,টুপি পরে। মহিলারা সালোয়ার কামিজ পরে। ঈদের নামায পড়ে প্রতিবেশি বন্ধু আত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে যায়। অনেকে যায় কবরস্থানে যায় মৃত ব্যাক্তির কবর যিয়ারত করতে। এই দিনে যার যার দেশের ঐতিহ্যবাহী খাবার রান্না করে।
মালায়শিয়া
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ মালায়শিয়াতে ঈদ উল ফিতর বড় করে উদযাপিত হয়। এই সময় সরকারী ছুটি থাকে। সবাই নিজ নিজ পরিবারের সাথে ঈদ পালন করে।এখানে ঈদের আগের দিন থেকেই উৎসব পালিত হয়। ঈদের আগের রাতকে তাকবিরান বলা হয়।মসজিদ ও রাস্তায় তাকবির ধ্বনি উচ্চারিত হয়। রাস্তাঘাটে মশাল আতশ বাজি করা হয়। তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার রেন্দাং,কেতুপাট,লেমাং রান্না করে। শহরে ঘরে ঘরে প্রচুর পরিমানে খাবার রান্না করে প্রতিবেশী এমনকি অমুসলিমদেরকেই দাওয়াত দেওয়া হয়। খাওয়ার পর গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। চীন থেকে বাঁশি আমদানি করা হয়।এই বাঁশি খুব জোরে বাজে। সন্ধায় বাজি উৎসব চলে।
সৌদি আরব
সৌদিআরবের জাতীয় উৎসব হল ঈদ উল ফিতর ও ঈদ উল আযহা। তিন দিন সরকারী ছুটি থাকে। তাদের একটি প্রচলিত রীতি হল ছেলেরা তাদের ছেলেমেয়ে স্ত্রী নিয়ে পিতার বাসায় ঈদ পালন করবে। ঈদ উপলক্ষে খাবার ও উপহার বিতরন করা হয়। এমনকি অমুসলিমদেরকেও উপহার দেওয়া হয়। গরিবদেরকে খাবার বিতরন করা হয়। ঘরে ঘরে মিষ্টিজাতীয় খাবার বানানো হয়। এসময় আত্মীয় প্রতিবেশিরা বেড়াতে আসে। অনেকে আবার বাইরে বিভিন্ন পার্কে বেড়াতে যায় ও একসাথে খাওয়া দাওয়া করে।
ইন্দোনেশিয়া
এখানে ঈদ এর দিন সরকারী ছুটি থাকে। মানুষ ঈদ উপলক্ষে নতুন জামা কাপড় কিনে। যেহেতু বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোক এসে এখানে কাজ করে তাই তারা ঈদ এর ছুটি কাটাতে নিজ নিজ এলাকায় যায়। এইজন্য রাস্তায় প্রচুর যানজট থাকে। ঈদের দিন মিষ্টি জাতীয় খাবার তৈরি করা হয়। ছোটদের খামে করে ঈদের সেলামি প্রদান করা হয়। ঈদের দিন মহিলারা ইন্দোনেশিয়ার ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘কেবায়াকুরঙ্গ’ পরিধান করে। ঈদের দিন তারা সমাধিস্থলে যায়। সেখানে কুরআন তিলওয়াত করে ও মোনাজাত পাঠ করে। এছাড়াও কুরআনের একটি অধ্যায় থেকে বিশেষ আলোচনা হয়। এই অনুষ্ঠানের নাম “হালাল বি হালাল”।
যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রে ঈদ উৎসব বড় করেই পালন করা হয়। মুসলিমরা ইসলামিক সেন্টার,খোলা মাঠ,কনভেনশন হলে একত্রিত হয়। যেসব এলাকায় মুসলিম কম তারা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় চলে আসে। এইদিন অনেক মসজিদে নামায পরার পর খাওয়ার আয়োজনও থাকে। নিয়ইয়র্কের জর্জ এবং ব্রাউন কনভেনশন সেন্টার টেক্সাসের ডাউনটাউন, হিউস্টোন বিভিন্ন ইসলামিক সংস্থার অর্থায়নে ঈদ উৎসব পালিত হয়। ২০০১ সাল থেকে ক্যালেন্ডার,ডাকটিকেট মুসলিমদের দুই বৃহৎ উৎসব প্রচলন করে। মুসলিমরা বাসায় খাবারের আয়োজন করে। অনেকে পরিবার বন্ধুবান্ধব নিয়ে বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে যায়।