ঈদের আনন্দ কখনও পুরনো হয় না।প্রতিটি মুসলমানের জন্য আনন্দের উৎসব হল ঈদ ! সকল মুসলমানের জন্য ঈদ এর দিন আনন্দ করার দিন !ছেলেমেয়ে, বড়ছোট নির্বিশেষে সবাই মেতে ওঠেন আনন্দে। এ দিন ভেদাভেদ ভুলে যাওয়ার দিন। পৃথিবীব্যাপী এই একই বার্তা নিয়ে উদযাপিত হয় ঈদ।বিশ্বের মুসলমানদের ইসলামিক রীতিতে ঈদ উদযাপনের পাশাপাশি প্রত্যেক সংস্কৃতিতেই ঈদ উদযাপন কাছাকাছি হয়ে থাকে। কিছু ভিন্নতা সব জাতির মধ্যেই রয়েছে। এ দিন বিভিন্ন দেশে মুসলিমরা ঈদের খুশিকে ভাগাভাগি করে নিতে চান অন্যের সঙ্গে। দেশটি পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক, মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা ঈদ উদযাপন করেন কমবেশি একইভাবে।তবে জেনে নেওয়া যাক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঈদ পালিত হয় কি ভাবে।
প্যালেস্টাইন:
প্যালেস্টাইনে ঈদের বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে ভেড়ার মাংস। যাদের সামর্থ্য আছে তারা পুরো ভেড়া রোস্ট করেন, আর অন্যরা মানসাফ নামে ভেড়ার মাংসের একটা ডিশ রান্না করেন। নামাজ শেষে বাসায় গিয়ে সবাই নতুন জামাকাপড় পরে ঘুরতে যান। সেখানে তারা প্রত্যেক বাসাতেই কিছু মিষ্টি বিতরণ করে। আর প্রত্যেক বাড়িতে গিয়ে তাদের মিষ্টি খেতেই হবে। দুপুরে পরিবারের সবচেয়ে বড় সদস্যের বাসায় সবাই একত্রিত হয়ে দুপুরের খাবার খাওয়াটাও তাদের রেওয়াজ।
সৌদি আরব:
সৌদি আরবে ঈদ অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে পালিত হয়। সৌদি আরবের বড় বড় শহর গুলোতে ঈদ এর আগের রাত থেকে শুরু করে, ঈদ এর আমেজ শেষ না হয়া পর্যন্ত ক্রমাগত বিরাট আকারে আতশবাজি হতে থাকে। ঈদ এর নামাজ আদায় শেষে পরিবারের সকলে যেকোনো একজন আত্মীয়ের বাসায় মিলিত হন। খাবার পরিবেশন এর আগে ছোটরা বড়দের কাছ থেকে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে “ঈদি” বা “ঈদের সালামী” আদায় করে। আরবরা এসময় বাচ্চাদের চমৎকার প্যাকেটে মোড়ানো উপহার দেয়। সাধারণত উপহারগুলো মোমবাতি, খেলনা বা চকলেট হয়ে থাকে।ঈদের দিন আরবরা তাদের উদারতার পরিচয় দেন। বড় বড় চাল ভর্তি বস্তা তারা গরিবদের ঘরের সামনে রেখে আসে। রাস্তায় অচেনা বাচ্চাদের তারা উপহার দান করে। কিছু কিছু এলাকায় বড় বড় জায়নামাজ বিছিয়ে সেখানে আশেপাশের প্রতিবেশীরা খাবার রান্না করে আনে এবং সকলে মিলে সেখানে ঈদ এর খাবার গ্রহন করে।ঈদ এর সময় দোকানগুলোতে বিশেষ করে চকলেটের দোকানগুলোতে ক্রেতাদেরকে ক্রিস্টালের বাটি উপহার করে।
জর্ডান:
জর্ডানে তিন দিন ধরে মুসলিমরা তাদের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে ঘুরে বেড়ান। এ সময় মহিলারা খেজুর থেকে বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করেন। এ ছাড়াও জর্ডানের ঈদ আতিথেয়তায় অন্যতম উপাদান হচ্ছে অ্যারাবিক কফি এবং চকোলেট।
সিঙ্গাপুর:
সিঙ্গাপুরে সুলতান মসজিদ এবং স্ট্রিট অঞ্চলটিতে মুসলিমদের বসবাস। তাই ঈদের সময় সেখানে উৎসবের বন্যা বয়ে যায়। আঞ্চলিকভাবে ঈদকে ‘হরি রয়া পসা’ বলা হয়। ঈদের এক মাস আগে থেকেই বাড়িঘর, দোকানপাটে শুরু হয়ে যায় আলোকসজ্জা। ঈদের দিন মুসল্লিরা সবাই ঈদের জামাতে যোগ দিতে রওনা হন সুলতান মসজিদের দিকে। নতুন জামাকাপড় পরে ঈদের নামাজ শেষে তারা বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তারপর শুরু হয় ঘুরে বেড়ানোর পালা।
মিশর:
ঈদ এর নামাজ শেষে ঈদ এর প্রথম দিন মিশরীয়রা আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করে। ঈদের পরের দুই দিন তারা নিজেদের মত করে ঈদ উদযাপন করে। শার্ম এ শেখ ( Sharm El Sheikh) নামের একটি জায়গায় তারা ঈদের ছুটি কাটাতে বেশ পছন্দ করে।ঈদ এ বাড়ির ছোটরা এবং মহিলারা (মা, বোন, স্ত্রী) বিশেষ উপহার পেয়ে থাকে এবং ঈদ এর দিন বাচ্চারা বড়দের কাছ থেকে ঈদি আদায় করে। মিশরীয়রা ঈদ এ “ফাটা”(Fata), “কাহক”(Kahk) বিভিন্ন মিশরীয় মিষ্টান্ন তৈরি করেন। ঈদ এর আগের রাতে বেকারিগুলোতে “কাহক” কিনবার জন্য ক্রেতাদের লাইন লেগে যায়।ঈদ এর পরের দুইদিন বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় মেলা বসে। সেখানে প্রতিবেশীরা খাবার রান্না করে এনে একসাথে মিলে রাতের খাবার খায়। বাচ্চাদের জন্য গল্পকথক ও জাদুকর আসে। পুতুলনাচের খেলা ও চলতে থাকে। ঈদ এর সময় মিশরের রাস্তা মানুষ দিয়ে ভরা থাকে।
মালয়েশিয়া:
মালয়েশিয়ানরা ঈদের বিশেষ খাবার হিসেবে বাঁশের কোটরে ভাত রান্না করে। একে ‘লেম্যাঙ’ বলে। নারকেল গাছের পাতা দিয়ে পাত্র তৈরি করে ভাত রান্না করে তারা। এটিকে বলে কেটুপাট। বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের অন্যদের নিয়ে তারা এই খাবারটি মাংস, তরকারিসহ খেয়ে থাকেন। ঈদের দিনটি হচ্ছে ভুলত্রুটি ক্ষমা করার দিন। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী এদিন ছোটরা বড়দের সামনে এসে মাথা নিচু করে তাদের ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। সবচেয়ে বেশি আনন্দ করা হয় প্রথম তিন দিনেই। এ সময় তারা একে অপরকে ‘সেলামত হরি রয়া’ বলে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। বিভিন্ন রকমের পণ্য নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। খাবারদাবার থেকে শুরু করে খেলনা- সবকিছুই পাওয়া যায় এই মেলায়।
দক্ষিণ আফ্রিকা:
কেপ টাউন এ ঈদের আগের দিন বিকালে “গ্রিন পয়েন্ট” নামের একটি জায়গায় সব পেশার মুসল্লিরা মিলিত হয় ঈদ এর চাঁদ উঠা দেখার জন্য। সকলেই কিছু না কিছু খাদ্য তৈরি করে আনে এবং সকলে একসাথে মাগরিবের আযান শুনে সেখানেই ইফতার করে। ইফতার পর্বের শেষে মুসল্লিরা সেখানে ঈদ এর চাঁদ দেখে।
ঈদ এর দিন তারা নামাজ আদায়ের পর তার পরিবারের সাথে ঈদের খাবার গ্রহন করে।
ইরান:
ইরানে শিয়া প্রাধান্য থাকায় ঈদের চিত্রটা একটু অন্যরকম। এখানে অনেকটা অনাড়ম্বরভাবেই ঈদ পালন করা হয়। তাদের মতে এই ঈদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে দান। তাই অভাবগ্রস্তদের মধ্যে তারা খাবারদাবার বিতরণ করেন। খাবারের মেনুতে থাকে কাবাব, ভাত, গ্রিল করা টমেটো, বিভিন্ন সবজি আর দই।
আফগানিস্তান:
আফগানরা ঈদের ১০ দিন আগে থেকে তাদের ঘর বাড়ি গুছানো শুরু করে। তারা একে বলে “খানা তাকানি” (Khanatakani)। ঈদের দিন তারা জিলাপি, স্বর নাখোদ (Shornakhod), কেক ওয়া কোলচা (Cake Wakolcha) ইত্যাদি আফগান খাদ্য তৈরি করে। মহল্লায় বাচ্চারা বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি গিয়ে “ঈদ মুবারক” বলে এবং নানা ধরনের মিষ্টান্ন আদায় করে। ঈদের দিন পুরুষরা মাঠে যেয়ে একে অপরের দিকে অর্ধ সিদ্ধ ডিম ছুড়ে সেগুলো ভাঙ্গার চেষ্টা করে। এই খেলার নাম টোখম-জাঙ্গি (Tokhn-jangi) ।
তুরস্ক:
ঈদের সময় তুরস্কের লোকেরা অন্যান্য দেশের মুসলিমদের মতোই একজন আরেকজনের বাসায় বেড়াতে যান। এ সময় ছোটরা বড়দের আশীর্বাদ লাভের আশায় তাদের হাতে চুমু খায়। সেখানকার রীতি অনুযায়ী ছোটরা হাতে চুমু খেলে তাদের টাকা-পয়সা বা উপহারসামগ্রী দিতে হয়। এ দিন তারা শুধু মিষ্টি জাতীয় খাবার দিয়ে সবাইকে আপ্যায়ন করে।
কুয়েত:
কুয়েতে দুই ঈদের পাশাপাশি নবীর জন্ম এবং মৃত্যুদিনগুলোকেই জাতীয়ভাবে পালন করা হয়। সাধারণ আনুষ্ঠানিকতার পাশাপাশি এ দেশের মানুষ ঈদের দিন ভেড়ার মাংস দিয়ে ভোজের আয়োজন করে। পুরুষরা বিশেষ ধরনের তলোয়ার নৃত্য বা আর্ধা প্রদর্শন করে।
ভারত:
ঈদের কয়েদিন আগে থেকে ঈদের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়। মেয়েরা হাত ভর্তি করে মেহেদি দেয়। ঈদের নামাজ শেষে অনেকেই তাদের প্রয়াত আত্মীয়ের কবরের কাছে তাদের জন্য দোয়া করতে যায়। নামাযের আগে তারা মিসকিনদের ফিতরা দান করে। অনেকে এই সময় যাকাত ও দান করে।
ইন্দোনেশিয়া:
ঈদে ইন্দোনেশিয়ানরা কুয়ে লাপিস (Kue Lapis) নামের একধরনের মিষ্টান্ন জাতীয় খাদ্য তৈরি করে। এই খাবারটি নানা রঙের ও নানা লেয়ারের কেকের মত। ঈদের নামাজের আগে তারা এই খাবারটি গ্রহন করে।
মায়ানমার:
ঈদের দিন প্রতিটি বাড়িতে বার্মিজ বিরিয়ানি রান্না হয়। তারা তাদের বাড়ির মেহমানদের অনেক রকমের হালুয়া দিয়ে আপ্যায়ন করে।
পশ্চিমা দেশগুলোতে ঈদ উদযাপনের চিত্র একটু অন্যরকম। সেখানে মুসলিম আধিপত্য না থাকায় ঈদ অনেকটা অনাড়ম্বরভাবে পালিত হয়। তবে সব জায়গাতেই মুসলমানরা একত্রিত হয়ে নামাজ আদায়ের পর শুভেচ্ছা বিনিময় করে। যেমন অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ঈদ উপলক্ষে বিশাল এক জনসমাগম হয়। এরপর চলে বিশাল ভোজ।