সময়ের সাথে সাথে আমাদের সমাজ থেকে বর্ণবাদ ক্রমশ কমে এসেছে। বর্ণবাদের ক্ষতিকর প্রভাব এবং এ বিষয়ে গঠনমূলক আলোচনার ব্যাপারে আজ মানুষ অনেক বেশি সচেতন। কিন্তু তারপরও বর্ণবাদের সেই ভয়াবহতার অনেক কিছুই আমরা এখনো জানি না। সেগুলো থেকে গেছে দৃষ্টির আড়ালেই। এমনকি নাগরিক অধিকারের যুগ, কিংবা মার্কিন গৃহযুদ্ধ এবং সমকালীন ইউরোপেও ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোও আমরা ভুলে গেছি।
১। মার্কিনীদের হাতে বন্দী ফিলিপিনোদের খাঁচায় প্রদর্শন
বিংশ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকে আমেরিকা এবং ইউরোপে একটি ধারণা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তা ছিল “জীবন্ত গ্রামের চিত্র” কিংবা আরো কড়া ভাষায় বলতে গেলে “মানব চিড়িয়াখানা।“ কালো মানুষগুলোর উপর সাদাদের কর্তৃত্ব স্থাপন, কালোদের সমাজের নীচু স্তরে দেখানো এবং সাদাদের অসুস্থ বিনোদনের উৎস হিসেবে এই ধারণার জন্ম হয়।
আমেরিকা এবং ফিলিপাইনের মধ্যে যুদ্ধের পর বিজয়ী আমেরিকা সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা পরাজিত ফিলিপিনোদের “জংলী” হিসেবে প্রদর্শন করার মাধ্যমে চূড়ান্ত অপমান করবে। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার কারণে এখনো অনেক ফিলিপিনো তাদের মনের মধ্যে রাগ পুষে রেখেছে।
যেসব ফিলিপিনো আমেরিকার এই জঘন্য ঘটনার স্বীকার হয়, তাদের মধ্যে “ইগোরোট” উপজাতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাদের একটি বৈশিষ্ট ছিল, আর সেটি হচ্ছে তারা প্রায়ই কুকুরের মাংস খেতো। এ কারণে তারা সবার চোখে পরে যায় খুব তাড়াতাড়িই। তাদেরকে সবার সামনে “কুকুরখেকো” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যাতে সবার ধারণা হয় যে তারা যথেচ্ছা কুকুর হত্যা করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তারা শুধুমাত্র তাদের নিজস্ব কিছু অনুষ্ঠানেই কুকুরের মাংস খেত, সবসময় নয়। কিছু মানুষের ধারণা যে ইতিহাস এই ঘটনাগুলো ভুলে গেছে। কিন্তু এখনো অনেকে আছেন যারা আগামী ১০০ বছরেও এই ইতিহাস মনে রাখবেন।
২। ইউরোপে আমেরিকান আদিবাসীদের প্যারেড
বেশিরভাগ মানুষই জানেন, আমেরিকান আদিবাসীরা বছরের পর বছর ধরে কিরকম নিগ্রহের স্বীকার হয়েছে। কিন্তু তারা জানেন না, এই নিগ্রহের ব্যপকতা কতটুকু ছিল। ঐতিহাসিকভাবেও এগুলো লুকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কলম্বাস যখন আদি আমেরিকান ভূ-খন্ডে পা দিলেন, তিনি অনেকগুলো দ্বীপ আবিষ্কার করলেন যা ছিল আদিবাসী এবং সোনার খনিতে ভরা। এসবই তাকে ভয়ংকর লোভী করে তোলে। তিনি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সোনা সেখান থেকে চুরি করেন। সেই সাথে প্রায় একশ মানুষকে অপহরণ করেন। তাদেরকে নিয়ে বন্দী করে তিনি গড়ে তোলেন “জীবন্ত চিড়িয়াখানা।“ যাদের মধ্যে প্রথমদিকে যারা অপহৃত হয়েছিল, তারা মাত্র ছয় মাসের মধ্যে মারা যায়। কিন্তু কলম্বাসের নিষ্ঠুরতা তারপরও থামেনি। হয়তো ইতিহাসের ক্লাসে তাকে “বীর” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বাস্তবে তিনি তা ছিলেন না।
৩। মন্টেজুমার মানব চিড়িয়াখানা
কলম্বাস হয়তো সেই অসহায় মানুষগুলোকে নিষ্ঠুরভাবে চিড়িয়াখানার প্রাণীদের মতো ব্যবহার করেছেন, কিন্তু তাদের মধ্যে পুরোধা ছিলেন অ্যাজটেক সম্রাট মন্টেজুমা। তিনি অত্যন্ত ক্ষমতাধর সম্রাট ছিলেন। এই বিপুল ক্ষমতাই তাকে নেশাগ্রস্ত করে তুলেছিল। তার একটি বিশেষ নেশা ছিল। আর তা হচ্ছে তিনি শারীরিকভাবে কিছুটা অস্বাভাবিক, অসুস্থ মানুষদের নিয়ে তার জীবন্ত চিড়িয়াখানা গড়ে তুলেছিলেন। তার সেই জান্তব চিড়িয়াখানায় কুষ্ঠরোগী ছিল, কুঁজো ছিল, ছিল বামন। পাশেই ছিল বিভিন্ন জন্তু-জানোয়ারদের চিড়িয়াখানা। এদিক দিয়ে তিনি আমেরিকান কিংবা ইউরোপীয়দেরও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন।
৪। সাফারি পার্কে জারাওয়ারা
হয়তো মনে হতে পারে, আদিবাসীদের নিয়ে এই নৃশংসতা সুদূর অতীতের কোন গল্প। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখনো পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে যারা টাকা দিয়ে হলেও এইরকম শোষিত মানুষদের ব্যবহার করতে চায়। “জারাওয়া” উপজাতি বহু বছর ধরে ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে বসবাস করে আসছে। বাকী পৃথিবীর সাথে তাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ খুবই সীমিত। তাদেরকেও বিভিন্ন ব্যাবসায়ীরা পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য ব্যবহার করে। তাদের নাচের মাধ্যমে তারা বিপুল পরিমাণ মুনাফা অর্জন করে।
৫। আইভরি কোস্টের জীবন্ত গ্রাম
প্যারিসে সাম্প্রতিক হামলা স্বত্বেও ফ্রান্স বরাবরই বিদেশী অসহায় মানুষের আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিচিত। ১৯৯৪ সালে আইভরি কোস্টের “জীবন্ত গ্রাম” থেকে অসংখ্য মানুষ ফ্রান্সে আশ্রয় গ্রহণ করে। যদিও তাদের পাসপোর্ট তাদের বন্দীশিবিরের মালিকদের কাছে বাজেয়াপ্ত ছিল। তাদেরকে নানান রকম লোভ দেখানো স্বত্বেও তারা আর আইভরি কোস্টে ফিরে যায়নি।
লেখক সম্পর্কেঃ ইশফাক জামান। পেশায় প্রকৌশলী, নেশায় কবি ও লেখক। শখ কবিতা লেখা, ফিচার লেখা, অনুবাদ করা। বিভিন্ন অনলাইন (অফলাইন ও) ম্যাগাজিনে লেখালেখি করছি বেশ কয়েক বছর। পেশাগত জীবনে Linde Bangladesh Ltd. এ Territory Manager হিসেবে কর্মরত আছি।